এক দশকের বিচার
জাপান এক শান্তির জনপদ। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত, উন্নয়নশীল আর অনুন্নত দেশগুলোতে যখন চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি, খুন-ধর্ষণ আর দুর্যোগ-দুর্ঘটনা অনেকটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তখন জাপানের পত্রপত্রিকার শিরোনামে থাকে নতুন আবিষ্কার, অর্জন, উদ্যোগ আর সম্ভাবনার কথা। একটা দেশের মানুষের কী পরিমাণ পরিশ্রম, ত্যাগ, নিয়মানুবর্তিতা আর দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকতে পারে, জাপানিদের না দেখলে বিশ্বাস হবে না। খুবই স্বাভাবিক যে বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিভীষিকা কাটিয়ে উঠে জাপান আজ বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি, আমাদের বাংলাদেশেরও উন্নয়ন অংশীদার, অকৃত্রিম বন্ধু। কয়েক দিন আগে সকালের জাপানি কাগজে একটা খবর দেখে চমকে উঠলাম। ‘৮০ বছরের বুড়োর মৃত্যুর ঘটনায় স্কুল বালকের বাবা-মার ১৫ মিলিয়ন ইয়েন জরিমানা।’ খুলেই বলি-
২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা। এহিমে জেলার ইমাবারি শহরের এক প্রাইমারি স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলছিল ১২ বছরের বালক। খেলার গোলবার স্কুল গেটের পাশেই। ছেলেটি যখন গোলে বল মারে, গেটের পাশের রাস্তায় মোটরবাইক চালিয়ে যাচ্ছিলেন ৮০ বছরের এক বৃদ্ধ। বল গেট পেরিয়ে বাইরে চলে আসে আর বল এড়াতে গিয়ে বৃদ্ধ পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেন। না, তিনি মারা যাননি, হসপিটালাইজড হন। ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু ঘটনা শুরু হয় এখান থেকেই।
দুর্ঘটনা-পরবর্তী ট্রমা থেকে বৃদ্ধ তাঁর স্মৃতি হারাতে (ডেমেন্তিয়া) শুরু করেন আর দেড় বছরের মাথায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বৃদ্ধের পরিবার ক্ষতিপূরণের মামলা করে বসে ওসাকা ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে। তাদের দাবি, বালকের পরিবার ছেলের ওপর যথেষ্ট নজরদারি করেনি, সাবধানতার সঙ্গে খেলার পরামর্শ দেয়নি। বিতর্ক জমে উঠে-
-নিউমোনিয়ার সঙ্গে পা ভাঙার সম্পর্ক কী?
-স্মৃতি হারাতে শুরু করে ঘটনার কত দিন পর থেকে?
-কোনটা বেশি বিপজ্জনক, স্কুলে বালকের ফুটবল খেলা, নাকি ৮০ বছরের বৃদ্ধের মোটরবাইক চালানো?
-পা ভেঙে শয্যাশায়ী থাকার কারণেই কি অন্যান্য সমস্যার (ডেমেন্তিয়া, নিউমোনিয়া) সূত্রপাত?
ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের বিচারক রায় দেন শেষ যুক্তিতে। জরিমানা ৫০ মিলিয়ন ইয়েন। বালকের পরিবার ওসাকা হাইকোর্টে আপিল করে যে, তারা ছেলেকে সাবধানতার সঙ্গে খেলাধুলা করার ব্যাপারে যথেষ্ট শিক্ষা দিয়েছে, নজরদারিও ছিল। কিন্তু এবারও রায় তাদের বিপক্ষে গেল। তবে জরিমানা কমে হয় ১৫ মিলিয়ন। আবারও বিতর্ক-
-আইনে কোনো সমস্যা আছে নিশ্চয়!
-বালকের পরিবার মনে হয় যথেষ্ট ভালো আইনজীবী নিয়োগ করেনি!
-৮০ বছরের বৃদ্ধের মোটরবাইক চালানোর ব্যাপারটাও ভাবতে হবে!
-সেই ছেলে আজ ২৩ বছরের যুবক, ১০ বছরেরও বেশি সময় সেও তো অনেক ভুগেছে!
মামলা এইবার জাপানের সুপ্রিম কোর্টে। রায়ের তারিখ ৯ এপ্রিল। সবাই চেয়ে আছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা এই মামলার রায়ের দিকে। রায় যা-ই হোক, সবাই বলাবলি করছে যে, স্কুল গেট বরাবর গোলবার বসানোর আইডিয়াটা যার মাথা থেকে এসেছে, তারই তো বেশি দায়ী হওয়া উচিত। দেখা যাক!
(লেখক পিএইচডি গবেষক, কিয়ুশু বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান)