কন্যা আমার মা
আকাশে তখনো আলো ফোটেনি। কাকের ডাকাডাকি শুরু হয়নি। শুধু ভোরের আজানের সুমিষ্ট ধ্বনির রেশ কর্ণ গভীরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। ঠিক এমন একটি সময়ে আরও একটি ধ্বনি শুনে মুগ্ধ হয়ে তার মুখটা দেখছিলাম। প্রথম কোলে নেওয়ার স্বাদ ও মুখ দর্শন যে কেমন অনুভূতি, তা কেবল একজন বাবাই জানেন।
দিনে দিনে কোল থেকে হামাগুড়ি, গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলা সব হয়েছে চোখের সামনেই। বিকেলে হাত ধরে খেলার মাঠে, দোলনা, দৌড়ঝাঁপ আর সন্ধ্যায় ঘরে টিভিতে শিক্ষণীয় কার্টুনে মনোযোগ। নিয়মের তাগিদে সকালে স্কুলের কলধ্বনি, খেলার ছলে শিক্ষা। এভাবেই এক এক করে শ্রেণির পর শ্রেণি টপকে এক সময় সে নবম গ্রেডে পদার্পণ করে।
আজ কন্যা আমার মায়ের রূপে। কৈশোরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তার সামনে বিশাল পৃথিবী অপেক্ষা করছে আগামী দিনের জন্য। কী হবে কী করবে ভবিষ্যতে তার একটি সুস্পষ্ট আভা আমি প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করি তার মুখে, তার আচরণে। বাবা মায়ের কঠোর পরিশ্রম, ধ্যান-প্রার্থনা তো তাকেই পূরণ করতে হবে।
সব কন্যারা তার বাবার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একজন। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। আমার কন্যা আমার মা, আমার পৃথিবী। তাকে দেখে অতীতে ফিরে যাই। কিন্তু বাস্তবতা ফিরিয়ে নিয়ে আসে কন্যার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সেবায়, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজে, শ্রেষ্ঠ ভালোবাসায়।
আজ আমার কন্যা-আমার মা নিজের অজান্তে কিছু কিছু দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে। ইন্টারনেট বিল সঠিক সময়ে পরিশোধ, গাড়ির কিস্তি পরিশোধ, ঘর ঝাড়ু দেওয়া, বাবাকে ওষুধের কথা মনে করিয়ে দেওয়া এমনকি অপ্রয়োজনীয় কোনো খরচ হচ্ছে কিনা তাতে কন্যা সর্বদা সচেষ্ট। মায়েরা বুঝি এমনি হয়। বলার আগেই করে ফেলে সব।
প্রবাস জীবনের চাপা কষ্ট, কাজ এবং মানসিক কষ্টে কখনো দুর্বল হয়ে পড়লেও দিনের শেষে কন্যার মুখ দর্শনে সব তুচ্ছ হয়ে যায়। ভোর থেকে শুরু করে বিকেল অবধি কাজ শেষে বাসায় ফিরি। কন্যা অপেক্ষা করে। এসেই মা ছেলের একত্রে রান্না। কন্যা খুব আগ্রহ নিয়ে রান্নার কাজে সাহায্য করে। রান্না শেষে তৃপ্তি ভরে খেয়ে মুখে তার তৃপ্তির হাসি। আমি মুগ্ধ হয়ে অনুভব করি। কখনো মধ্যরাত পর্যন্ত থাকে কাজ। অনেক সময় দেখি আমার অপেক্ষায় থেকে একটা সময় না খেয়ে কন্যা ঘুমিয়ে পড়ছে, চেয়ারে বা বিছানায়। অনেক সময় আমার ক্লান্ত মুখটা দেখে মা আমার বলে, ‘পাপা, আজকে রান্না করতে হবে না, তুমি বিশ্রাম কর, আমি নিজে কিছু করে খাব।’ এ যেন ছোটবেলার স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে ঘর্মাক্ত মুখটা মায়ের আঁচল দিয়ে মোছা।
এমন কন্যা, এমন মা যার ঘরে রয়েছে পৃথিবীতে তার চেয়ে সুখী মানুষ আর কে হতে পারে? আমার মা, আমার শাশুড়ি বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁদের রেখে যাওয়া আদর্শ আমার কন্যার জীবন দর্শনে ফুটে উঠুক। মা দিবসে সবার আশীর্বাদ কন্যার ওপর বর্ষিত হোক। বিশ্বের সব মায়েদের মা দিবসের শুভেচ্ছা।