একটি পরীক্ষার ফলাফলই সব নয়

যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজের জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের উল্লাস। ছবি: এহসান-উদ-দৌলা
যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজের জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের উল্লাস। ছবি: এহসান-উদ-দৌলা

প্রতিবছর বোর্ড পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার আগে থেকেই মনটা ধুকধুক করে কাঁপে। দেশে অসংখ্য ছেলেমেয়ে ভালো ফলাফল করবে। তারা হাসবে। উচ্ছ্বসিত হবে। অথচ খুশি হওয়ার বদলে, মনে ভয় কাজ করে। কারণ প্রতিবছর ফলাফল বের হলেই খবরে পড়তে হয়, কয়েকটি ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করেছে। কেউ কেউ ফলাফল খারাপ করে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। লোক লজ্জার ভয়ে কেউ কেউ বাড়ি ছেড়ে পালায়। এগুলো শুনতে খুব কষ্ট হয়। শুধুমাত্র একটি পরীক্ষায় খারাপ করে একজন মানুষ তার জীবনকে তুচ্ছ মনে করে, এর চেয়ে হতাশার কিছু আর নেই। আমাদের পরিবারগুলো বুঝতে চায় না, পরীক্ষার ফলাফলই জীবনের শেষ কথা নয়। একজন মানুষ এতই বড়, এতই সম্ভাবনাময়ী যে, শুধু একটি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে তাকে বিচার করা যায় না। এটা অন্যায়। এটা নির্মম।

আমার যেদিন ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্ট হলো সেদিন বাসার সবার খুব মন খারাপ। আমি পাস করেছি কিন্তু ভালো করতে পারিনি। বাসার একমাত্র ছেলে হিসেবে খুব প্রেশার ছিল। আব্বা-আম্মার চাহিদা ছিল ব্যাপক। সে চাহিদার চাপ সামলানো ছিল খুব কষ্টকর। পরিবারের বোঝা উচিত, একজন মানুষ পরীক্ষায় খারাপ করলেই তার জীবন ধ্বংস হয়ে যায় না। ইতিহাসে বহু গুণীজন পরীক্ষায় খারাপ করেও বড় হয়েছেন। তা ছাড়া একটি-দুটি পরীক্ষায় খারাপ করলেই যে জীবন বিনাশ হয়ে যাবে, সেটা ভুল ধারণা। পৃথিবীর অসংখ্য ছেলেমেয়ে পরীক্ষায় খারাপ করে। তারা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। শিক্ষাজীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর এই চিত্র খুবই সাধারণ।
আমার শিক্ষাজীবনে বহু চড়াই-উতরাই গেছে। উত্থান-পতন গেছে। কখনো খারাপ করেছি, কখনো খুব ভালো করেছি। কিন্তু থেমে থাকিনি কভু। আমার অনেক বন্ধু, যারা আমার চেয়ে অনেক ভালো করেছে একসময়, তাদের অনেকেই ঝরে গেছেন। আমার চেয়ে খারাপ ফলাফল করে অনেক বন্ধু বহুদূর এগিয়ে গেছেন। আমার শৈশবের দুই নায়ক ছিল। তাঁরা দুজনেই ক্লাস ফাইভে এবং এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন। পড়ার টেবিলে বসলেই, আম্মা তাদের উদাহরণ টানতেন। অথচ কী দুর্ভাগ্য যে, তাদের একজন এসএসসি পাশের পরই ঝরে যায়। অন্যজন বিশ্ববিদ্যালয় শেষ না করেই লেখাপড়ায় ইতি টানেন।
পরীক্ষায় যারা ভালো করেছ তাদের অভিনন্দন। জীবনযুদ্ধে তোমাদের যেতে হবে আরও বহুদূর। সে জন্য প্রস্তুত হও। যারা খারাপ করেছ কিংবা প্রত্যাশিত ফলাফল করতে পারনি, তাদের বলব—শক্ত হও। মন খারাপ না করে নতুন করে প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে যাও। যে তুমি আজ কাঁদছ, সে তুমিই আগামী পাঁচ-দশ বছর পর দেখবে বহুদূর চলে গেছ। আজ যে বন্ধু তোমার চেয়ে ভালো করেছে, তার চেয়ে হয়তো তুমি একদিন অনেক দূর এগিয়ে যাবে। তখন নিজের কাছেই বিস্ময় মনে হবে।

লেখক
লেখক


আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন ক্লাসের ভালো ফলাফল করা কোনো ছাত্র ছিলাম না। পরীক্ষায় একটা গড় ফলাফল করতাম। কিন্তু সৃষ্টির একটা নেশা ভেতরে পুষে রাখতাম। চেষ্টাটা ধরে রাখতাম। সৃষ্টিকর্তার কৃপায়, আমার ব্যাচের মধ্যে একমাত্র আমিই বিদেশে গবেষণা করতে আসি। স্টকহোম ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করে সেই দেশ থেকে অনেক সম্মানজনক স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় গবেষণার সুযোগ পাই।
জীবনে আজ যা পাওনি, কাল তা পাবে। তবে সে পর্যন্ত ধৈর্য ধারণের শক্তি থাকতে হবে। ক্রমাগত চেষ্টা করে যেতে হবে। ধৈর্য অনেক বড় এক সম্পদ। আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা ও চেষ্টা থাকলে মানুষ দূর থেকে দূরে চলে যায়। বিদেশে গবেষণা করতে এসে দেখলাম, কত কত মেধাবী ছেলেমেয়ে এখানে জড়ো হয়েছে। কে কবে এ-প্লাস পেয়েছে কিংবা পায়নি, সে খবর কেউ রাখে না। পরীক্ষার ফলাফল আর জীবনের সফলতার মধ্যে অনেক ফারাক থাকে।
অভিভাবকদের বলব, ছেলেমেয়েদের ওপর প্রত্যাশার চাপ না দিয়ে তাদের সম্ভাবনাকে বের করার চেষ্টা করুন। সন্তানের পাশে থাকুন। সাহস দিন। কেউ হয়তো স্কুল-কলেজের গতানুগতিক পরীক্ষায় ভালো করে না কিন্তু সে ছবি আঁকায় ভালো। গানে কিংবা নাচে ভালো। লেখালেখিতে ভালো। কেউ হয়তো আজ পরীক্ষায় খারাপ করেছে কিন্তু দুই বছর পর হঠাৎ করে অনেক ভালো করা শুরু করবে। এটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতি আমাদের এভাবেই গড়েছে। বাগানের সব গাছ কি একসময়ে ফল দেয় বলুন?

*ড. রউফুল আলম, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া (UPenn), যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: <www.facebook.com/rauful15>