এবং একজন হাবু মিয়া

ছবি: সংগৃহীত

খুবই সহজ–সরল মানুষ হাবু মিয়া। মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়ায়। সাদামাটা জীবন। লেখাপড়া খুব একটা করতে পারেনি। ম্যাট্রিক দিয়েছিল। কিন্ত চাকরি মিলছে না। মা–বাবা নেই। চাচা–চাচির কাছে মানুষ হয়েছে। পৈতৃক ভিটাতে একচালা টিনের ঘরে জীবন যাপন করছে। প্রতিদিন কাজের সন্ধানে বের হয় হাবু। কিন্তু কেউ তাকে কোনো চাকরি দেয় না। একদিন রাস্তায় বাল্যবন্ধু শরীফের সঙ্গে দেখা হয়। শরীফ স্কুলে পড়ার সময় হাবুকে অনেক জ্বালাত। একজন অহংকারী মানুষ সে। শরীফ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। একদিন তাকে অফিসে ডাকে। হাবুকে সে উপহাস করে একটি চাকরি দেয়। চাকরি হলো, প্রতিদিন বাতাস গণনা করতে হবে। মাসে বেতন ১৫০ টাকা। হাবু শরীফের কথায় রাজি হয়। কারণ, সে আর বেকার থাকতে চায় না।

হাবু নতুন চাকরি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর তাই প্যান্ট–শার্ট, গলায় টাই, চোখে কালো চশমা পরে, বড় অফিসারের মতো ভাব নেয়। এবং চেয়ার–টেবিল নিয়ে রাস্তার পাশে বসে যায়। হাবু মিয়া পায়ের ওপর পা তোলে বসে বাতাস গণনা করছে, আর টেবিলের ওপর খাতায় লিপিবদ্ধ করছে। রাস্তা দিয়ে আসা–যাওয়া করছে অসংখ্য রিকশা, অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন। চালকেরা হাবু মিয়াকে দেখে ভাবে, সরকারি বড় কোনো অফিসার বোধ হয়। অনেকে তার সঙ্গে ভয়ে কথা বলে না। একদিন এক অটোরিকশার চালক বলে, ‘স্যার, এখানে কী করেন?’

হাবু মিয়া উত্তর দেয়, ‘কথা বলবেন না। আমার কাজের সমস্যা হবে।’
চালক হাবু মিয়ার লেখা দেখে ভাবে, মনে হয় বড় কোনো ইঞ্জিনিয়ার। হায় হায় আমাদের গাড়ি চালানো বন্ধ করে দেবে না তো! এই ভেবে ওই চালক অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে। পরদিন চার–পাঁচজন মিলিত হয়ে হাবু মিয়ার কাছে যায়। এক প্যাকেট সিগারেট ও হাজার তিনেক টাকা দিয়ে বলে, ‘স্যার, দয়া করে আমাদের উপহারগুলো রাখুন।’

ছবি: রয়টার্স

হাবু মিয়া না নিতে চাইলে জোর করে টাকাগুলো হাতে তুলে দেয়। হাবু মিয়া বলে, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি না হয় আপনাদের উপহারগুলো নিলাম কিন্তু একবার বলুন তো এইগুলা কেন দিচ্ছেন?’

‘স্যার, আমরা গরিব মানুষ, গাড়ি চালিয়ে আমাদের জীবন চলে। দয়া করে আমাদের কোনো সমস্যা যেন না হয়।’

হাবু বুঝতে পারে, ওরা হাবুকে বড় কোনো অফিসার ভেবেছে। অসুবিধা কোথায়, এই সুযোগে যা কামাতে পারি। এই ভেবে হাবু বলে, ‘ঠিক আছে আপনারা এখন যান, আমার বাতাস গণনাতে প্রবলেম হচ্ছে।’

বাতাস গণনার কথা শুনে লোকজন অবাক হয়। এটা কী বলে!
হাবু প্রতিদিন ড্রাইভারদের কাছ থেকে অনেক টাকা পায়। এভাবে হাবুর ভালোই চলছে। মনে মনে হাবু অনেক আনন্দিত।

হাবু গ্রামের মধু ব্যাপারীর একমাত্র মেয়েকে পছন্দ করে। মাঝেমধ্যে মধু ব্যাপারীর মেয়েকে দেখতে আসে। মেয়েটির নাম হাসনাহেনা। আজ হাসনাহেনাকে হাবু দেখতে এসেছে। হাসনাহেনা হাবুকে হাবলা বলে ডাকে। এতে হাবুর কষ্ট হলেও কিছু বলে না। ভেতরে ভেতরে হাসনাহেনাও হাবুকে পছন্দ করে। কিন্তু সেটা হাবুকে বুঝতে দেয় না। আজ হাসনাহেনার জন্য দুটি কানের দুল এনেছে হাবু। হাসনাহেনা দুল দেখে অবাক হয়। খুশিতে বলে, ‘এটা তো দেখি সোনার দুল।’

আজ আর হাবুকে হাবলা না ডেকে বলে, ‘হাবু ভাই তুমি এটা কোথায় পেলে?’
হাবু বলে, ‘এটা আমি তোমার জন্য এনেছি।’
‘কী ব্যাপার হাবু ভাই, তুমি কি আমাকে ভালোবাস?’
‘কেন তুমি বুঝ না।’

‘বুঝলাম তুমি আমাকে ভালোবাস। ভালো যখন বেসেই ফেলেছে, নাও আমার হাত ধরো। নাকি আরও কিছু ধরবা।’
বলেই হাসনাহেনা হাবুর খুব নিকটে আসে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হাবু লজ্জায় মুখ নিচু করে। হাসনাহেনা জানে হাবু একটা চাকরি পেয়েছে। হাবুর কাছে জানতে পারে, হাবু বাতাস গণনার চাকরি পেয়েছে। এটা শোনে হাসনাহেনার কী হাসি!
একদিন শরীফ মিয়া হাবুকে ডেকে বলে, ‘তোমার চাকরি শেষ।’
হাবু বলে, ‘কেন? আমি কি কোনো ভুল করেছি। আমি তো আপনার কথামতো বাতাস গণনার কাজটা ঠিকঠাকমতো করছিলাম। এই নিন ফাইল দেখুন। সব ঠিকঠাক আছে কি না দেখুন।’
‘না, ওসব দেখতে হবে না। তুমি চলে যাও।’
‘প্লিজ স্যার, আমার চাকরিটা খুব প্রয়োজন।’

শরীফ মিয়া হাত ইশারা দিয়ে বলে চলে যেতে। হাবু নিরুপায় হয়ে চলে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই শরীফ হাবুকে ডেকে নতুন আরেকটি চাকরি দেয়। ‘এখন থেকে তুমি নদীর ঢেউ গণনা করবে। এটাই তোমার চাকরি। বেতন মাসে ২৫০ টাকা।’

এটাতেও হাবু রাজি হয়ে যায়। এমনকি পরদিন নদীর ঢেউ গণনা করতে বেরিয়ে পড়ে। সেখানেও একই অবস্থা হয় হাবুর। লঞ্চের ছাদে বসে ঢেউ গণনা করছে। হাবুর ভাবসাব দেখে সব লঞ্চচালক জেলে হাবুকে সম্মান করে। এবং ভয়ে টাকাপয়সা দিতে থাকে। একদিন শরীফ মিয়া লঞ্চঘাটে গেলে দেখে হাবুকে সবাই সম্মান করছে। সে তো অবাক হয়ে ফিরে আসে। মনে মনে অনেক কষ্ট পায় শরীফ মিয়া। পরে একদিন হাবুকে ডেকে বলে, ‘তুমি এমন কী করো, যে মানুষ তোমাকে এত সম্মান করে।’

‘আমি কী করব বলেন, যা সত্য আমি তাই বলি।’
শরীফ মিয়া এই চাকরিটাও নট করে দেয়। এবং বলে, ‘আজ থেকে তুমি ইঁদুরের গর্ত গণনা করবে। বেতন মাসে ৩৫০ টাকা।’
হাবু এটাতেও রাজি হয়ে যায়।

এখন হাবুর মোটামুটি কিছু টাকাপয়সা হয়েছে। হাসনাহেনাকে বিয়ে করে হাবু। হাসনাহেনাকে বলে, ‘বাতাস গণনা, নদীর ঢেউ গণনার পর এবার বের হব ইঁদুরের গর্ত গণনার জন্য। আর এটাই হলো আমার চাকরি।’
হাবুর কথা শোনে হাসনাহেনা হাসে। হাসনাহেনার সুন্দর মুখের হাসিতে পুরো ঘর আলোকিত। এবার হাবু একজন সহকারী নিল। সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে কাজে নেমে যায়। অন্য এলাকায় ইঁদুরের গর্ত গণনা করছে। হাবু মিয়ার ভাব দেখে মানুষ মনে করে সে বড় কোনো অফিসার। বড় বড় বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে বলে, ‘আপনার বাড়ি সরাতে হবে। আমি ইঁদুরের গর্ত গণনা করব।’

বাড়ির মালিক সহকারীকে ডেকে বলে, ‘কী ব্যাপার উনি বলছে কী?’
সহকারী বলে, ‘কিছু টাকা থাকলে দিয়ে দিন। তা না হলে উনি কিন্তু সত্যি সত্যি আপনার বাড়ি ভেঙে সরিয়ে ইঁদুরের গর্ত গণনা শুরু করবে।’

মালিক কিছু টাকা দিয়ে দিলে ওরা চলে আসে। প্রতিনিয়ত ইঁদুরের গর্ত গণনা করতে থাকে। একদিন শরীফের বাড়িতে ডুকে যায়। শরীফ হাবুকে বলে, ‘হাবু তুমি এখানে!’
হাবু বলে, ‘বস, আমি এসেছি আমার ডিউটি করতে।’
‘মানে কী?’

হাবুর সহকারী বলে, ‘মানে অতি সোজা, আপনার বাড়িটা এখান থেকে সরাতে হবে। আমরা ইঁদুরের গর্ত গণনা করব।’

শরীফ ভুরু কুঁচকে বলে, ‘এসবের মানে কী হাবু?’

‘মানিটানি বুঝি না। আমার দায়িত্ব পালন করব। তোর ঘরটা সরা। আমি ইঁদুরের গর্ত গণনা করব।’

শরীফ মিয়া হাবুকে দমক দিতে চাইলে হাবু শরীফকে কষে একটা থাপ্পড় মারে। এবং বলে, ‘তুই আমার বস। তবে এখানে না অফিসে বস। এখানে আমি যা বলি তাই হবে। এখন বলছি যা, তাই করবে। তা না হলে...। হাবু শরীফের কাছ থেকেও টাকা নেয়। তারপর হাসতে হাসতে সহকারীকে নিয়ে চলে আসে।

হাবু এখন অনেক টাকার মালিক। বউ নিয়ে শহরে চলে যায়। একদিন এক পুলিশ অফিসার বাড়িতে ইঁদুরের গর্ত গণনা করতে গিয়ে ধরা খায়।
*এম হৃদয়, সিঙ্গাপুর