একটি ছবি কিছু স্মৃতি

১৯৯৫ সালের মাঝামাঝি ইউরোপের ব্রাসেলস হয়ে জার্মানের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে বাডেন-বুডেনেবার্গের ছোট্ট শহর ফ্রাইবুর্গে এলাম। বিখ্যাত ড্রাইসেম নদী শহরের পশ্চিম দিয়ে বয়ে গেছে নেদারল্যান্ডস অবদি। পশ্চিম কিনারায় সুয়ার্জ বাল্ড বা ব্ল্যাক ফরেস্ট। এক হাজার ২৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ রাইন নদী, যার বিস্তৃতি জার্মান, ইতালি, অস্ট্রিয়া, লিসটেন স্টাইন, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডস পর্যন্ত। এ যেন শত শত নদ-নদী ঘেরা বাংলাদেশের আরেক প্রতিরূপ।
বিদেশে এসেও শেকড়ের টানে প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশের খবর জানার চেষ্টা করি। এক দিনের একটি খবর আমাকে স্তব্ধ করে দিল। গাইবান্ধায় সংবাদ সংগ্রহের জন্য ছুটে গিয়েছিল মোনাজাত (মোনাজাত উদ্দিন)। সে দিন ছিল ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বরে। যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্ট। যা ফুলছড়ি উপজেলায়। সেখানে ফেরিতে নদী পারাপারের সময় নাকি পা পিছলে নদী গর্ভে হারিয়ে যায় মোনাজাত। অকালেই মৃত্যুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তার। তবে এর মাঝে থেকে যায় অনেক প্রশ্ন। যার উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি আজও। খবরের খোঁজে বের হওয়া মানুষটি নিজেই লাশ আর খবর হয়ে ফিরে এল। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার। পা পিছলে যাওয়ার মানুষ নন মোনাজাত উদ্দিন। শুনেছি খবরের বাস্তবতার ছবি ক্যামেরা বন্দী হওয়ার আগেই মৃত্যু তাকে আলিঙ্গন করেছে। খবরের শিরোনাম হয়েছিল লাশ হয়ে ফিরে আসা মোনাজাতের ছবি।

আশির দশক থেকে আমাদের পরিচয় ও বন্ধুত্ব। একই প্রতিষ্ঠানের হয়ে দুজনেই কাজ করেছি কয়েক বছর। একবার কুমিল্লায় সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কতগুলো সংবেদনশীল সিরিজ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করেছি আমরা দুজনে। অনেক রোমাঞ্চকর ছিল আমাদের সে মিশন। আমার অধ্যাপনা পেশা ও একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন আমাকে অত্যন্ত সমীহ করত। যা ছিল অনেক সময় বিব্রতকর। তার অকাল মৃত্যুর রহস্য আমাকে প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকুনি দেয়।
মনে পড়ে কুমিল্লায় আমার বাসায় বেড়াতে এসে আমার ছোট ছেলে ও মেয়ের একটি ছবি তুলেছিল মোনাজাত। সে ছবিটি আজও ফ্রেমবন্দী হয়ে আছে অনেক বেদনাবিধুর স্মৃতি নিয়ে।
তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বচল। ২০১২ সালের ৪ জানুয়ারি মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় কানাডায় নিহত হয় আমার সন্তান মাহিনুর জাহিদ (২৭)। কানাডার আলবার্টাপ্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রিয়মুখ তরুণ মাহিনুর জাহিদের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী কাল। এ উপলক্ষে দোয়া মাহফিল ও যুবকদের জন্য ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টের আয়োজন হবে। মাহিনুরও সড়ক দুর্ঘটনায় এক অবিশ্বাস্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে। মোনাজাত আর মাহিনের মৃত্যু ঘটনাবহুল দিনগুলোর মাঝে যেন নোঙর করে বসে আছে। ফ্রেমবন্দী সে ছবিটি যেন ছোট্ট মাহিনের ও মোনাজাতের স্মৃতিকেই বয়ে বেড়াচ্ছে।
(দেলোয়ার জাহিদ: বাংলাদেশ প্রেসক্লাব সেন্টার অব আলবার্টা ও বাংলাদেশ হেরিটেজ মিউজিয়াম অব আলবার্টার সভাপতি এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কানাডা ইউনিট কমান্ডের নির্বাহী সদস্য)