ওমা গো, সান ডিয়াগো!-দুই

সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য
সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য

এরই মধ্যে একদিন কনফারেন্সের ইচিং–বিচিংয়ের ফাঁকে কয়েকজন মিলে লাঞ্চে বেরিয়েছি। কাছেই রালফস নামের বড়সড় একটা সুপারমার্কেট আছে। স্যান্ডউইচ কিনে চিবোতে চিবোতে ফেরত যাচ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়ল, ফুটপাতে এক উষ্কখুষ্ক লোক কম্বল–টম্বল বিছিয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। তার কোলে হেলান দেওয়া কাগজের সাইনবোর্ডটায় লেখা, ‘আমাকে রালফস থেকে চিকেন উইংস কিনে দিয়ে যাও’। গেরিটকে ইশারা করে বললাম, ‘বস তো দেখছি সেই রকম’। খঁচে থাকা গেরিট গাঁক গাঁক করতে করতে বললেন, ‘কেন, অসুবিধা কী? যা খেতে চায়, পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে।’ একটু দম নিয়ে যোগ করল, ‘আর ওর জায়গায় তুমি হলে তো ঠিকই লিখে রাখতে, আমাকে বাসমতী চালের একথালা ভাত দিয়ে যাও। নইলে চিকেন উইংসগুলো দিয়ে তাড়া করব’। বলেই মুখ টিপে মশকরার হাসি হাসলেন ল্যাবের বাজখাঁই মেজাজের পোস্টডক গেরিট। গালে বিশাল এক কামড় স্যান্ডউইচ থাকায় ঠা ঠা করে হাসতে পারছে না। হায়, আলুখেকো জার্মান এই বাঙালকে ভাতের খোঁটা দেয়!

সেদিন বিকেলেও আমরা চরম খোশমেজাজে ছিলাম। চার কি পাঁচতারা এক হোটেলে আফটার পার্টি হবে। ডিজেসহ। আগ্রহ নিয়ে এসেছি। এসে দেখি ডিজে–ফিজে ঘোড়ার ডিম। লবিতে এক ছোকরা গিটার বাজিয়ে অনুরোধের গান গাইছে। ওদিকে যাদের জন্য পার্টি সেই বিজ্ঞানীদের দঙ্গল ওয়াইন হাতে নিয়ে আমশি মুখে নিঃশব্দে ঘুরপাক খাচ্ছেন। যেন মুখ খুললেই জ্ঞান উবে গিয়ে কলসি খালি হয়ে যাবে। গিটারওয়ালা ছেলেটা খুব আড়ষ্ট ভঙ্গিতে নিচু স্বরে বলে যাচ্ছে, পরের গানে শ্রোতারা কী শুনতে চান। ভেবে দেখলাম, আরে মওকা তো দারুণ! উড়াধুরা ঢিশটিং–ঢিশটিং গান হাতড়াচ্ছি মনে মনে। কিন্তু দেরি হয়ে গেল। গেরিট ততক্ষণে পিংক ফ্লয়েডের একটা ক্ল্যাসিকের নাম চেঁচিয়ে ছুড়ে দিয়েছে। উৎসাহী শ্রোতা পেয়ে ছোকরাও বাজাল জানপ্রাণ দিয়ে। এদিকে আমি তক্কে তক্কে আছি। গান পেয়েছি। গানস ‘ন রোজেস। সুইট চাইল্ড ও’মাইন। ছেলেটা প্রশস্ত হাসিতে জানিয়ে দিল, অনুরোধ তার মনে ধরেছে। এক মুহূর্ত কী ভেবে সে হাওয়াই গিটার নামিয়ে পাশে রাখা ইলেকট্রিক গিটারটা প্লাগ-ইন করে নিল। বয়সে বছর সাত-আষ্টেকের বড় গেরিট অবাক হয়ে বললেন, এ্যাই, তুমি আমাদের সময়ের গান–টান শোনা শিখলে কোত্থেকে? তোমার তো পুরোনো গান বলতে বড়জোর ব্যাক স্ট্রিট বয়েজ আর ব্রিটনি স্পিয়ার্স শোনার কথা। বাঁকা হেসে বললাম, তোমার সমান আমার একটা ভাই আছে। সেই সুবাদে টিনেজ পপ না শুনে ক্ল্যাসিক রক শুনে বড় হয়েছি। শুনে গেরিটের কিছুটা হলেও তাক লেগে গেল। বেশ আমোদ পাচ্ছি। সায়েন্টিফিক আফটার পার্টি ব্যাপারটা একেবারে খারাপ লাগছে না। চলে। পরের ঘণ্টা দুয়েক কলিগদের ওয়াইন গ্লাসের সঙ্গে আমার কোল্ড কফির চিয়ারস চিয়ারস ঠোকাঠুকি আর গানবাজনা—দুটোই চলল সমানতালে।

সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য
সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য

তারপর এক সকালে বহু অপেক্ষার সেই দিন চলে এল। ঠিক হলো উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরেফিরে তারপর সোজা চলে যাব সাগরপাড়ে। বেশ খানিকটা দূরে নাকি দারুণ একটা সৈকত আছে। ভাড়া করা বিশাল গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সবাই। গাড়ির কাচে নাক ঠেকিয়ে দেখি বাইরেটা। দক্ষিণ এশীয় আন্টিরা বেজায় রঙিন সালোয়ার–কামিজের সঙ্গে ধবধবে সাদা কিংবা কটকটে গোলাপি কেডস পরে অলিগলি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। শহরঘেঁষা সাগরপাড়ে অলস সিল মাছ বড় পাথরের গায়ে পেট ভাসিয়ে রোদ পোহাচ্ছে। কী অদ্ভুতই না দেখাচ্ছে দৃশ্যগুলো।

বড় সৈকতটা খুঁজে পেয়ে আমরা হইহই করে নেমে পড়েছি। কী ভেবে চপ্পল জোড়া আঙুলে ঝুলিয়ে নিলাম আমি। বালি ওম ওম গরম। কুসুম কুসুম উষ্ণতায় ছেয়ে গেল মনটা। দলের আর মেয়ে দুজন খুব দ্রুত হেঁটে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে এর ভেতর। টম আর গেরিটও যে যার মতো হেলেদুলে ঘুরছে। একা পড়ে যাওয়াতে আমি এক রকম খুশি। বার কয়েক পানিতে পা ভিজিয়ে ক্ষান্ত দিয়ে বালুর ওপর কায়দা করে ডান হাতে ভর রেখে বাম দিকে এমনভাবে কেৎরে বসেছি যেন সৈকত, সাগর আর ঢেউয়ের একটা অনুভূমিক ছবি পাওয়া যায়।

সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য
সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য

ছবিটা প্রায় তুলে ফেলেছি, আর দুম করে গেরিট ফ্রেমে ঢুকে পড়ল। তা–ও আবার আদুল আদুল খালি গায়ে। শর্টস বাদে বাকি সব তিনি ঢেউয়ের ডগায় রেখে এসেছেন আল্লাহর ওয়াস্তে। যেকোনো মুহূর্তে সেগুলো জলের পেটে চলে যেতে পারে। সেদিকে থোড়াই কেয়ার করে বললেন, সাগরপাড় থেকে তিনি স্লো মোশনে দৌড়ে আসবেন আর আমি যেন পটাপট কটা ফটো খিঁচে দিই। অনিচ্ছাভরে আড়মোড়া ভেঙে আলসেমির বিশাল কুমির হাই তুলে বললাম, ‘এটা তো টমকে বললেই পারতে। আমাকে জ্বালানো কেন?’ কিন্তু টমের দিকে তাকাতেই দেখা গেল তার প্রাগৈতিহাসিক দুই বাই তিন ইঞ্চি ফিচার ফোনটা হাতে নিয়ে তিনি অপরাধী হাসি হাসছেন। এই দিয়ে আর যাই হোক ছবি খেঁচা যাবে না। অগত্যা, আরামের কেৎরে বসা বাদ দিয়ে হাতের ফোনটায় টোকার পর টোকা মেরে গেলাম। পার্টনারকে পাঠানোর জন্য তোলা ছবিগুলো কেমন হয়েছে দেখার আর ফুরসত মিলল না গেরিট মিয়ার। উল্টো দিকে রামদৌড় লাগিয়েছেন ততক্ষণে। পাগলাটে একটা ঢেউ বেসামাল ধেয়ে আসছে। সমুদ্দুরে জামাকাপড় হাতিয়ে নিলে তাকে আদুল গায়েই হোটেলে ফিরতে হবে। কারও কাছে জ্যাকেট নেই। সান ডিয়াগোর আবহাওয়া আজকে খারাপ রকমের ভালো।

পাঁচ

সৈকত থেকে শুরু হওয়া কাঠের ছোট্ট সেতুটা একটুখানি এগিয়েই শেষ হয়ে গেছে। সেতুর মাঝপথে দাঁড়ালে মনে হয় নীল সাগরের একেবারে গহিনে দাঁড়িয়ে আছি। দুপুর হয়ে গেছে দেখে টুকটাক হাবিজাবি খেয়ে নিচ্ছি কেউ কেউ। কারও হাতে এই ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, নয় তো আইসক্রিম। দূরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খেয়ে উড়তে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিসের ধোঁয়া?’ টমের কাছ থেকে উত্তর এল, ‘খবর–টবর পড়া ছেড়ে দিয়েছ মনে হয়? এটা হলো ক্যালিফোর্নিয়ার কুখ্যাত দাবানল। এ বছরেরটা শুরু হলো মাত্র’। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, দু-একটা হেলিকপ্টারের আনাগোনা। আগুন নেভানোর চেষ্টা আর কী। আগুন দেখে বেখাপ্পাভাবে বলে ফেললাম, ‘আচ্ছা, আজকে ওদিকে বনবাদাড় পুড়ছে আর আমরা কপকপিয়ে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাচ্ছি। কেমন যেন রোম পোড়ে, নিরো বাঁশি বাজায় টাইপ হয়ে যাচ্ছে না ব্যাপারটা?’ অনেকগুলো আলু ভাজা একবারে মুখে পুরে দলের বাকিরা রে রে করে উঠলেন, ‘দেখো, ফটকা লোক নিরোর প্যাঁ পোঁর সঙ্গে আমাদের কপকপ মেলাবে না খবরদার। আর আগুন আমরা লাগাইনি। সুতরাং তোমার মন কেমনের গুষ্টি কিলাই’। গুষ্টি কিলানোর হুমকিতে চুপ মেরে গেলাম।

সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য
সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য

তবে চুপ মেরেছিল আরও কয়েকজন। সেতুর এক পাশে তিন চারটি পেলিক্যান। তাদের চেহারায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের গাম্ভীর্য। তাদের পাশে কমলারঙা সাইনবোর্ড পতপত করে উড়ছে। তাতে ছোট করে কী যেন লেখা। কৌতূহলী হয়ে পড়তে গেলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে খটাস ঠোকর! আর্কিওপ্টেরিক্স সাইজের ধুমসো একটা পেলিক্যান মাথা ঠুকে দিয়েছে। দিয়ে আবার জায়গায় মতো ফিরে গিয়ে আধবোজা চোখে ঝিমাচ্ছে। যেন কিছুই হয়নি। এদিকে চোখে সর্ষে ফুল দেখার মাঝেও পেলিক্যানের গুষ্টি কিলাতে কিলাতে লেখাটা পড়ে ফেললাম। ‘প্লিজ, সরে দাঁড়াও। বুনো বাদামি পেলিক্যান। আমরা বেকুব কিসিমের লোকজনকে কামড় দিই...উই বাইট স্টুপিড পিপল’। গা টা অপমানে টং করে জ্বলে গেল। কারণ, কথা অতীব সত্য। কিন্তু ঘটে ঘিলু মিলু যে কিছু নেই, সেটা পাখিগুলো জানল কী করে? যা হোক, মাথা ডলতে ডলতেই দেখলাম, লেখাটা টমের চোখে পড়েছে। খুলে আসা ভারী চশমাটা নাকে এঁটে সেও এদিকে আসছে। আজকে তারও ঠোকর কপাল। ভং ধরে থাকা পেলিক্যানটা আধবোজা চোখ খুলে নড়েচড়ে বসেছে। পরের দৃশ্য দেখার জন্য অপমান ভুলে বাকিদের সঙ্গে ঠোঁট টিপে হাসি আটকিয়ে নিষ্পাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম।

ফেরার পথে সাগরের তাজা হাওয়ায় লাগা খিদের গতি করার জন্য গাড়ি থামাতে হলো। শুধু বেচারা টম কিছুই না খেয়ে হাত গুটিয়ে উদাস বসে থাকলেন। ছোটবেলায় বাদাম দেওয়া কী যেন খেয়ে অ্যানাফাইলাক্টিক শকে পড়ে অ্যাম্বুলেন্স-হাসপাতাল করতে হয়েছিল। সেই থেকে খাবার নিয়ে তার নখড়ার শেষ নেই। একবার চটপটি বানিয়ে ল্যাবে নিয়ে গিয়েছিলাম। অবশ্যই ঝালশূন্য। বিচিত্র নতুন খাবারটা সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে খেলেন। আর টম এসে প্রবল বেগে টেবিলের চারপাশে ঘুরপাক খেতে খেতে বললেন, ‘বাহ্ বাহ্‌, স্যাভরি স্ন্যাকস! ওয়াও, ওয়াও, লুকিং স্ক্রামশাস’। কিন্তু তাকে বাটি-চামচ ছুঁতে দেখা গেল না। এই হলো আমাদের আইরিশম্যান টম। এখানে আসা অবধি সাবওয়ে নামের রেস্তোরাঁ ছাড়া কোথাও তাকে খেতে দেখা যায়নি। তাদের খাবারে নাকি বাদামের ব্যাপার নেই।

সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য
সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য

দেখতে দেখতে সান ডিয়াগোর সূর্যের দিনগুলো ফুরিয়ে এল। আজকে ফেরার দিন। ফ্লাইট ভোররাত চারটায়। মাহদি দায়িত্ববান বন্ধুর মতো দিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু পারল না। তার বদলে ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিল সন্ধ্যায় এসে দেখা করতে এসে। সেই রাতেই তাকে অতি জরুরি একটা এক্সপেরিমেন্ট চালাতে হবে তার ল্যাবে। ক্ষ্যাপা বিজ্ঞানী বলে কথা।

ট্রানজিট আটলান্টায় এসে এবার আর ভয় পেলাম না। বরং একটু ঘুরেটুরেও বেড়ালাম। ঠিক সময়ে মিউনিখের প্লেন খুঁজে নিলাম। পাশের সিট খালি দেখে হাত–পা ছেড়ে দেব দেব করছি। কিন্তু না। কোত্থেকে সাড়ে ছয় ফুট দশাসই এক তরুণ প্রায় দেড়টা আসন দখলে নিয়ে ফেলল। ওদিকে আমি যে চিপায় পড়ে আছি, সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। বিমান ছেড়ে দেওয়ার প্রায় আধঘণ্টা পর তার মুখ ফোটা শুরু হলো। ‘ভাগ্যিস, তুমি শুটকো পটকা আছ। তাই জায়গা নিয়ে বসতে পারছি। হাই, আমি রবার্ট।’ চিপা থেকে চিঁ চিঁ করে নিজের নাম বললাম। এরপরের পাঁচ-দশ মিনিটের আলাপে রবার্ট সম্পর্কে চমক লাগানো তথ্য বেরিয়ে এল। সে এক আফগানিস্তানফেরত আমেরিকান সৈনিক। আমেরিকান ঘাঁটিতে কিছু বছর সৈনিক জীবন কাটিয়ে দেশে চলে গিয়েছিল। তারপর টিভি সাংবাদিকের কাজ নিয়ে আবার ফিরে গেছে সেই আফগান দেশেই। এখন জার্মানি যাচ্ছে ফুটবল খেলতে। জার্মান একদল সাংবাদিকের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ। কিছুটা যেচে পড়ে জানতে চাইলাম, ‘আফগানিস্তান কেমন দেখেছ? যুদ্ধ আসলে কেমন?’ সপ্রতিভ রবার্ট এক মুহূর্ত আনমনা থেকে গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ‘সাধারণ আফগান মানুষ খুব সহজ–সরল। আর ওদের কাবাব খুব মজার।’ বলেই তিনি আচমকা ফুল স্টপ হয়ে গেলেন। বোঝা গেল, এই প্রসঙ্গের আলাপে তার খুব একটা উৎসাহ নেই। আমিও আর প্রশ্ন বাড়ালাম না। তা ছাড়া, যোদ্ধাকে ‘যুদ্ধ কেমন’ জিজ্ঞেস করা বাতুলতা। যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা আর নিষ্প্রয়োজনীয়তা তাদের থেকে ভালো আর কেউ জানে না।

লেখিকা
লেখিকা



ঘুমিয়েই গিয়েছিলাম বোধ হয়। নিজের নাম শুনে সোজা হয়ে বসলাম। কাগজ মিলিয়ে এয়ার হোস্ট ভদ্রলোক বলছেন, ‘হ্লালব্রিনি ফর মিস সারকার’। ‘হ্লালব্রিনি’ বস্তুটি যে কী, বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। পাশ থেকে রবার্ট ধাঁধাটা ভেঙে দিলেন, ‘হালাল খাবার প্রি-অর্ডার করেছিলে মনে হয়। চলে এসেছে তোমার হালাল বিরিয়ানি।’ বাড়িয়ে দেওয়া ট্রে নিলাম। আগুন গরম অ্যালুমিনিয়ামের ভাণ্ড থেকে ভুরভুরে সুঘ্রাণ আসছে। আফগান কাবাবের পাঁড় ভক্ত রবার্ট জুলজুল করে চেয়ে আছে এদিকে। তাকে দেওয়া হয়েছে শুকনো রুটি, মাখন ইত্যাদি অখাদ্য। ভদ্রতা করে হ্লালব্রিনি সাধতে গিয়ে ভুল করলাম। পলকেই বিরিয়ানির অর্ধেকটা তার প্লেটে লাফিয়ে পড়ল। বাকিটা পথ বিরিয়ানির জোরেই কি না জানি না, রবার্টের মুখ চলল তুফান মেলের গতিতে। খাজুরে আলাপের ফাঁপরে পড়ে একবার ঘুমের ভান করলে খুঁচিয়ে উঠিয়ে কফি কাপ ধরিয়ে দিল। নিস্তারবিহীন বিমানযাত্রার পুরোটা রবার্ট নামের মূর্তিমান যন্ত্রণায় অস্থির। মিউনিখে নেমে হাসিমুখে তাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে আসছি, আর কানে ভেসে এল আমেরিকান সৈনিক তার দলের বাকিদের পেয়ে বলছে, ‘উফ্, কী একটা মেয়ের পাশে যে বসেছি, কথা বলে বলে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। কথার মেশিন। খালি পটরপটর আর পটরপটর…’।

মাথা নেড়ে আপন মনে হেসে বাড়ির পথ ধরলাম। (শেষ)

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি।

আগের অংশ পড়তে ক্লিক করুন: ওমা গো, সান ডিয়াগো!