ঐতিহাসিক আন্দালুসিয়া ভ্রমণ

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই বের হলাম স্ত্রীকে নিয়ে। বিমানবন্দরের উদ্দেশে। ২৭ সেপ্টেম্বর সকাল আটটায় ফ্লাইট। বিমানবন্দরে নিরাপত্তা যাচাই শুরু হয় ভোর চারটা থেকে। করোনা উপলক্ষে সময় একটু বেশি লাগে, তাই আগেভাগে বিমানবন্দরে চলে এলাম। ডাবলিন (আয়ারল্যান্ড) থেকে মালাগা (স্পেন)। পৌঁছলাম দুপুর ১২টার দিকে। ফিনল্যান্ড থেকে বাসির ভাই সস্ত্রীক আমাদের ঘণ্টাখানেক আগেই অবতরণ করেছেন মালাগা বিমানবন্দরে। আমাদের পাঁচ দিনের সফরে বাসির ভাই–ই ড্রাইভার।

বিমানবন্দরে বের হয়েই গরমের একটা ধাক্কা খেলাম। মালাগাকার থেকে গাড়ি নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম নের্খার (ইংলিশ নাম Nerja) উদ্দেশে। গাড়ি আগে থেকেই বুকিং দেওয়া ছিল পাঁচ দিনের জন্য। কিন্তু প্রত্যাশিত গাড়ি না থাকায় ওরা গাড়ি আপগ্রেড করে দিল। তাতেই ড্রাইভার মহাখুশি। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকায় সব সময় পিপাসা পেত। মালাগা থেকে ৪৫ মিনিটের ড্রাইভ। নের্খার রিসোর্টে ব্যাগ রেখে দুপুরের খাবার কিনতে বের হলাম বাসির ভাইকে নিয়ে। গাড়ি পার্ক করে বাংলা গান শুনতে পেয়ে একটা রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করলাম। আমি বাংলায় শুরু করলাম। রেস্তোরাঁর দেশি ভাই অপ্রস্তুত ছিলেন, তাই উনি আমার বাংলা কথার জবাব দেননি। পরে ইংরেজিতে শুরু করলাম কথা বলা। তারপর উনি শুরু করলেন বাংলায়। ওনার কাছ থেকে খাবার কিনে রিসোর্টে ফিরলাম। খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিতে গিয়েই নের্খার সূর্যাস্ত দেখতে পেলাম না।

আগের রাতে ঘুম না হওয়ার কারণে বিশ্রাম নিতে গিয়েই মিস করলাম। তারপরও পর্যটন এলাকাগুলোয় কিছুক্ষণ ঘুরলাম আর দুই–একটা স্যুভেনির কিনে রিসোর্টে ফিরলাম। রাতের বেলায় রিসোর্টের বাগানে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনলাম, অসাধারণ।
পরদিন মঙ্গলবার যাত্রা শুরু করলাম গ্রানাডার উদ্দেশে। এক ঘণ্টার বেশি ড্রাইভ। এক দিনের বিরতি এখানে। গাড়ি ৫ নম্বর পার্কিংয়ে রেখে দেখতে গেলাম আলহামব্রা প্রাসাদ। টিকিট অনলাইনে ঠিক করা ছিল। সরাসরি টিকিট কেনা যায় না। ২৬ একর জায়গার ওপর এ প্রাসাদ অবস্থিত। এখানেই ছিল পশ্চিম ইউরোপের শেষ নাসরিড ইসলামিক রাজত্ব। ১৪৯২ সালে অরেগনের রাজা ফ্যার্ডিনান্ড ও ক্যাস্টিলের রানি ইসাবেলা গ্রানাডা জয় করে ইসলামিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্যাথলিক রাজতন্ত্র জারি করেন এবং নাসরিড শাসক ষষ্ঠ মোহাম্মদকে নির্বাসনে দেন। সমগ্র আলহামব্রা প্রাসাদ এলাকা দেখতে প্রায় ৫ ঘণ্টা লাগবে। প্রচণ্ড গরম আর তৃষ্ণার্ত হওয়ায় আমরা বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি। যতটুকু সম্ভব ছিল, ঘুরে দেখেছি। প্রাসাদ খুব সুন্দর নির্মাণশৈলীতে ভরপুর।

আলহামব্রা প্রাসাদের পেছনের দিকে Mirador de San Nicols থেকে সূর্যাস্ত দেখা যায়। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে বের হলাম সূর্যাস্ত দেখতে। গাড়ি না নিয়ে ট্যাক্সিতে করে গেলাম। এবারও মিস করলাম। কারণ, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেল, কীভাবে যাব, তা না জানার কারণে। তারপরও ওই জায়গায় কিছুক্ষণ ছিলাম সন্ধ্যা নামা দেখতে। অসাধারণ দৃশ্য। তারপর বাসে করে ফিরলাম শহর পর্যন্ত। এরপর শহর থেকে পায়ে হেঁটে হোটেলে ফিরলাম। আর আম দিয়ে রাতের খাবার সারলাম। এখানকার আম ইউরোপের সেরা।

পরদিন বুধবার আসল অ্যাডভেঞ্চার শুরু। যাত্রা শুরু করলাম রোন্ডার উদ্দেশে। একবার ভাবলাম, রোন্ডায় না গিয়ে এস্তেপোনায় যাব সরাসরি। বাসির ভাই কী মনে করে রোন্ডার দিকে যাত্রা শুরু করলেন। দুই ঘণ্টার ড্রাইভ। রাস্তার দুপাশে শুধু জলপাইগাছ। রোন্ডায় দেখার কিছুই নেই বলতে গেলে। ছোট শহর। দুপুরের খাবার সারলাম রোন্ডায় সোর্ড ফিশ, ইল আর চিংড়ি মাছ দিয়ে, যা ছিল আমাদের ভ্রমণের সেরা দুপুরের খাবার।

বিকেলের দিকে যাত্রা শুরু করলাম এস্তেপোনার উদ্দেশে। একপর্যায়ে চলতে লাগলাম পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে। দেখতে দেখতে গাড়ি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেল। আঁকাবাঁকা পথ। রাস্তার এক পাশে পাহাড়, আরেক পাশে রেলিং লাগানো। রেলিংয়ের শেষ প্রান্ত থেকে নিচের দিকে একেবারেই খাড়া। আমাদের সামনে একজনকে দেখলাম, মাঝেমধ্যে রাস্তার মাঝখান দিয়ে গাড়ি চালাতে, যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সম্ভবত সে ভয়ে যে পাশ দিয়ে গাড়ি চালানোর কথা, সেই পাশে সব সময় চালায়নি। পাহাড়ের ওপরে উঠে গাড়ি থেমে গেল হঠাৎ কোনো সমস্যা ছাড়াই। ভয় পেয়ে গেলাম সবাই। কারণ, এখান থেকে সাহায্যের জন্য কাউকে কল করলে আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

বাসির ভাই আবার স্টার্ট দিয়ে চালানো শুরু করলেন। সমস্যা হয়নি আর। বুঝতে পারলাম, পাহাড়ে মাঝে মাঝে ম্যাগনেটিক ফিল্ড আছে, যা অবশ্য সাইনবোর্ড দিয়ে সংকেত দেওয়া আছে, যেটা আমরা খেয়াল করিনি প্রথমে। এভাবে পাহাড়ের ওপর বাসির ভাই ৪৩ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়েছেন। খুব দক্ষ চালক না হলে কিন্তু খবর ছিল। এরপর সন্ধ্যার আগে এসে পৌঁছলাম এস্তেপোনায়। যাত্রাবিরতি দুই দিন এখানে।

অসাধারণ একটা রিসোর্টে উঠলাম, যা ছিল একটা পেন্টহাউস যেখান থেকে এস্তেপোনা শহরটি দেখা যায় সূর্যাস্তসহ। রাতের খাবার কেনার জন্য গেলাম মার্কাডোনা গ্রোসারি শপে। কিনলাম সতেজ সামুদ্রিক মাছ। রিসোর্টে রান্না করা হলো। সামুদ্রিক মাছের অসাধারণ স্বাদ।

পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে বের হলাম এস্তেপোনা, ওল্ড টাউন ও সৈকত ঘুরে দেখতে। ওল্ড টাউনের বাড়িগুলোর দেওয়ালে ফুলের টব লাগানো ছিল। সকালে ব্রেড, চুরোস আর কফি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করলাম। এ পাঁচ দিনের ভ্রমণে চুরোস ছিল আমার কাছে সেরা খাবার। দুপুরের খাবার সারলাম সৈকতের পাশে একটা রেস্তোরাঁ থেকে। সামুদ্রিক মাছ হলেও সুবিধার ছিল না খাবারটা। তারপর এদিক–সেদিক ঘুরে দেখলাম। রাতের খাবারে মাছে–ভাতে বাঙালি অবস্থা। ভাত না হলে বাঙালির হয় না। এটা ছিল আমাদের ভ্রমণের সেরা রাতের খাবার। রাতের সৈকত দেখতে আবার বের হলাম। হাঁটতে হাঁটতে সৈকতে গিয়ে সমুদ্রের গর্জন শুনলাম। তারপর আমি আর বাসির ভাই কিছুক্ষণ দাবা খেললাম। এরপর রিসোর্টে ফিরে এলাম।

পরদিন শুক্রবার মালাগার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। এক ঘণ্টার বেশি ড্রাইভ। মার্বেয়াতে (ইংলিশ নাম–Marbella) কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতি করলাম ব্রেকফাস্ট করার জন্য। আবারও চুরোস। চুরোস খেয়ে কিছুক্ষণ এদিক–সেদিক দেখলাম মার্বেয়াতে। অনেক পর্যটক এসেছেন বিভিন্ন দেশ থেকে। কিছুক্ষণ পর আবার মালাগার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম।

মালাগায় এসে গাড়ি পার্কিং করে দুপুরের খাবারের জন্য বের হলাম। উদ্দেশ্য স্পেনের বিখ্যাত পায়েলা খাওয়া। এটা ভাত আর সামুদ্রিক মাছ দিয়ে তৈরি করা হালকা মসলাযুক্ত খাবার। দোকানিরা মনে হয় তাড়াহুড়া করতে গিয়ে লবণ বেশি দিয়ে দিল।

দামে আর মানে এক হলো না। সঙ্গে ছিল অক্টোপাস আর স্কুইড। তারপর গেলাম শপিং মলে। অসংখ্য মানুষ। সবাই কেনাকাটায় ব্যস্ত। রাত ৯টার দিকে রুমে ফিরলাম। ১১টায় আবার বের হলাম রাতের খাবারের জন্য, কিন্তু সব দোকান বন্ধ। একটা কাবাব শপ খোলা ছিল। কাবাব খেতে গিয়ে বুঝলাম, এখানেও লবণ বেশি। পরদিন শনিবার সকাল ৯টায় ফিরতি ফ্লাইট। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ভোর ছয়টায় বের হলাম মালাগা এয়ারপোর্টের উদ্দেশে। বাসির ভাইয়ের ফ্লাইট বিকেল চারটায়। ফিনল্যান্ডের বাইরে বাসির ভাইয়ের ড্রাইভিং এই প্রথম, কিন্তু এই পাঁচ দিনে তা মনে হয়নি। ভালোই চালাতে পারেন।

স্পেনে এটা আমার দ্বিতীয় ভ্রমণ। প্রথমে গিয়েছিলাম বার্সেলোনায়। স্পেনের আন্দালুসিয়া (মালাগা > নের্খা > গ্রানাডা > রোন্ডা > এস্তেপোনা > মার্বেয়া > মালাগা)— ভ্রমণে এই পাঁচ দিনে যা বুঝলাম, তা হলো, আন্দালুসিয়া অনেক সুন্দর। ইউরোপের দেশগুলো সাধারণত ঠান্ডা আর সূর্যের আলো অনেক কম দেখা যায়। কিন্তু স্পেন অনেক গরম আর সব সময় সূর্যের আলো থাকে, যা এদের জন্য বিশাল একটা আশীর্বাদ। সূর্যের আলোর কারণেই এখানকার ফলমূল ইউরোপে বিখ্যাত। আর এ কারণেই স্পেনে অনেক পর্যটক আসেন প্রতিবছর। এখানকার রাস্তাঘাটগুলো পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন আর হাইওয়েগুলো অনেক বিশাল, যা ইউরোপের অনেক দেশেই নেই। আর আমরা ক্যামেরায় ছবি তুলে যে সৌন্দর্য ধারণ করতে পারি, তা হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। এককথায়, সব সৌন্দর্য নিজের চোখে উপভোগ করতে হয়।

যাঁরা আন্দালুসিয়ায় ভ্রমণে যাবেন, তাঁদের জন্য কিছু পরামর্শ:

১.
যাঁদের নিজের গাড়ি নেই, তাঁরা মালাগাকার থেকে বুকিং দিতে পারেন।
২.
সব সময় খাওয়ার পানি সঙ্গে রাখবেন। প্রচণ্ড গরম থাকায় সব সময় পিপাসার্ত থাকতে হয়।
৩.
পার্কিং একটা সমস্যা। হোটেল বা রিসোর্টগুলায় পার্কিং না–ও থাকতে পারে। ফ্রি পার্কিং নেই বললেই চলে। তবে পেইড পার্কিং আশপাশে পেয়ে যাবেন।
৪.
গ্রানাডায় আলহামব্রা প্রাসাদ দেখতে চাইলে আগে থেকেই অনলাইনে টিকিট ঠিক করে রাখবেন। আর গাড়ি নিয়ে গেলে এক নম্বর পার্কিংয়ে রাখবেন। পাঁচ নম্বর পার্কিংয়ে রাখলে প্রচুর হাঁটতে হবে।
৫.
রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে স্টার্টার হিসেবে কিছু খাবার দিলে দোকানিকে জিজ্ঞাসা করে নেবেন, দাম আলাদা না একসঙ্গে। অর্ডারের বাইরে ওরা স্টার্টার ধরিয়ে দিয়ে বাড়তি বিল ধরিয়ে দেবে।
৬.
তাজা সামুদ্রিক মাছের জন্য বিখ্যাত আন্দালুসিয়া। তাই চাইলে গ্রোসারি শপ (মার্কাডোনা, ক্যারেফোর) থেকে মাছ কিনে রিসোর্টে গ্রিল বা রান্না করে খেতে পারেন। এখানে ফলের দামও অনেক কম, তার ওপর টাটকা।