কবিতার এক পাতা
প্রিয়জন। সবাই শুভেচ্ছা জানবেন। পেরিয়ে এলাম যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় পালিত কবিতার মাস এপ্রিল। মধ্য এপ্রিলে আমাদের পয়লা বৈশাখ। মাত্র সপ্তাহ পূর্বে বিশ্বব্যাপী উদ্যাপিত হলো ঈদুল ফিতর। প্রকৃতিতে ফুলেল বসন্ত। চমৎকার সোনা ঝরা, ঝলমল করে হেসে ওঠা সব সকাল। দীর্ঘ শীতের দেশে এসেছে উষ্ণতার দিন।
এমন সব দিনেও আমাদের মনে এই উষ্ণতা আনন্দের তাপ ছড়াতে পারছে না। একটি বছর পেরিয়ে আরও পাঁচ মাস প্রায়, আমরা করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত। আজও আমরা জানি না—ভাইরাসের হিংস্র ছোবল থেকে সত্যিকার মুক্তি কবে আসবে?
এদিকে দেশে দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিগোষ্ঠীর তাণ্ডব। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলা ও নিরীহ মানুষ হত্যা। আফগানিস্তানে তালিবান কর্তৃক মেয়েদের স্কুলে বোমা হামলা। তবে কি মানুষ এক কদমও এগোয়নি প্রকৃত সভ্যতায়, মনুষ্যত্বে?
কবিতা আমাদের মানববন্ধন। ভালোবেসে আমন্ত্রণ ‘কবিতার এক পাতা’ মে সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও বাংলাদেশের আটজন কবির আটটি কবিতা পাঠে। সবার জন্য এক বুক ভালোবাসা। —ফারুক ফয়সল
হয়রান হোমোসেপিয়েন্স
তমিজ উদ্দীন লোদী
দিনের প্রখর আলোতে হারিকেন নিয়ে বেরোতেন ডায়াজেনিস
‘দিনের বেলায় হারিকেন কেন?’ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলতেন—
‘মানুষ খুঁজতে বেরিয়েছি’।
বস্তুত মানুষ খোঁজা দুরূহ কাজ
যদিও জগৎ ভ্রমিয়া দেখেছিলেন হাছন রাজা ‘একই মায়ের পুত’
মানুষ আর একই মায়ের পুত নয়, তারা ভাগ হয়ে গেছে সেই কবে।
পাতা ঝরার মতো ঝরে গেছে মানুষ পাতা।
‘এপস’গুলো খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হোমোসেপিয়েন্স
অথচ মানুষই হারিয়ে যাচ্ছে নব্য কোনো বিবর্তনের পথে।
নীলাভ ছায়ার বেশে
ঝর্না রহমান
অনঙ্গ পালক তুমি শুয়ে আছ আকাশ ছায়ায়
বিহঙ্গ জীবন তুমি লিখেছিলে ফেরারি পাখায়
এলাচ কলির মতো চোখ মেলে লবঙ্গ শাখায়
অঙ্গের সুগন্ধ নিয়ে উড়েছিলে জাভা সুমাত্রায়।
তখন অরণ্য নারী খুলেছিল পাতার কোরক
তুমিও আশ্লেষে খুব লিখেছিলে মরমি ষটক
দারুচিনি ঝাল চোখে দেখেছিলে কী অনুঘটক
নীলাভ ছায়ার বেশে এসে হয়েছিল হন্তারক।
যতই পালক ছলে এক এক করে খোলো দেহ
সমস্ত বাসর জুড়ে খেলা করে রঙের সন্দেহ।
আমার এ পথ পরিক্রমায়
ফারুক ফয়সল
এভাবেই আমি ক্রম প্রলম্বিত জীবন রচনা করি...
এভাবেই আমি ক্রমাগত অন্য এক জীবনের কথা বলতে বলতে—
অন্য মানুষ হয়ে যাই, পারিপার্শ্বিক জীবনের সঙ্গে মিশতে মিশতে—
পার্থিব সকল সম্পর্কে আবদ্ধ থেকেও আমি সম্পর্কহীন হয়ে পড়ি!
মৃত্যুর কথা ভাবি না, কেন না হামেশাই আমি মৃত্যুকে অতিক্রম করে যাই
আত্ম নিমগ্নতার মগ্নতায় আমি গ্রহণ করি জীবনের পাঠ,
প্রাকৃতিক জীবনের নানা সূত্র গেঁথে নিই আমার ভাবনায় আর সঞ্চয়ে।
কর্মই জীবনের দৈর্ঘ্য নির্ধারক কেবল, এই সরল অঙ্ক কষে
আয়ুরেখার দাগ টেনে নিয়ে যাই আমার করদাগ ছাড়িয়ে মহাকালে।
জন্মান্তরের পরিক্রমায় নব কিশলয়ে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে পুরাতন বৃক্ষ,
প্রজন্মান্তরে নতুন প্রাণে নিজেকেই রোপণ করে যায় মানুষ অবশেষে!
বংশগতি মনুষ্য সমাজকে আকার ও প্রাণীজ স্বভাব ধরিয়ে দেয় জন্ম নিদর্শনে,
বাকি সবটুকুই তার নিজের সৃজন, নিজেকেই অতিক্রম করে যাওয়ার অভিলাষে!
কোনো প্রিয় ঋতু নেই
সজল আশফাক
স্মৃতির সে মেঘে কী যে
বর্ষা নামে বটের ছাতায়!
বিকেল, রৌদ্রের মেদ ভেঙে নতজানু হয়।
রৌদ্রজলের ছোঁয়া পায় না জীবনানন্দ পথিক;
সময়ের নুনে নুনে
বৃক্ষের নিচে বিকেল হয় রাত।
নিশ্বাসে শ্যামের বাঁশি বাজে।
রাঁধাকে খুঁজে খুঁজেই সব ঋতুতে সে হাঁটে
একা, অশ্বত্থের ছায়ায় মায়ায়।
ওধারে স্বপ্নের হাতে হাত রেখে,
পৃথিবীর ভালোবাসা পাখাতলে
রাঁধা ভেজে রৌদ্রজলে।
সমকাল
জিললুর রহমান
পুড়ছি অনলে সন্তাপের—
কেউ কেউ বলেছিল এপ্রিল নিষ্ঠুর মাস
বাতাসে উড়ন্ত বিষ অনন্তের—
ঘন হয়ে আসে শ্বাস—বিষণ্ন বিশ্বাস
ভেবেছি সুদিন খুব দূরে নেই—
শিশিরে রোদ্দুর জমে হেসে উঠবে খলখল—
জানি, আজ এসবের কোনো মানে নেই
সময় পেরিয়ে আজ সকলেই হৃতবল
রেখার ওপরে রাখি হাত
সরলরেখারা চলে বক্রতার পথে
চরাচরে কেবলই শূন্যের অভিঘাত
আলোক কণারা চড়ে উপবৃত্ত রথে
মা
তুষার গায়েন
অনেক আগে বিস্মৃত শৈশবে
মা’র সঙ্গে যাচ্ছি মায়ের বাড়ি
যেখান থেকে শেকড় ছিঁড়ে
মেয়ে থেকে মা হয়েছেন
অনেকগুলো আমার মতো
সন্তান যে তারই।
অনেক দূরের পথ—
লঞ্চে ঘুমাই রাত্রি জুড়ে,
ঘুম ভেঙে যায় অনেক ভোরে
দেখি মা ফুটে আছে সাদা ফুল
এক মৌনী অন্ধকারে...
ভোরের বাতাস জানালা দিয়ে
জলের গন্ধে আসছে ভেসে
মা’র চোখে স্নিগ্ধ হাসি
কাঁপছে আলোয় অন্ধকারে
আর কিছু দূর গেলেই যে তার
বাবার স্মৃতির বাড়ি।
বসন্তের গান
মনিজা রহমান
কেন মানুষ অপেক্ষা করে
নিদাঘ দুপুরে একটি পাখির ডাক শুনবে বলে,
একটি সুর কাঁপিয়ে দেবে উন্মাতাল
অধর কাঁপিয়ে ভাসবে,
কান্নার অথই নোনা জলে!
কেন মানুষ অপেক্ষা করে
শীত ঘুম শেষে, বসন্ত জীবন ফিরে পেতে
অগণন ফুলের প্রান্তরে হতে ঈষৎ বাসনাময়
শব্দের সংসর্গে নৈঃশব্দ্যের মিতালিতে!
কেন মানুষ অপেক্ষা করে পেতে
কারও অন্তর্গত হৃদয়ের ঘ্রাণ
কেন মানুষ নিবিষ্ট কান পেতে থাকে প্রকৃতিতে—
শুনতে বসন্তের আগমনী গান!
জোড়া চাঁদ
আল ইমরান সিদ্দিকী
বসন্তের এ মেঘলা সকালবেলা—
বৃষ্টি পড়ছে ভোর থেকে টিপ টিপ
ঠান্ডা বাতাস, দুলে ওঠে ডালপালা—
সিঁড়ির গোড়ায় কম্পিত টিউলিপ।
আজকে তোমার সমান ব্যস্ত কই!
বসে থাকি ঘরে, বাইরে বৃষ্টি ঝরে;
দু’কথা বলতে খোঁজ করি তোমাকেই
ব্যস্ত লোককে ফেলি যে আতান্তরে।
বৃষ্টির ফোঁটা তোমার ও-মুখটাকে
আয়নার মতো ধরে নিয়ে ঝরে যায়;
বাইরে দাঁড়ালে কে আর শান্ত থাকে—
মিরর-মেইজে ওই মুখ ঝলকায়।
ভেবে দেখো তুমি, এমন মেঘের পাশে
সামর্থ্য কই তোমাকে এড়িয়ে চলি;
আজকের দিনে হুহু করে এসে মেশে
বহু বর্ণিল কাঙ্ক্ষিত দিনগুলি।
হতে কি পারে না দু’জনের মাখামাখি?
না হয় মোটেও না থাকলে অজ্ঞাত—
গাছেদের ডাল হাওয়ায় দুলছে দেখি
সম্মতি আর অসম্মতির মতো।