কবিতার এক পাতা

শব্দের খেলায়, কিংবা কথার বুননে কবি তাঁর উপলব্ধি ও বিশ্বাসের কথা লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর এই সৃজন হাতুড়ি ও ছেনির ক্রমাগত আঘাতে শব্দের খোদাইয়ে নির্মিত শিল্প বিন্যাস! তাই বলে তিনি চোখ-কান বন্ধ রেখে শুধু ভাবের ঘরে রাজত্ব করেন না। চারপাশে প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা, অবিরাম জীবন প্রবাহ তাঁকে স্পর্শ করে যায়। তিনিও জগতের আনন্দ বেদনাকে সাথি করেই জীবন নিত্যতায় মিশে থাকেন। শোষণ, বঞ্চনা, অধিকার হরণের মতো ঘটনা তাঁকেও ক্ষুব্ধ করে তোলে। কবিতার বিষয় ভাবনায়, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উদ্ভাস থাকে সে অনুভবের।

উত্তর আমেরিকা ও বাংলাদেশের আটজন কবির আটটি কবিতায় সাজানো ‘কবিতার এক পাতা’ জুন সংখ্যায় আপনাদেরকে

বিনীত আমন্ত্রণ।—ফারুক ফয়সল

কৃষ্ণচন্দ্রের দ্রোহ

ফকির ইলিয়াস

বৃক্ষ যেদিন মানুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল,

জেনেছি-সেদিনই প্রকৃতিতে নেমে এসেছিল বনেদি দুর্যোগ!

কিছু মানুষ হরণ করেছিল পাখিদের প্রশ্বাস;

কিছু নদী ভুলে গিয়েছিল ঢেউতন্ত্রের প্রকার;

কিছু পর্বত সকল অনিয়মের প্রতিবাদ করতে করতে

ভেঙে পড়েছিল মানুষের মাথার ওপর!

তারপরও মানুষ জমাট হতে ভুলে গেল,

হাত তুলতে ভুলে গিয়ে হলো ফেরারি!

দেশ না ছেড়েও মানুষ নির্বাসিত হতে পারে!

ভূমি না ছেড়েও মানুষ হয়ে যেতে পারে সর্বহারা!

আমি তোমাকে যে কৃষ্ণচন্দ্র সেন-এর গল্প বলছি,

অথবা যে কৃষ্ণ বরণ চাঁদ একদিন গ্রহণ করেছিল

তাবৎ মানুষের সকল বেদনা—

জানি, সমস্বরে সকল প্রাণ জেগে উঠলেই,

জগতে আলোর আর কোনো অভাব থাকে না।

অরণ্যে যেতে দাও বৃক্ষ প্রণয়ে

হোসাইন কবির

মানুষ যাবে কত দূরে মেঘ বৃষ্টির ঘর ছেড়ে?

মানুষকে রেখো না বেঁধে শৃঙ্খলিত খাঁচায়

অরণ্যে যেতে দাও বৃক্ষ প্রণয়ে

বিবিধ শৃঙ্খলে-বিশ্বাসে ধর্মে-অধর্মে পা ফেলে

রাজ্য জয়ে, পালাবদলে-উৎখাত উৎখাত খেলায়—

মানুষ যাবে-কত দূরে আরও

ঢালবে বিষ পলিতে মাটিতে আর কত!

তাবৎ শৃঙ্খল, ধর্মাদেশ-বিবিধ বিধান

মানুষই ঝুলিয়েছে কালে কালে

বিস্তীর্ণ প্রান্তরে জলরেখায় সীমানা প্রাচীরে।

বাতাসে আগুন জ্বেলে

বিস্তৃত অদৃশ্যে জটাজালে

জটিল বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় সমুদ্র তরঙ্গে-গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে

নক্ষত্রলোকে নতুন উপনিবেশে-চাষাবাদ বিস্তারে

মানুষ ওড়াবেই একদিন নতুন ভূমিতে নতুন নিশানা!

তবু, মানুষকে রেখো না বেঁধে

বলিষ্ঠ পায়ে হেঁটে যেতে দাও রোদ আর মেঘের পাহাড়ে

পলি জমা কাদামাটি জলের শরীরে

আনন্দ-বেদনায় শোক আর সঙ্গমে

স্বাধীন দোতারায় গাইতে দাও

সরল সংলাপ জীবনের যাবতীয় সহজপাঠ।

অক্সিজেন শ্বাস

হেনরী স্বপন

তোমার ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন আজও ফালি ফালি

চোখ মেলে থাকে;

হরিণীও বিষাদের গাঢ় প্রোটিনের বেশে,

নেমে আসে নদীটির বাঁকে।

মৃত্যু বুঝে আজও আমি আজীবন যুদেয়ার মতো

ঘাতকের দলে;

ক্রুশবিদ্ধ পাখিদের গান, ডলফিন ঢেউ,

ম্রিয়মাণ কেউ নেই ছলাচ্ছলে।

ফিসফিস করে বুকের ভেতর কর্পূরের ঘ্রাণ—

অক্সিজেন শ্বাস;

সিলিন্ডার ভর্তি আঁচ টের পাই কীর্তনখোলায়

তুমি বালিহাঁস...!

তুমি আছ দোদুল্যমান, বাড়ির কাছের একটি হিজল গাছ...।

জীবন অনন্য

তাপস গায়েন

পরিশ্রুত জলস্রোত এই অরণ্য গভীরে

এই প্রবাহ দেখেনি কোনো ভ্রমণবিলাসী তরুণী,

কিংবা ভ্রাম্যমাণ দার্শনিক

জলের দর্পণে নক্ষত্রেরা দেখে নেয়

তাদের জরা কিংবা যৌবন,

কিংবা এই শান্ত প্রবাহে পূর্ণ-চাঁদ

ভেসে গেছে অন্য কোনো দিগন্তে

কী এসে যায় কোনো দিন এই প্রবাহ

কোনো লোকালয়ে এসে পৌঁছেছে কী না

যদিও এই জীবন মুকুরিত হতে ভালোবাসে

নেকড়ে কেঁদে ওঠে জোছনা-প্লাবিত অরণ্যে

পরিশ্রুত জলস্রোত বয়ে চলে অরণ্য গভীরে…

নির্বাক

মোস্তাক আহমাদ দীন

সর্বশেষ দণ্ড হাতে নিয়ে

তারপর দাঁড়াবে চণ্ডাল, বিধি মতে এ রকম জানি

তাহলে এবার কোন নিক্তি হাতে দাঁড়িয়েছে পথে

হাতে দড়ি, পায়ে-পেটে সূত্রজাল রেখা

বন্ধনের শ্রুতি-স্মৃতি নিয়ে

বৈরী প্রহরীকে পাশে ফেলে রেখে এসে দাঁড়িয়েছে

পিছে তার নিরাকার-রূপে-থাকা চণ্ডালের গ্রাম

এই দণ্ড এই দুর্ঘটনার পিছে

কতটা বিপদ আর কতটুকু রয়েছে শুশ্রূষা,

তা কি জানা যাবে এই বন্য তামাশায়?

ক্লান্ত পথিকরূপে আমি আজও রয়েছি নির্বাক!

সিজনাল ব্লুজ

রওশন হাসান

সবুজ, ঈষৎ সবুজ, প্রগাঢ় সবুজের কোলাহল

আকাশ, জানালা রপ্ত নিয়ত নিস্তব্ধতা

মন বোঝে না প্রকৃতির তারতম্য

অসার শরীর, হিম বাতাস উদ্গ্রীব ছোটে দুরন্ত অশ্ব

হঠাৎ করেই কোনো সান্নিধ্য নিবিড় হতে হতে দূরে সরে যায়

অস্পষ্ট কারও মুখ, স্পষ্টতর অধুনাকাল।

প্রতিটি আসবাব কান পেতে শোনে,

শোনে দেয়াল ঘড়িতে সময়ের প্রস্থান

অট্টালিকার উচ্চতায় পুস্তকের সারি

ছড়িয়ে দিতে চায় প্রেম, মোহ,

ক্ষিপ্র আকর্ষণ, বিচ্ছেদ অনাহূত

আকাঙ্ক্ষার নিষ্ক্রিয় আবেগে মেলানকোলিয়ার দহন জ্বর

আকণ্ঠ ডুবে যাই অন্তর্গত লয়-প্রলয়ে

আমার চোখে প্রতিবিম্ব সংশয়, যতিচিহ্ন লাইফলাইন

আমার কবিতার শেষ পংক্তিটি যেন অক্সিজেন

আমায় ভিন্ন সুরে বাঁচিয়ে রাখে, আমার নিশ্বাস ব্লু পাখি।

লাইটহাউস

কেয়া ওয়াহিদ

গ্রীষ্মে তেজস্বিনী সূর্য পরে শিফন আঙরাখা

আর শীতে আরামদায়ক মখমল

স্বচ্ছ দিনের প্রখরতা এড়াতে তৈলাক্ত চোখে

ব্র্যান্ডনেম কালো সানগ্লাস

মেঘমেদুর অভিসারে সকাল, দুপুর, বিকেল—

রাতের জলসা ঘরে উচ্ছ্বসিত দেবতারা

স্ফটিক বুদ্‌বুদ তোলে ক্রিস্টাল গ্লাসে;

রেডওয়াইনের ছলকে ওঠা চিয়ার্স

অবিনাশী বজ্রানলে রক্তিম দামামা,

বোধ ও বিবেকের নিদারুণ মৃত্যুতে

এতিম মানবতা পড়ে থাকে ধ্বংসস্তূপে—

পুঁজিবাদী আলোয় শ্বাসরুদ্ধ আকাশ, সুনামির

উত্তাল ঢেউয়ে ভেসে যায় অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরি,

যাত্রীবাহী জাহাজের অপেক্ষা—

লাইটহাউসের অলৌকিক সংকেত!

শেষ প্রশ্ন এবং মুমূর্ষু শিরোনাম

হাবিব ফয়েজি

প্রশ্নের ভেতরে প্রশ্ন

অসংখ্য প্রশ্নের স্রোতে কেবল প্রশ্নেরা

খায় হিমশিম! ক্রমাগত হিমালয়…

আকাশের শরীর ছুঁয়ে শপথ করে

প্রশ্নেরা বাজায় বীণা

তুমি কি প্রশ্নে দুলছ

অসংখ্য প্রশ্নের ভিড়ে; শেষ প্রশ্নে?

অথচ আমাদের সমুদয় ভাবনার অবসানে

চন্দ্রাবতী আকাশ পথ জুড়ে তার শুভ্রতা

‘পথের পাঁচালিতে’ কিংবা বাঁকে বাঁকে

নেমে আসে সমস্ত বোধের মুমূর্ষু শিরোনাম

তারপর ঘরের ফ্যান অথবা বাল্বের বিশ্বাসে

প্রতিনিয়তই জেগে ওঠে মানবিক টান

সে আকাশ দূরে কোথাও লুকিয়ে গেছে; মনে করো?