একটি স্বপ্নের খসড়া

গত বছরের বইমেলায় মঞ্চে উপস্থিত লেখক-বুদ্ধিজীবীরা
গত বছরের বইমেলায় মঞ্চে উপস্থিত লেখক-বুদ্ধিজীবীরা

০১.
এ বছর ২৭তম নিউইয়র্ক বইমেলা হচ্ছে। ২২, ২৩ ও ২৪ জুন। ‘বই হোক আমাদের উত্তরাধিকার’ এবারের স্লোগান। ২৭ বছর যিনি এই স্বপ্নকে লালন করছেন, তিনি মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহা। আমার দেখা একজন আশ্চর্য মানুষ। শত প্রতিকূলতার মধ্যে তিনি এই অসাধারণ কর্মযজ্ঞ করে যাচ্ছেন। নিউইয়র্ক বইমেলা ও বাংলা উৎসব এখন আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করেছে। একদিন আমরা থাকব না, কিন্তু স্বপ্ন থাকবে। দ্বিতীয় প্রজন্মের মানুষেরা এই স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। বিশ্বজিৎ সাহা ও তাঁর সহযোদ্ধারা বিদেশে বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতিচর্চার যে দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়ে গেছেন, তা অব্যাহত থাকবে যুগ যুগ। দুই বাংলার সাহিত্যিকদের একটি অপূর্ব মিলনমেলার ক্ষেত্র তৈরি করেছেন তিনি।
শৈশব থেকেই আমার তেমন কোনো স্বপ্ন ছিল না। যখন যা মনে হয়েছে করেছি, যখন যেখানে যেতে ইচ্ছে করেছে গিয়েছি, যখন যার সঙ্গে সখ্য করতে ইচ্ছে করেছে, করেছি। পূর্বাপর কিছু ভেবে করিনি। এখনো আমার এই স্বভাবটা রয়ে গেছে। সামনে আগুন আছে না পানি—ওসব নিয়ে ভাবি না। আমি তেমন বাস্তববাদী না। অন্যদের মতো আমি চুলচেরা হিসাব-নিকাশ করে চলতে পারি না। আজকের দিনটার জন্যই বাঁচা। একটা সুন্দর দিন পার করতে পারাটা বিরাট কিছু আমার কাছে। জীবনে অনেক কিছুই পাব না, অনেক কিছুই হতে পারব না—তাই ওসব নিয়ে চিন্তিত না আমি।
তবে আমি একটা স্বপ্ন মনের মধ্যে সব সময় লালন করতাম। যেদিন আমি শংকরের এপার বাংলা ওপার বাংলা বইটি পড়ি, সেদিন আমি ঠিক করলাম একদিন আমেরিকা দেশটায় যাব। ও রকম একটা দেশ পৃথিবীতে সত্যি আছে! সেটা শৈশবের কথা। সত্যি সত্যি ২০০০ সালে আমি প্রথম আমেরিকা নামের দেশটায় পা রাখলাম। সেটা ছিল নিউইয়র্ক শহর। সেটাই আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ এবং সেই থেকে নিউইয়র্ক আমার প্রিয় শহর হয়ে আছে। তারপর যখনই সুযোগ পেয়েছি, ছুটে গেছি নিউইয়র্কে। এক যুগের বেশি সময় ধরে আমি প্রতিবছর নিউইয়র্কে আসি বইমেলা উপলক্ষে। মুক্তধারা আয়োজিত এই মেলায় সবার সঙ্গে দেখা হয়। সেখানে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রিয় লেখক, সাংবাদিক ও প্রকাশকেরা আসেন। আমেরিকা ও কানাডার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন লেখক বন্ধুরা।

০২.
মনে আছে যখন বিচিত্রায় কাজ করতাম, তখন প্রতিদিন নিউজপ্রিন্টের প্যাড আর বলপেন নিয়ে মেলায় চলে যেতাম। থাকতাম মুহসীন হলে। বিকেল হলে এক লাফে বাংলা একাডেমি। সেটা ছিল ১৯৮৪ সাল। আমাদের কয়েকজনের দায়িত্ব ছিল স্টলে স্টলে ঘুরে নতুন বইয়ের খবর নেওয়া। পাঠক, লেখক আর প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলা। এ ছাড়া মেলার টুকিটাকি নিয়ে লিখতাম। সবার্ধিক বিক্রীত বইয়ের তালিকা করতাম। পাঠক বিচিত্রার কাটিং নিয়ে আসত বই কিনতে। সেই থেকেই বইমেলার সঙ্গে একটা নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে।
বরিশাল থেকে এসেছিলাম লেখকদের কাছ থেকে দেখব এই আশায়। আমার কখনো বই প্রকাশিত হবে জানতাম না। অনেক লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমার জীবন অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু বইমেলা থেকে কখনো দূরে থাকিনি। যেখানে যে অবস্থায় থেকেছি, ছুটে গেছি মেলায়। ২০০৩ সালে কানাডাপ্রবাসী হওয়ার পরও প্রায় প্রতিবছর দেশে গিয়েছি। নিজের বই প্রকাশিত না হলেও গিয়েছি। নিজের আর্থিক ক্ষতির কথা ভাবিনি। অনেকবার চাকরি খুইয়েছি। ছুটে গেছি নিউইয়র্ক, ঢাকা আর কলকাতা। ১১ বছর ধরে টরন্টো বইমেলার আয়োজন করছি আমরা। এবার টরন্টো বইমেলা হবে ৭ ও ৮ জুলাই।
যখন থেকে শুরু করেছিলাম তারপর প্রায় ৩৭ বছর পেরিয়ে গেছে। ঢাকার বইমেলার পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে। অনেক নতুন নতুন লেখক আর প্রকাশক তৈরি হয়েছে। বেড়েছে পাঠক আর বইয়ের সংখ্যা। অনেক লেখককে হারিয়েছি আমরা। আমার নিজেরও প্রায় ৩০টি বই প্রকাশিত হয়েছে। বিদেশে না থাকলে এই সংখ্যা হয়তো আরও বেশি হতে পারত। লেখালেখির জগতে আমার কেউ ছিল না, আমি একা পথ চলেছি সব সময়।

০৩.
আমি লিখি আমার আনন্দের জন্য। আমার ভেতরে অনেক আবেগ আছে, অনেক না-বলা কথা আছে, সেসব আমি লিখি। শৈশব-কৈশোর থেকেই আমি একলা মানুষ, দলছুট, বোহেমিয়ান, এলেবেলে। তখন থেকেই আমি মনে করেছিলাম আমার নিজের অনেক কথা আছে, সেসব বলার জন্য আমার একটা মাধ্যম দরকার। কাগজে ফুটিয়ে তুলব আমার আবেগগুলোকে। আমি গল্পের বই পড়তাম। বইয়ের চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হতাম, কথা বলতাম। তারপর আমি পত্রমিতালী শুরু করলাম। প্রচুর চিঠি লিখতাম আমি এবং চিঠি পেতাম। তারপর শুরু হলো পত্রিকায় চিঠিপত্র লেখা। এর সবই আমার নিজের যে অনেক কথা আছে, সেসব বলার জন্য।
লেখালেখি আছে বলে আমার বিদেশজীবনটা কিছুটা হলেও স্বস্তির হয়েছে। তবে দুটোর মধ্যে পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে। দেশে যখন থাকি মনে হয় একটা মুক্ত আকাশের নিচে আছি, কিন্তু বিদেশে নানা কিছু করতে হয়। চাকরি, বাজার করা, বিল পরিশোধ, বাড়ির মর্টগেজ, গাড়ির ইনস্যুরেন্স আর লোকজনের সঙ্গে মেকি হাসা, আলগা বন্ধুত্ব। তাই সব সময় ‘অ্যাট হোম ফিলিং’ ব্যাপারটা থাকে আমার।
আমার লেখা যাঁরা পছন্দ করেন বা যাঁরা আমার বই কেনেন, আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমার প্রতি তাঁদের আবেগ বা ভালোবাসার সঙ্গে আমিও একাত্ম হয়ে যাই। আমি জানি, এতখানি পাওয়ার যোগ্য আমি না, আমি আমার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি পেয়েছি। বইমেলার সময়টা চমৎকার একটা মিলনমেলা। লেখক যেমন তেমনি পাঠকদের সঙ্গে দেখা হওয়াটা আনন্দের সব সময়। দেশের বাইরে এর চেয়ে বড় মিলনমেলা আর নেই। সে জন্য নিউইয়র্কবাসী বইপ্রেমীদের প্রতি আমার অভিনন্দন। বইমেলার পুরোটা সময় তাঁদের সান্নিধ্যে থাকব।

নিউইয়র্ক ১৮ জুন, ২০১৮