বিদেশে গতানুগতিক জীবন সবাই যাপন করেন; কিন্তু যখনই কিছু ব্যতিক্রম হয়, তখন বুঝতে হবে সেখানে কোনো আশীর্বাদ আছে। অনেকে বলেন পয়সা পকেটে থাকলে সুখ কেনা কোনো ব্যাপার না। সে অর্থে সুখ কেনার মতো পয়সা যদি হয় তখন দেখা যায় সময় নেই, ছুটি পাওয়া মুশকিল। মেয়ের স্কুল বন্ধ, শীতকালীন ছুটি, কিন্তু আমি “ফুলটাইম” কামলা। সুখে একটু টান পড়ে আমার মতো যারা একান্ত একাকী বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকেন। অনেক দিনের বিদেশবাসে ইদানীং পার্টি প্রোগ্রামেও আকর্ষণ হারিয়েছি। আজকাল সেখানেই যাই যেখানে দেখি অন্তর থেকে মায়া নিয়ে কেউ ডাক দিয়েছেন।” শো অব আর গিভ অ্যান্ড টেক”-এর এই দুনিয়ায় এখন খাঁটি মায়া-মমতা পাওয়া বড়ই দুর্লভ। বছর শেষে এ-রকম এক আশীর্বাদ পেলাম।
সে কাহিনি পরে বলছি, তার আগে একটু পেছনের কথা বলে নিই। সাধারণভাবে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ভাগ্যের ফেরেই বোধ করি অসুখ-বিসুখ বা চাকরি নিয়ে ঝামেলা হয়। যেমন দেশে থাকা কালে এক ডিসেম্বরে চিঠি এসেছিল সিলেট থেকে সুদূর রাজশাহীতে ট্রান্সফারের! সে বড় লম্বা ইতিহাস। সে কথা থাক। আগের বছর সামান্য ভুলের জন্য আমার চাকরির আইডির মেয়াদ চলে গিয়েছিল। ২০১৭-তেও যেন এ নিয়মের ব্যতিক্রম হলো না, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লাম।
“তনু হাই তনু ভাই তনু গেলু কিছু নাই”—এটা ছিল আমার নানির কমন ডায়ালগ। তিনি একটু কুঁজো হয়ে হাঁটতেন। তাঁর মতো আমিও মাঝে মাঝে এই সংলাপ মনে মনে আওড়াই। কারণ, আশপাশে একগাদা নাতি-নাতনি নেই তো যে তাদের শোনাব! আমি কুঁজো বুড়ির মতো না হাঁটলেও ঠান্ডায় এক পায়ে তীব্র ব্যথা নিয়ে হাঁটি। উল্লেখ্য, চেন্নাই অ্যাপোলো হাসপাতালের ডাক্তাররা আমার পা থেকে একটা হাড় কেটে এনে হাতে গ্রাফট করেছেন, তাই আবহাওয়ার তারতম্যে এই সমস্যা। এমতাবস্থায় আমি যখন, ‘জিয়েতো জিয়ে ক্যায়সে বিন আপ কি’ হিন্দি গানটার ভিডিও দেখি-শুনি তখন আমার মনে হয়, কবে জানি আমিও ক্রাচে ভর দিয়ে কবি সাগরের মতো এই গান গাইব।’ তওবা তওবা ‘কারণ আমাকে সময়ের সঙ্গে তাল দিয়ে অন্তত এক শ মাইল স্পিডে দৌড়াতে হয়। যাই হোক, এটা খুব সাধারণ বিষয় আমার জন্য। যত দিন বাঁচব এভাবেই চলতে হবে আমাকে। সমস্যা হচ্ছে, প্রায় নয় দিন ধরে ঠান্ডার থাবায় আমি একেবারে অচল না হলেও অচলপ্রায়। জানুয়ারি ফেব্রুয়ারির স্নোবিলাস দেখা বাকি থাকতেই আমার করুণ অবস্থা। ঠান্ডার দেশে ঠান্ডা লাগবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যত্ন করে সাবধানে চললে লাগে না। মজা করে খেয়েছিলাম ঝাল শুঁটকি তরকারী, সঙ্গে নাগা মরিচ। ডেজার্ট খাওয়া জরুরি ছিল, সে দিন সে রকম কিছুই ছিল না শুধু আইসক্রিম ছাড়া। রাতে আবিষ্কার করলাম সাইনাস অতিমাত্রায়, এবং জ্বর। প্রাথমিকভাবে আইবোপ্রুফেন ট্যাবলেট খেলাম। পরদিন বুধবার ছিল আমার সাপ্তাহিক ছুটি। ঘরের প্রয়োজনীয় কাজ তো করতে হবে! বাজারসদাই করতে গিয়ে সুপার মার্কেটের ফ্রিজ খুলে জিনিসপত্র নিতে নিতে শরীরে আরও কিছু ঠান্ডা প্রবেশ করেছে। ঘরদোর পরিষ্কার করতে হলো—সব মিলিয়ে কাহিল অবস্থা! যথারীতি শুক্রবার কাজে গেলাম। সে রাত থেকে অবস্থা হলো করুণতর। দু’দিন কাজে গেলাম না, রেস্ট নিলেও কোনো উন্নতি হলো না। সাইনাসের সঙ্গে ভয়ংকর গলা ব্যথায় দু রাত ঘুমাতে পারিনি। অবশেষে কুইন্স হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গেলাম, টেস্ট করল ওরা। জানা গেল ধরা খেয়েছি সামান্য অতি ক্ষুদ্র কোনো ভাইরাসের কাছে। ওষুধ দিলেও তেমন উন্নতি হলো না। তিন বছর পর জ্বর হয়েছে। অসুস্থ হয়েও মনে মনে খুশিই হয়েছিলাম, কারণ এই অছিলায় মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে পারছি ঘরে।
এমতাবস্থায় বৃহস্পতিবার হঠাৎ ফোন এল, ফ্লোরা ভাবি ঈশায়াকে নিয়ে ওনার বাসায় নাইওর যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। আমার মনে হলো নিমেষেই আমার সব অসুখ-বিসুখ ভালো হয়ে গেছে। যদিও বলতে চেয়েছিলাম, আমি অসুস্থ কিন্তু বলি নাই, কারণ শুনেছি তাঁদের বাড়িতে অসুখ-বিসুখ সদ্য বেড়িয়ে গেছে। তা ছাড়া এর আগেও যাওয়া মিস করেছি অনেকবার ঈশায়ার স্কুল খোলা থাকে বলে। এবার আর মিস করতে চাই না। খোকন ভাই যাওয়ার পথে পাঁচটার দিকে আমাদের নিয়ে গেলেন। বিদেশ বিভুঁইয়ে এটা অনেক বড় ব্যাপার বটে! এটা কোনো সৌজন্য বা দাওয়াত নয় এটা ছিল এক আন্তরিক আহ্বান! ঈশায়ার স্কুল বন্ধ শুনে ওর কথা মনে করেই ভাবি যাওয়ার জন্য বলেছেন। নিউ ইয়র্কের ব্যস্ত জীবনে খুব আপনজনদের কাছ থেকেও এমনটা আশা করা যায় না। ব্যস্ত জীবন মানুষকে করে তোলে প্রাণহীন, সেখানে এই ডাক অনেক বড় কিছু। খোকন ভাই আমাকে চেনেন আমার খুব ছোট বয়স থেকে, আর ফ্লোরা ভাবিকে স্কুলের নিতান্ত ওপরের ক্লাসের ছাত্রী হিসেবে দু’একবার দূর থেকে দেখেছি। বাকি ঘনিষ্ঠতা এখানে এসে জমে উঠেছে। যদিও লেখালেখির সূত্র ধরেই এই পুনর্বন্ধন আমাদের!
যাই হোক নিউ জার্সির এ বাড়িতে এসে আমরা মুগ্ধ। বাড়িতো নয় যেন সাজানো ছোটখাটো ‘প্যালেস’। লেখক আনিসুল হক থেকে শুরু করে প্রথম আলোর সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন গুণীজন দেশ থেকে এ বাসায় এসে থেকেছেন, খেয়েছেন। আসতেই বন্ধুত্ব জমে উঠল ভাবির মেয়ে ইশ্রা আর ঈশায়ার। আমিও যেন সিলেটের পারিবারিক স্পর্শ পেলাম, দীর্ঘদিন কোনো মুরুব্বি দেখি না। কিন্তু ফ্লোরা ভাবির মা সেটা পরিপূর্ণ করে দিলেন। খালাম্মার সঙ্গে যতক্ষণ ছিলাম কি রকম একটা মা মা পরিবেশ আমার ভেতর সারাক্ষণ স্পর্শ করে ছিল। উনি সিলেট আম্বরখানা স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। বিধবা হয়েছিলেন খুব অল্প বয়সে দুই মেয়ে ফ্লোরা ভাবি ও ডোরা আপাকে নিয়ে। সেই ছোটবেলা থেকে বড়বেলার অনেক কাহিনি শোনা হলো। এভাবে গল্পে গল্পে কেটে গেল দু’দিন। আমাকে দেখে মনে হয় না যে আমি অসুস্থ কিন্তু আমি না বললেও ভাবি বুঝতে পেরেছেন যে আমার শরীর এখনো যথেষ্ট খারাপ। উনি খাবার জন্য গরম পানি, চাইলেন ট্যাবলেট এবং অবশেষে অ্যান্টিবায়োটিকও সরবরাহ করলেন। তাঁর যত্নেই আমি পরিপূর্ণ সেরে উঠলাম।
ফ্লোরাভাবীর এই ব্যতিক্রমধর্মী আতিথেয়তা আমাকে যেমন করেছে মুগ্ধ তেমন করেছে ভাবিত। কারণ, বর্তমান সময়ে আমরা এত বেশি আত্মকেন্দ্রিক যে অন্যের কথা ভাবারই সময় পাই না। আমরা এখন বেশির ভাগ সময়ই যা করি তার অধিকাংশ হয় শো অব না হয় নিছক সৌজন্য প্রদর্শন। একবার বোস্টন থেকে আমার পরিচিত একজন বলেছিলেন, তাঁর আপন বোন নিউ ইয়র্ক শহরে থাকেন। কিন্তু তারপরও বোনের বাড়ি যাওয়া হয় না। নিউ ইয়র্কে এলে হোটেলেই ওঠেন।
এ রকমই ছোটখাটো ছলছুতোয় অনেক আপনজনকেও দেখা যায় দূরে সরে যেতে। অথচ এখন সমাজের প্রত্যেকটা স্তরের মানুষের প্রয়োজন সত্যিকারের ভালোবাসা। অনেকের অনেক নিকট আত্মীয় আছেন, তবু একবার খোঁজ নেওয়া হয় না। এই মানবিক অভাব থেকেই মানুষ এক সময় বিষণ্নতায় ভুগতে থাকে, জীবন হয়ে উঠে অন্ধকার। আজ আমি একা আছি বলে নিজের সমস্যাটা বুঝতে পারছি। নতুবা হয়তো পারতাম না। প্রত্যেকেরই হয়তো এমন অনেক কাছের মানুষ আছেন যার একটু সহানুভূতির প্রয়োজন। অথচ নিজের মনে জমে থাকা এক পাহাড় অহমিকা প্রিয়জনের জন্য একটু সময় নিয়ে এগিয়ে এলে আমাদের জীবন যাপন সুন্দর হয়ে উঠবে। টাকা পয়সা হয়তো সবাই কম বেশি অর্জন করে ফেলেন। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে তো ভালোবাসা কেনা সম্ভব হয় না। আমাদের সবারই প্রয়োজন শুধু একটু নির্মল ভালোবাসার। সেই দিক দিয়ে আমার সামনে ফ্লোরা ভাবি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। ফ্লোরা ভাবির কথা লিখতে ইচ্ছে হলো সবাইকে এই আহ্বান জানাতে, আসুন এই মানবিকতার স্পর্শে সবাই একটু উজ্জীবিত হই!