এখনো বিলকিসের কাছে দেশই আগে

বিলকিস জাহান চৌধুরী

কিছু বরেণ্য রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী তাদের জীবনের দীর্ঘ ও মূল্যবান সময়টুকু রাজনীতি ও মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম দূরের কথা, খোদ আমাদের প্রজন্মের বেশির ভাগই জানেন না তাদের কীর্তিগাথা। বিলকিস জাহান চৌধুরী তাদেরই একজন। তিনি বিলকিস সরদার নামেও পরিচিত।

বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের দিরাই শহরের জন্ম নেন বিলকিস। ভাদেশ্বর সরকারি হাইস্কুল থেকে মেট্রিক ও সিলেট মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্নাতক করেন।

বিলকিস সরদার একাধারে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী ছিলেন। যৌবনে পড়াশোনার পাশাপাশি রাজপথে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ সর্দারের সহধর্মিণী তিনি।

বর্তমানে টেক্সাসের হিউস্টন বসবাস করছেন বিলকিস সর্দার। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় বামপন্থী রাজনীতিতে। বয়স বেড়েছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সন্তানের সঙ্গে প্রবাসী হয়েছেন। এখনো মনেপ্রাণে ধারণ করেন প্রগতিশীল রাজনীতির ধারা। সবার জন্য সমান সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বাস করেন তিনি।

যৌবনে বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবিত বিলকিস সর্দার আলাপচারিতায় বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি সেই রাজনৈতিক অবস্থান বা কর্মকাণ্ড, যা সামাজিক অসাম্য ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সামাজিক সাম্যকে সমর্থন করে। তিনি মনে করেন, সমাজে অসাম্য অবিচার কমানো বা দূর করার জন্য আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করে যেতে হবে। এ লড়াই চলমান। লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

বিলকিস সর্দার উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধসহ গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবাধিকার ও প্রগতিশীল সব আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক ছিলেন।

বিলকিসের বাবা ছিলেন পাকিস্তান আমলের এসপিও। ১৯৬৫ সাল থেকেই চট্টগ্রাম কলেজে পড়াকালে বিভাগীয় ছাত্র ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক থেকে সভানেত্রী হয়েছেন। তখন যাকে বলা হতো ইউএসপিপি ছাত্র ইউনিয়ন। হালিম চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান, মতিয়া চৌধুরী, পীর হাবিবুর রহমানসহ অনেকের সঙ্গেই রাজনীতির মাঠে সরব ছিলেন। রানা দাস গুপ্তের সঙ্গে সে সময়ে মিছিল–মিটিং করেছেন। রবীন্দ্র সংগীত বন্ধ করা হলে শহীদুল্লাহ কায়সারের নেতৃত্বে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন।

রাজনীতি বিলকিস সর্দারের রক্তে মিশে আছে। তবে বাবা সব সময় রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইতেন। রাজনীতি ভালো লাগত বলে বাবা জোর খাটাতে পারতেন না। তা ছাড়া সে সময়ে রাজনীতি প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিল না।

স্মৃতি ঞঅথঢ়ৈ বিলকিস সর্দার বলতে থাকেন, ‘আমরা এখনকার মতো মারামারি, কাটাকাটির রাজনীতি দেখিনি। যুদ্ধের আগে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির মাঠ উত্তাল ছিল। এখনকার মতো এমন সহিংসতা হয়নি তখন। দেশ বা দল থেকে আলাদা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য রাজনীতি করিনি কোনো দিন।’

বিলকিস সর্দারের ছোট ভাই বাম ঘরানার রাজনৈতিক সংগঠক লুৎফুর চৌধুরী। রাজনীতি থেকে যেন সরে যেতে না হয়, রাজনৈতিক সহকর্মী পীর হাবিবুর রহমান ও কমরেড বরুণ রায়সহ দলের সবাই মিলে তাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী অন্য এক মেধাবী সহকর্মী আবদুল লতিফ সরদারের সঙ্গে ১৯৬৯ সালে তাঁর বিয়ে দেয়।

রাজনীতি ও পার্টির স্বার্থে কমরেড বরুণ রায় মূলত পার্টির লোকের সঙ্গেই বিলকিসের বিয়ে ঠিক করেন। তাই রাজনীতি করতে আর কোনো সমস্যা তো হয়নি বরং স্বামী তাকে সাহস ও উৎসাহ জুগিয়েছেন।

বিয়ের পর পড়াশোনা শেষ করেছেন। ১৯৭১ পরে স্বামী আবদুল লতিফ সরদার একদল মুক্তিবাহিনী নিয়ে ভারতের বালাটে, সি আর দত্তের অধীনে যুদ্ধে চলে যান। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। স্বামী যুদ্ধে গেলেন। পাকিস্তানি সেনারা সেই সময়ের ছবি হাতে নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিলকিস সরদারকে খুঁজেছে। যুদ্ধের সময় সন্তানদের নিয়ে গ্রামান্তরে পালিয়ে থাকায় তাঁকে খুঁজে পায়নি পাকিস্তানি বাহিনী।

বিলকিস সরদার শিক্ষকতাও করেছেন। পাশাপাশি সিলেট বেতারে শিশু বিষয়ক অনুষ্ঠান কিশলয় নামে টানা ৩০ বছর উপস্থাপনা করেছেন। গ্রাম বাংলার কৃষি ও প্রতি শুক্রবারের সিলেট বেতারে মহিলা বিষয়ক পরিবার পরিকল্পনা অনুষ্ঠান কৃষাণী নামে অনুষ্ঠান পরিচালনা ও উপস্থাপনার কাজ করেছেন। এ ছাড়া টেলিভিশনে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় নাটকে অভিনয় করেছেন। পরিবার পরিকল্পনা সমিতির আজীবন সদস্য, সিলেট লাইনস ক্লাবের আজীবন সদস্যসহ কলেজে পড়ার সময় থেকে সিলেট ক্রীড়া সংস্থার সদস্য ছিলেন।

বিলকিস সর্দার জীবনের এই পর্যায়ে এসেও দেশের খবর রাখেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান, নারীদের সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য।

বর্তমানের মেয়েদের উদ্দেশ্য বিলকিস সর্দার বলেন, মেয়েদের মন দিয়ে পড়াশোনা ও সৎভাবে চলা উচিত। বর্তমানে নৈতিক অবক্ষয় চরমে। রাজনীতির পথ এখন অনেক নোংরা। তাই অবস্থা পরিবর্তনের কারণে নিজের মেয়েদের রাজনীতি করতে দেননি তিনি। তিনি বলেন, ‘নিজে রাজনীতি করেছি, তবে সন্তানদের রাজনীতিতে জড়াতে দিইনি।’

বাংলাদেশ হওয়ার আগে দেওয়ান ফরিদ গাজীর বাসায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রথম দেখার স্মৃতি তর্পণ করেন। ১৯৬৫ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয় ন্যাপের ১০ম সম্মেলনে। জেনারেল এম এ জি ওসমানী, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, তোফায়েল আহমদসহ রাজনীতির লোকজনের সঙ্গে সর্দার দম্পতির পারিবারিক সম্পর্ক ছিল।

১৯৯১ সালে বিলকিস সর্দারের স্বামী মুক্তিযোদ্ধা আবদুল লতিফ সর্দার আদালতে কর্মরত অবস্থায় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। মুক্তিযোদ্ধা স্বামী জীবিত থাকাকালেও কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেননি। বিলকিস সর্দার একটা মুক্তিযোদ্ধ সনদ নিতে অনুরোধ করেছিলেন স্বামীকে। তখন তিনি বলেছেন, ‘দেশের জন্য কাজ করেছি, এখন কার কাছ থেকে সনদ নেব আর কেনইবা সনদ নিতে হবে।’

যুদ্ধফেরত স্বামীর কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কিসের বিনিময়ে যুদ্ধ করেছ?’ তিনি তখন নিশ্চুপ থেকেছেন। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেন এক বছরের মধ্যে নিজের কোনো খবর দাওনি এবং আমাদেরও কোনো খবর নাওনি?’ তিনি এক বাক্যে উত্তর দিয়েছেন, সেই পরিস্থিতিতে পরিবারের কথা একবারও মনে হয়নি।

খাঁটি দেশপ্রেমিক ছিলেন স্বামী লতিফ সর্দার। কথাটি বলে কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন বিলকিস সর্দার।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও নিজেকে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ার কাজে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন নারীনেত্রী বিলকিস সরদার।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের শিকার নারীদের পুনর্বাসন ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় কাজ করেন তিনি। শুরু থেকেই বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রথমে ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সহসাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে থাকলেও দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখেন বিলকিস সর্দার। যে দেশের জন্য নিজেরা লড়াই করলেন, নিজের তিন সন্তানই এখন সে দেশে নেই। আক্ষেপ করে কথাটি বললেও বিলকিস সর্দার বলেন, তাঁর সন্তানেরা অন্যান্য প্রবাসীর মতোই বাংলাদেশকে বুকে ধারণ করে।