কবে যে সুর ফিরে পাব কে জানে?

‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে
ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে
আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে...।’
বাংলাদেশে থাকলে আজ হয়তো আমার মনেও ফাগুন লাগত। এই সুদূর আমেরিকার প্রকৃতিতেও আজ ফাগুনের ছোঁয়া। কয়েক দিন আগে আমার চারপাশে ছিল ভালোবাসা দিবসের প্রস্তুতি। তবে এই ভালোবাসা দিবস আমার মনে আলাদা আলোড়ন তোলেনি। কারণ আমার জন্য প্রতিটি দিনই কোনো না কোনোভাবে ভালোবাসা দিবস।
এখানে ক্যালিফোর্নিয়ার এখন প্রখর তাপ। আর বাংলাদেশের মিষ্টি রোদের ভেতর আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এ দেশে কোকিল ডাকে না। আজ দেশে থাকলে কাচের চুড়িতে ছন্দ তুলতাম। আমেরিকা তো কেউ রেশমি চুড়ির নামও কোনো দিন শোনেনি হয়তো। আর বাকি সব তো বাদই দিলাম। এখানে আমি নিজের নামও ভুলতে বসেছি। এখানে কাজীর আড়ালে ফাল্গুনী এমনভাবে ঢাকা পড়েছে যে, এখন বসে ভাবতে হয়—ও মেয়ে, তোমার নাম সত্যি ফাল্গুনী তো? কাজী এফ ঈশিতা। এ দেশের নিয়মে ঠিক এভাবেই লিখতে হয় নিজের নামকে। এখানের বিদেশিরা নামের মাঝের অংশ নিয়ে মাথা ঘামান না। ঈশিতার উচ্চারণ তারা বলেন—‘এসিটা’। অতএব আমার ওই কাজীই ভরসা। তবুও মনে মনে খুশি হই এই ভেবে—যাক বাবা, আমি বাঙালি। চীনা নই, চীনাদের তো নাম সংক্রান্ত দুর্ভোগ আরও বেশি।

মনে পড়ে বাফার বন্ধুদের সঙ্গে সমবেত কণ্ঠে সুর তোলা। মনে পড়ে শুক্রবার-শনিবার সকাল হলেই হারমোনিয়ামে রেওয়াজ। বিশেষভাবে সাজগোজ, শুধুই গানের জন্য। শনিবারে অফিস থেকে ছুটি নেওয়া বিকেল হতেই—আমার গানের ক্লাস আছে বলে। সংগীতপ্রিয় সহকর্মীরা সানন্দেই ছেড়ে দিতেন আমায়।
এ দেশের কাজী ভালো ছাত্রী হওয়ার চেষ্টায় ব্যস্ত। রাস্তাঘাট চিনতে ব্যস্ত। এখানকার হাজারো নিয়ম-শৃঙ্খলা মানতে ব্যস্ত। আমেরিকা কাজীকে হয়তো ভালো লেখাপড়ার প্রতিশ্রুতি দেবে। দেবে স্বাধীনভাবে চলাফেরার নিশ্চয়তা। তবে আমেরিকা কোনো দিনও ফাল্গুনীর মনের খোরাক জোগাবে না। ফাল্গুনীর মন পড়ে থাকবে গীতবিতানের পাতায়। ফাল্গুনীর মন পড়ে থাকবে কিবোর্ডে তোলা প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতের সুরে।
অতএব, এ দেশে আমার মনে ফাগুন লাগবে কি করে? বাঙালি ফাল্গুনী যেভাবে কাচের চুড়ির ছন্দে হেসে উঠতে পারে, আমেরিকার যান্ত্রিক কাজী হয়তো তা পারে না। তাই তো পয়লা ফাল্গুনের দিনে কণ্ঠও বিদ্রোহ ঘোষণা করল। সেদিন কণ্ঠে স্বরই নেই। সুর থাকবে কি করে? কবে যে সুর ফিরে পাব কে জানে?
(Kazi Falguni Eshita, Pasadena City College, California, USA)