একটি সম্পর্কের অকারণ মৃত্যু ও তাহারা-১
সুমনা জানে, অরুণের সঙ্গে তার পক্ষে সম্পর্ক রাখাটা সম্ভব নয়। অরুণের ব্যাপারে তার পরিবার ‘নো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছে। অরুণের সঙ্গে তার এমন কোনো সম্পর্কও নেই। তবু সেটা ভাঙতেও সুমনার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এমন নয় যে তাদের প্রতিদিন দেখা হয়, কথা হয়। আসলে দেখাই হয় না। অরুণ তো তাদের সম্পর্ক হওয়ার আগে থেকেই দেশেই থাকে না। দেখা বা কথা হওয়ার সুযোগ কই! তবে সে এবার দেশে এসেছে জেনে সুমনার পরিবার আলটিমেটাম দিয়ে দিয়েছে। সম্পর্ক করলেই বা রাখলেই ওর সঙ্গে আর পরিবার সম্পর্ক রাখবে না। সুমনার কাছে পরিবারই সব। তাই কষ্ট হলেও সে মেনে নিয়েছে এই আলটিমেটাম। অরুণকে ছেড়ে আসাটাই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে ওর কাছে।
কথায় কথায় সে জানায় এটা অরণীকে। অরণী তার খুব কাছের বন্ধু হয়ে গেছে দুদিনেই। অরণীও জানায়, সে একজনকে পছন্দ করে। তবে ছেলেটি তাকে হয়তো পছন্দ করে না। ছেলেটি অন্য মেয়ের কাছে ধোঁকা খেয়ে বাঁকা হয়ে গেছে। সে জন্য ভীষণ হতাশ। তার প্রেমিকাকে সে নাকি অন্য ছেলের সঙ্গে এক বিছানায় পেয়েছে। তার পর থেকেই ভীষণ বিষণ্ন থাকে। তবে এখন একটু সামলে উঠেছে, তাই বিয়ে করতে আগ্রহী। স্থানীয় মেয়ে খুঁজছে।
সুমনা সরল বিশ্বাসে অরণীর কথা বিশ্বাস করে নেয়। ছেলেটির জন্য খারাপও লাগে। একবারও ভাবে না, কীভাবে ছেলেটি তার প্রেমিকাকে অন্য ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে দেখল? তার যাতায়াত এত অবিরত যে সে যখন–তখন মেয়েটির সঙ্গে এমন করে। ভাবেইনি, কেন অরণী তাকে মিথ্যা বলবে? বা সে বলতে পারে!
অরণীকে সুমনা জানায়, স্থানীয় মেয়ে তো পাওয়া সমস্যা না। অরণী বলে, ‘তুমি একটু খুঁজে দেখো তো!’ সুমনাও বোকার মতোই বলে বসে, ঠিক আছে।
যেখানে সুমনা নিজেও নিজের ভালোবাসার কথা বাসায় বলতে পারে না, সে একবারও ভাবেনি, ছেলেটি কেন অরণীর পছন্দে বিয়ে করবে? বা সুমনাই বা কোথায় তার পছন্দের মেয়ে খুঁজে পাবে? তবুও আশপাশে প্রচুর অবিবাহিত মেয়ে আছে বলে, রাজি হয় কথা বলে দেখবে বলে। সবাই প্রভাবশালী লোকজন। পছন্দ হলে, পরিবারে কথা বলে দেখবে, কী হয়! এটা আর এমন কী!
সুমনা অনেকগুলো বিপদচিহ্ন এড়িয়ে গেছে এরই মধ্যে—অরণীর কথা একটিবারের জন্য হলেও দুবার ভাবা উচিত ছিল। কেন সুমনাকে সে বলেছে? আর সুমনা ভাবছে, অরণীর কাছের বন্ধু সে, হয়তো সে কারণেই।
ওদিকে অরণী জানায়, ছেলেটি মাঝেমধ্যেই নিজের হাত–পা কাটে, যখন তার প্রাক্তনের কথা মনে পড়ে। নিজেকে শেষ করে দিতে চায় ছেলেটি! সুমনা ভাবে, কী বিরহ! বেচারার আসলেই একটা ভালো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়া উচিত!
এদিকে সুমনা একটু একটু করে সেরে উঠছে নিজেই। মা–বাবার কঠিন নিয়ন্ত্রণে বড় হওয়া মেয়েটি জানেও না ভবিষ্যৎ কত করুণ। সে শুধু বর্তমানেই বসবাস করে যাচ্ছে।
সেরে ওঠা প্রয়োজন তার। সেই দুঃসময়ে কাছে এসে দাঁড়ায় তার কাছের বন্ধু। অজান্তে তাদের মধ্যেও একটি সম্পর্ক হয়েই যায়। ভালোবাসার, বিশ্বাসের। সুমনা তাই বিশ্বাস করতে চায়। সুমনা নিজেও জানে না, এত বড় সাহস সে কী করে করল? তার পরিবার এটা মেনে নেবে কি না! তবে সেই মুহূর্তে সুবর্ণ তার একমাত্র বিশ্বাসের স্থান। নিজেদের বোঝাপড়াই ঠিকমতো হচ্ছে কি না, সুমনা জানেও না। নতুন পরিচয়। নতুন ভালোবাসা। স্বপ্ন দেখতে চায় সে! আরেকটু চেনাজানা হলেই হয়তো সবাইকে বলবে ভাবছে সুমনা। ততক্ষণ থাক সেটা লোকচক্ষুর অন্তরালে। ভালোই তো বাসে।
অবিশ্বাস শব্দটাই যেন সুমনার অভিধানে নেই। কাউকে বিশ্বাস করার এই সুযোগও তো তার কোনো দিন হয়নি। সবই নতুন।
ছুটিতে সুমনা ঘরে ফেরে। অরণী তাকে মনে করিয়ে দেয়, পাত্রী খোঁজার কথা। সঙ্গে ফোন নম্বর তার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার জন্য। দুই মিনিট কথা বলার পর, সুমনার খটকা লাগে। কেন ছেলেটি (ধরলাম তার নাম অমি), হুট করেই বলে ফেলে, ‘আমি তো ভাবছিলাম পাত্রী আপনি!’
সুমনার ভীষণ বিরক্তি হয়। ভদ্রতায় রাগও হতে পারে না, অরণীর বন্ধু বলে কথা! তবে ঠিকই জানায় তাকে ‘না ভাই, ভুল বুঝেছেন। পাত্রী স্থানীয় মেয়ে। আমি নই।’
ফোন রেখেই সুমনা অরণীকে ফোন করে, কেন এই ভুল–বোঝাবুঝি? কৈফিয়ত চায় সে অরণীর কাছে। কেন অমি ভাববে সুমনার সঙ্গে তার বিয়ের কথা চলছে? অরণী তাকে আশ্বস্ত করে বলে যে হয়তো ভুল বুঝেছে।
সুমনা বিশ্বাস করে অরণীর কথা। ভাবে, হতেই পারে! তাই দ্বিতীয়বার কথা বলার সময় ভাবে, সুবর্ণর সঙ্গে তার দেখা নেই অনেক দিন। আর যদি সুবর্ণর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, আর সে সময় সে অমিকে জানায়, এটা তার প্রেমিক, তাহলে একসঙ্গে দুই ঝামেলা মিটে যাবে। সবাই জানবে, সুবর্ণর সঙ্গে তার সম্পর্ক চলছে। আর অমিও নিজের ভুল বুঝতে পারবে।
অমিকে যখন সুমনা বলে, ‘ভাই এটা আমি নই, অন্য মেয়ের কথা বলছি আমরা। আপনি চাইলে তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। ঠিকানা দিতে পারি। আপনারা কথা বলে দেখতে পারেন।’ অমি জানে, সুমনাদের ছুটি শেষ। দুই–এক দিনেই তারা সবাই ফিরে যাবে। তাই সে বলে বসে, ‘এরপর তো কথা হবে না। ভুলেই যাবেন। পৌঁছে জানাযবেন।’
সুমনাও ভাবে, এটা তো কোনো বড় ব্যাপার নয়। পৌঁছে ভদ্রতায় জানানোই যায়, শেষবারের মতো।
সুমনার সুবর্ণর সঙ্গে একদিন কয়েক মিনিটের দেখা হয়, এর ভেতর। তবে তার আর অমির সঙ্গে দেখা করার সময় হয়নি।
সুমনা ডর্মে ফিরে গিয়ে ভদ্রতায় ফোনে জানিয়ে দেয় অমিকে যে সে পৌঁছেছে। অতটুকু ভদ্রতা না করলেই যেন নয়। কাহিনি সেখানেই শেষ হওয়ার কথা!
এতক্ষণ ধৈর্য ধরে পড়েছেন যখন, তখন বাকি গল্পটা শুনবেন না?
ভাবছেন সুমনা এত বোকা কেন?
সুমনার চালাকি করার কারণ ছিল না যে। সে তো সুবর্ণর সঙ্গে সম্পর্কে আছে। তবে সুমনার বোকামির আরও বাকি আছে। বিচার করার ভার আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।
উপদেশও দিতে পারেন, সুমনার আসলে কী করা উচিত ছিল, প্রতিটি পদক্ষেপে! সুমনাকে বাঁচাতেও পারেন। আবার বোকা বলে তিরস্কারও করতে পারেন। সে বিবেচনা আপনাদের। অথবা বলতে পারেন এখানে আসলে কী ঘটেছিল। বিশ্লেষণের দায়ভার আপনাদের। কী করা উচিত ছিল, কী না করলেও হতো, সব চুলচেরা বিশ্লেষণের ভার আপনাদের ওপর রইল।
কাহিনি এগোবে?
সুমনার মনে— অমি কাহিনির ইতি সেখানেই। তার কোনো দায় নেই লোকটির প্রতি। সে নিজেই আরেকজনের প্রেমিকা ওই মুহূর্তে। তাই অন্য কারও ভাবনাও নেই তার মাথায়।
সুমনা অরণীকে সব বলে, জানতে চায়, কেন এমন হলো? কেন অমি তাকে এভাবে উল্টোপাল্টা কথা বলল? অরণী তার উত্তর না দিয়ে ভয়ানক শশব্যস্ত হয়ে বলে, ওর অমির সঙ্গে কথা বলতে হবে। ওর বন্ধু বলতেই পারে। তাই সুমনা কিছুই ভাবে না ব্যাপারটাতে। তবে অরণী চায় সেটা সুমনার বান্ধবীর বাসায় হবে। আর যেহেতু সেটা সুমনার বান্ধবীর বাসা, সুমনাও সঙ্গে যাবে। সুমনা দুবার ভাবেনি, কেন! কৌতূহল হয়নি যে, তা নয়। তবে সেদিন সে না গেলেই ভালো করত। সুমনা ভাবেওনি অরণী সুমনাকে অমির সঙ্গে আবার কথা বলতে নিয়ে যাচ্ছে!
গেছে সঙ্গে সরল বিশ্বাসে, অরণীর সঙ্গে। সুমনাকে নিয়ে সে খেলছে, ভাবেইনি অরণী।
ফোনে কথা শুরু করেই অরণী সুমনার হাতে ফোন দেয় কথা বলতে। সুমনা ভেবে পায় না কেন!
সুমনা সেখানেও তাকে ভদ্রভাবেই জানায়, সে অপারগ। আর এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। না তাকে সুমনা চেনে, না তার প্রতি সুমনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে। ‘হ্যাঁ’ কেন বলবে?
কথা শেষ করে ফিরতি পথে, অরণী সুমনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে, ‘তুমি অমিকে না করেছ, এখন সে আরও ডিপ্রেসড, কান্নাকাটি করছে!’
সুমনা তাজ্জব হয়ে যায়, ‘তাতে আমার কী করার আছে?’
ঘটনার এখানেই পরিসমাপ্তি হওয়া উচিত ছিল। কী বলেন!
না অমিকে সুমনা চেনে, না তার প্রতি সুমনার কোনো আগ্রহ আছে।
আর সুবর্ণ যা পোজেসিভ! কী অনর্থ ঘটাবে এসব জানলে, সেটাই তার মাথায় ঘুরছে তখন।
ঘটনার পরিসমাপ্তি? ভাই, ধৈর্য ধরেন। কাহিনির ক্লাইমেক্সই তো আসেনি এখনো!
অরণী কাঁদতেই থাকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, রাত নামে। সেই সঙ্গে তার কান্নার প্যারামিটারও বাড়তে থাকে। আর ব্ল্যাকমেইল? শুরু হয় নতুন ধান্ধা!
‘তুমি না করেছ, এখন অমি নিজেকে কাটাকাটি করছে। মরে যাবে ছেলেটা। হেঁচকি তুলে কান্না।’ মাঝরাত তখন। অরণী বলতে শুরু করেছে, ‘প্লিজ একটা কিছু করো!’ হিস্টিরিয়ায় পেয়ে বসেছে যেন অরণীকে।
এবার সুমনা ঘাবড়ে যায়। সাত ঘণ্টার ননস্টপ কান্না আর হিস্টিরিয়ার কারণ খুঁজে পায় না সুমনা! এমন না যে লোকটি সুমনাকে চেনে! কেন এসব উটকো ঝামেলা সুমনাকে পোহাতে হচ্ছে, সুমনার মাথায়ই ঢুকছে না। সে তো সোজা ‘না’ করেছে। লোকটাকে ভদ্র বলেই তো মনে হয়েছে, মেনে নিয়েছে! অরণীর সমস্যা কী? আর যদি লোকটা সত্যিই আত্মহত্যা করে, অরণী তো সুমনাকেই দুষবে! সুমনা কী করবে? ‘ভাত চাই না কুত্তা খেদা’র কথা মনে পড়ে সুমনার। কী করলে এই অসহ্য ন্যাগিং থেকে আপাত রক্ষা পাবে সুমনা?
হুম সে গিয়ে বাকি সহপাঠীদের বলতে পারে, জানতে চাইতে পারে, উপদেশ চাইতে পারে, তার কী করা উচিত এই মুহূর্তে। তবে তাতে অরণী ছোট হয়ে যাবে সবার কাছে।
অরণীকে কেউ পছন্দ এমনিতেই করে না। সুমনার খারাপ লাগবে, ওর বন্ধু সবার কাছে আরও ছোট হয়ে গেলে। সেটা সে কেমন করে করে?
এদিকে রাত দুটো বাজে। সে অর্নবকেই বা কোথায় পাবে এত রাতে? তখন তো টেলিফোনই ল্যান্ডলাইন মাত্র! যার বাসায় ফোন আছে, তাদের সেইরকম দাপট।অর্নবকে তো কোনোভাবেই পাওয়া যাবে না যে সুমনা তাকে জিজ্ঞেস করবে একটিবার, কীভাবে সে সামলাবে এই বিরক্তিকর পরিস্থিতি! অর্নব তো তাকে ভুলও বুঝতে পারে? ভয়ে তার হাত–পা কাঁপছে! তবে একমাত্র মনে হচ্ছে, এই লোক যদি সেল্ফ–মিউটিলেট করছে এখন, তা থামানোর একমাত্র রাস্তা হলো ‘হ্যাঁ’ বলা। বাকিটা কাল দেখা যাবে।
অর্নব মানবে? বুঝবে? ভুল বুঝবে না? ওর ফিয়ন্সে ‘হ্যাঁ’ বলেছে, শুধু ঝামেলা ঠেকাতে? বুঝবে না? সুমনা তো অমিকে ভালোবাসে না। ‘হ্যাঁ’ বললে কি অর্নব খুব রাগ হবে? বুঝবে না সুমনা শুধু অর্নবকেই ভালোবাসে, বুঝিয়ে বললে? এই ‘হ্যাঁ’র কোনো মূল্য নেই। মানবে অর্নব?
চলবে...
*লেখক: চিকিৎসক