একটি সম্পর্কের অকারণ মৃত্যু ও তাহারা-২

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কী করবে সুমনা? বিকেল পাঁচটা থেকে এই রাত দুইটা; আর কত সে হিস্টিরিয়া সহ্য করবে? সুমনা ফের ভুল করল, বন্ধুকে বিশ্বাস করে, প্রেমিককে বিশ্বাস করে যে সে বুঝবে। না, সে অর্ণবকে ফেলে অমিকে বিয়ে করবে না। সম্ভবই না। এটা শুধু বান্ধবীর হিস্টিরিয়া কমাতে, তার বন্ধুর সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি ঠেকাতে, আর কিছু হলে যেন দায়টা সুমনার না হয়, তা এড়াতে। হয়তো অন্যায় এটা তবে, এর চেয়ে আর কোনো ভালো সলিউশন সুমনা রাত দুইটায় দেখতে পায় না। এটাও বুঝে পায় না, কেন এই সাইকো—দুদিন কথা বলেই এই সমস্যা ক্রিয়েট করছে? অথবা তার প্রিয় বান্ধবীই–বা কেন তাকে ব্ল্যাকমেল করে যাচ্ছে কারণ ছাড়াই?

বন্ধুই তো তারা—একজন আরেকজনের জন্য অতটুকু তো করাই যায়। আর পরিস্থিতি হয়তো সকালে ভালো হবে। সুমনার ঘুমও দরকার—মাথা আর কাজ করছে না।
ঠিক করল যা আছে কপালে, কাল অর্ণবকে বুঝিয়ে বলবে, আপাতত কুত্তা সামলাই—‘হ্যাঁ’ বলি। কাল বোঝা যাবে বাকিটা।

সুমনা ভীষণ বোকা তাই না? এত সহজে ম্যানিপুলেট করা যায়?
হুম্‌, সেই রাত দুইটার পর সে কোনোরকমে শুধু ‘হ্যাঁ’টুকুই বলেছিল, সেটাও সরল বিশ্বাসে! ভাবছেন, একজন মানুষ কতটা আহাম্মক হয়?
স্বাভাবিক ভাবা। তবে সেই মাঝরাতে তার হিস্টিরিক বন্ধুর কাজকর্মে তার আর সোজাভাবে চিন্তা করার অবসর ছিল না। অরণি অমিকে নাকি ভালোবাসত। অমিও তাকে। তবে অমি অরণিকে বিয়ে করবে না। কারণ, সে দেখতে অসুন্দর।
ওদিকে ‘হ্যাঁ’ বলেই সুমনা ঘাবড়ে গেছে ভেবে, কেন সে ‘হ্যাঁ’ বলল। অর্ণবকে চেনে সে, এর প্রাইজ যে কী হবে, ভেবে এবার সে আতঙ্কিত। খুন হয়ে যাবে সে। কে বাঁচাবে অর্ণবের রাগ থেকে?

শুধু ভাবছে, অরণি যদি সত্যিটা বলে অর্ণবকে, তাহলেই বাঁচার একমাত্র উপায়। নিশ্চয় অরণি মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে না। ওর জন্যই এত কিছু। নয়তো অমি কে? না, সুমনা তাকে চেনে, না জানে, না তার প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে। বুঝবে অর্ণব? ভুল বুঝবে না তো। এবার সুমনার চোখভরে জল আসে, না চাইতেও কান্না। ঘুম পাড়াতে তাকে বন্ধুরা এবার ঘুমের ওষুধ দেয়। কেউ জানলও না কী ক্ষতি অরণি তার করেছে! সুমনা বন্ধুকে কারও কাছে ছোট করবে, ভাবতেও পারে না।

এদিকে কেউ জানেও না তার আর অর্ণবের সম্পর্কের কথা। জানেন না, সেটা নয়। অফিশিয়ালি জানেন না, তবে এত দিনে সেটা ওপেন সিক্রেটও। তবে কেউ সেটা পছন্দও করে না। তাতে সুমনা বা অর্ণবের কিছু যায়–আসে না। কিন্তু এই ঝামেলা সুমনা কী করে সামলাবে?

পরের দুদিন সমনার চোখের জলে গঙ্গা–যমুনা বয় হতাশায়, নিজের ওপর রাগে। অর্ণবের রাগের সঙ্গে পরিচয় আছে তার। তারপরও দুদিন পরে সে ঠিক করে অর্ণবকে বলবে সব। যা রায় দেবে, মাথা পেতে মেনে নেবে সুমনা।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অফকোর্স সাইকো অমির কাছে যাবে না। আশা অরণি ঝামেলা পাকিয়েছে, সেই মেটাবে। সে বন্ধুর জন্য গলাজলে নেমেছে, মাথা তলিয়ে যাচ্ছে, অরণি হাঁটুজলে নামবে না তাকে বাঁচাতে? শুধু সত্যিটা বলুক অর্ণবকে, তাহলেই চলবে। অর্ণব ছাড়া সুমনা বাঁচতে পারবে না, সুমনা জানে সেটা! অল্প দিনেই এই পাগলটাকে এত ভালোবেসেছে সুমনা যে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় না অর্ণবকে ছাড়া।

আর সে চায় অর্ণব তার কাছেই শুনুক, তার বোকামির গল্প—অনেস্টি ছাড়া সুমনার দেওয়ার কিছুই নেই। ফাইনালি দুদিন পর সে সাহস খুঁজে পায় অর্ণবের মুখোমুখি হতে। বলেও তাকে সব—অর্ণব জানতে চায়, ‘ছেলেটাকে চেনো? ভালোবাসো?’ সুমনা বলে, ‘কী করে ভাবো, অন্য কাউকে ভালোবাসি? জানিও না সে কে? অরণির বন্ধু বলেই কথা বলতে রাজি হয়েছিলাম। তার জন্য পাত্রী খুঁজে দিতে রাজি হয়েছিলাম! আর কিছুই নয়। জিজ্ঞাসা করো অরণিকে!’

আরও পড়ুন

সুমনার ওপর রাগ হচ্ছে না? এত বোকা আর বন্ধুদের কেউ ওভাবে বিশ্বাস করে?—এটাই ভাবছেন তো! সুমনার তো কাউকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণই ছিল না।
অরণিকে ডেকে দেয় অর্ণবের সঙ্গে কথা বলতে! অ্যাটলিস্ট ফার্স্ট হ্যান্ড থেকে সত্য শুনুক! প্রিয় বান্ধবী আর প্রিয় পুরুষ—অবিশ্বাস কাউকেই সে করেনি। তাই তো একবারও ভাবেনি, দুজনের মাঝের কী কথা হচ্ছে, তা তার জানা উচিত। একবারও ভাবেনি, প্রিয় বান্ধবী প্রথম থেকেই তাকে বাঁশ দেওয়ার ধান্দায় ছিল।
তাদের মধ্যে কী কথা, সে জানেনি সে সময়, জানতে ইচ্ছা হচ্ছে আপনাদের? আমারও পরে ভীষণ জানতে ইচ্ছা হয়েছিল। ততক্ষণে সুমনা সব হারিয়েছে। তার ভালোবাসা, বেঁচে থাকার ইচ্ছা আর মানুষের প্রতি বিশ্বাস। নিজের ওপর ঘেন্না ছাড়া আর কিছুই ছিল না তার।

প্রিয় বান্ধবী আর প্রিয় পুরুষ! তাদের কথা শেষ হলে অর্ণব ফিরে এসে জানতে চায়, ‘অমির সঙ্গে কথা বলেছ? তাকে “হ্যাঁ” বলেছ? তার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল?’
সুমনা প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরেই ‘হ্যাঁ’ বলে—কথাগুলো সত্য। সে অমির সঙ্গে তিন দিন কথা বলেছে, অরণির জন্য। তার সঙ্গে অর্ণবের পরিচয় করিয়ে জানাতে চেয়েছে, সে ওর ফিয়ন্সে, আর শেষে ‘হ্যাঁ’ও বলেছে সুইসাইড ঠেকাতে, অন্য কিছু নয়।
অর্ণবের রাগী চেহারা দেখেও সুমনা একবারও ভাবেনি, অরণি তাকে মিথ্যা বলেছে! শুধু ভেবেছে রাগারই কথা!

সুমনা ভাবছে, কেন যে কথা বলল, না বললে তো এসব হতো না!
কথা বলার কারণ ছিল অরণি। তার মানে এ নয় যে তাকে ম্যানিপুলেট করতে হবে, ব্ল্যাকমেল করতে হবে, ফের তাতে রং চং চড়িয়ে মিথ্যা বলে অর্ণবের কানভারী করতে হবে এটা বলে যে অমির সঙ্গে সুমনার প্রেম চলছে। অমি সুমনার জন্য পাগল হয়ে গেছে। তার জন্য অরণিকে ফোনকার্ডের সাপ্লাই দিয়ে রেখেছে! আর সুমনা সজ্ঞানে–স্বেচ্ছায় অমিকে রাজি বলেছে, কারণ, সে জব করে, স্ট্যাবল ছেলে, যা সুমনাও জানত না। সুমনার কাছে প্রতিটি তথ্যই চমকপ্রদ! সে বিশ্বাসই করতে পারছে না অরণি এত মিথ্যা বলে অর্ণবের মাথা খারাপ করে দিয়েছে! কী ক্ষমতা সুমনার তিন দিন পাঁচ মিনিট কথা বলেই একটা ছেলেকে পাগল বানিয়ে দিয়েছে!

ভাবছেন তো বেশ হয়েছে? এটাই হওয়া উচিত সুমনার সঙ্গে? কেন বিশ্বাস করল বান্ধবীকে?

প্রতীকী ছবি

সুমনা সে মুহূর্তে অবাক হতেও ভুলে গিয়েছিল! অর্ণব যখন তাকে চিটিংয়ের অভিযোগ করেছে। আর অরণিই অর্ণবকে স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে, ঠান্ডা মাথায় এসব মিথ্যা বলছে! বিশ্বাস করা যায়?

সুমনা শুধু এতটুকু চেয়েছিল—অর্ণব সত্যি জানুক। অন্যায় সে করেছে ‘হ্যাঁ’ বলে, তবে সে অর্ণবকে চিট করেনি। না তার সে ইচ্ছা কোনো দিন ছিল। অর্ণবই–বা কী করে সেটা ভাবল? বিশ্বাস করলে? না ভাবার কারণও তো নেই! অরণি-সুমনার কাছের বান্ধবী কেন মিথ্যা বলবে? ভাবনা লেজিট!
কেন মিথ্যা বলল অরণি?
কী লাভ ছিল তার?
কেন সে সুমনাকে নিয়ে এ কুটিল–জটিল খেলা খেলল?
কী লাভ ছিল তার অর্ণবের সঙ্গে সুমনার ব্রেকআপ করিয়ে?
সুমনা আজও জানে না।

শুধু জানে, সে কোনো অন্যায় করেনি। না সে অর্ণবকে ঠকিয়েছে, না অন্য কাউকে ভালোবেসেছে। তবে সেদিন মুখ বুজে সে প্রতিটি অপবাদ সহ্য করেছে। অপমান মাথা পেতে নিয়েছে। কী করার ছিল বলতে পারেন সুমনার?
কী করা উচিত ছিল, যখন সে জানল কী বড় প্রতারণা তার বন্ধু করে গেছে তার সঙ্গে?
ফের সেই বন্ধু সবাইকে গিয়ে বলছে, সুমনার ব্রেকআপ হয়েছে, একসঙ্গে অনেক সম্পর্ক করার কারণে? অরণি নিজের চেহারা আয়নায় দেখে? কী করে নিজেকে সে মানুষ বলে পরিচয় দেয়? ঘেন্না হয় না নিজের ওপর? বিনা কারণে দুজন মানুষের জীবন তছনছ করতে এতটুকু যার বুক কাঁপে না, তার বিবেক বা মনুষ্যত্ব আছে?
যে বন্ধু তার অসম্মান হবে বলে, মুখ বন্ধ করে নিজের ভালোবাসা, বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হারিয়েছে, ফের তাকেই দোষী বানিয়ে শাস্তি দেওয়া?
খুব রাগ হচ্ছে না সুমনার ওপর? এত বোকা কেন হবে?
ফের অর্ণব?
সে কী করে এতটা নিষ্ঠুর আর অবিবেচক হলো? সুমনার সারা জীবনের প্রশ্ন থেকে যাবে, ‘কী দোষে এত বড় সাজা পেয়ে গেলাম? এতগুলো মানুষের বিবেকে এতটুকু বাধেনি?’
কী করে নিজের চেহারা আয়নায় দেখে এরা? এত মিথ্যা বলেও মানুষ পার পেয়ে যায়, আর সুমনাকে সারা জীবন সাফার করে যেতে হয়?
বিচারব্যবস্থা সঠিক হলে অরণির ছাত্রত্ব বাতিল হওয়ার কথা! অরণির ক্রিমিনাল অ্যাক্টের কারণে অনেক জীবন নষ্ট হয়েছে, তার জন্যও তার ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হওয়ার কথা। সুমনার ডিফেমেশন, তার মানহানির জন্যও তার ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট পাওয়ার কথা!
অথচ এদের কিছু হয় না। এরা জানে এদের কিছুই হবে না। সুমনারা সারা জীবন বোকাই থেকে যাবে, আর এরা তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেয়ে যাবে। এরা সহজ শিকার ধরায় অভ্যস্ত!
সুমনা অরণিকে ক্ষমা করে দেবে? বা অমিকে? কোনো দিনই না।
সত্যিই কি এসব মানুষ কৃতকর্মের ফল পায়?
নাহ। পায় না। বরং ভালো থাকে—ম্যানিপুলেটিভ, মিথ্যুক—মিষ্টি কথায় সবার অন্তরে জায়গা করে থাকে। বোকা সুমনারা সাফার করে এদের বিশ্বাস করে, ভালোবেসে।
আর অর্ণবেরা? তাদেরও ম্যানিপুলেট করা এত সহজ? একবার তলিয়েও দেখে না কোনোটা সত্যি? কোনোটা মিথ্যা? ভালোবাসা এত ঠুনকো কেন এদের কাছে?
সুমনারা নিজেদের সম্মানের কথা চিন্তা করে চুপ থাকে বলেই হয়তো এরা পার পেয়ে যায়। আর কোনো সুমনার মন, ঘর না ভাঙুক। সুমনাদের শক্ত হওয়ার সময় এখন। প্রতিবাদের সময়।

প্রতিটি সুমনা যেন তাদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস পায়। বুলিং ইজ নট ওকে। ডিফেমেশন, সম্মানহানি, মিথ্যা বলে পার পাওয়া ইজ নট ওকে! Those are criminal activities and they should be punished for it. Everyone should stand up for justice.

আপনার আশে পাশে অন্যায় হতে দেখলে, প্লিজ চোখ বন্ধ করে থাকবেন না। মুখ বন্ধ করে রাখবেন না। অন্যায়গুলো নিয়ে বলুন। জীবন বাঁচান। সুমনা আত্মঘাতী ছিল, অর্ণবও! আর এইটা করেছিল তাদেরই খুব কাছের বন্ধু!
*লেখক: চিকিৎসক