আমার বন্ধু পারভেজ মোহাম্মেদ মোবিন, জীবনবোধে পরিপূর্ণ। সমাজ সচেতন, প্রগতির পথযাত্রায় অসম্ভব সংবেদনশীল; সময়ের চেয়ে এগিয়ে চলা মানুষ। পারভেজ মোহাম্মদ মোবিন, বন্ধুদের কাছে শুধুই মোবিন। পড়াশোনায় সব সময় অসাধারণ। ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে তাঁর দখল সমীহ করার মতো। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে তার ফলাফলের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ব্যতিক্রমী মোবিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়ে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাইকে চমকে দিয়ে গ্রামে চলে গেল। গ্রাম মানে নিজের জন্মস্থান মধ্যগ্রাম উপজেলার শিয়ালহাটা। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। মধ্যগ্রাম যেতে ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন, লঞ্চ, নৌকা সব মিলিয়ে প্রায় একান্ন, বায়ান্ন ঘণ্টা লাগতো। পরে জানা গেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম চৌকস ও মেধাবী ছেলেটি শিয়ালহাটা গ্রামের একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছে। মোবিনের গ্রামে ফেরা ধ্রুপদ উপন্যাসের গল্পের মতো ছিল আমাদের কাছে।
ঈর্ষা করার মতো জীবনকে পায়ে ঠেলে গ্রামে গিয়ে শিশু শিক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করা, চলতি হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো বন্ধুদের কাছে ছিল কিছুটা পাগলামি। অনেকে মনে করেছিল, মেধাবী মোবিনের এটি একধরনের অ্যাডভেঞ্চার, ক্ষণিকের মোহ। ফিরে আসবে মোবিন, বিলাসী জীবনকে আলিঙ্গন করবে সহসাই। না, মোবিন ফিরে আসেনি। মোবিন শুধু স্কুলে নয়, পরে শোনা গেছে, সারা গ্রাম, সারা উপজেলায় আনুষ্ঠানিক, উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
আশির দশকের মাঝামাঝি মোবিনের সঙ্গে যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো, সেই মোবিন আবার ধূমকেতুর মতো উদয় হলো ঢাকায়। মোবিনের ফোন পেয়ে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। এ–কথা সে–কথার পর আমাকে একটি পানশালায় আমন্ত্রণ জানাল কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য। মোবিনের কথা অনুযায়ী আমি হাজির হলাম শীতের অপরাহ্ণে সেই পানশালায়। মোবিন আমাকে পরম বন্ধু জ্ঞান করে ডেকেছে। এ জন্য একটি সুখানুভূতিও কাজ করছে মনে।
আধো আলো, আধো অন্ধকার পানশালায় প্রাথমিকভাবে সে দুটি কোমল পানিয়ের অর্ডার দিয়ে আলোচনা শুরু করল। আলোচনার বিষয় হলো, করোনাত্তোর বাংলাদেশে অসংগতি, অনিয়ম যা আছে, তা দূর করার জন্য একটি ভিন্নরকম উদ্যোগের কথা বলা।
ছোট পরিসরে কাজ করে মোবিন অনেক সাফল্য পেয়েছে। এবার তরুণদের সঙ্গে নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা সুশাসনের অভাবকে দূর করতে প্রত্যয়ী মোবিন। সরকারি অনুমোদন নিয়ে, একটি সমাজ সেবামূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অধমকে ডাকার উদ্দেশ্য হলো, এই সংগঠনের আদর্শ, উদ্দেশ্য, কর্মকাণ্ড, নাম, লোগো—এগুলো নিয়ে প্রাথমিক ধারণা বিনিময়।
প্রথমেই সংগঠনের লোগো প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘লোগো কেন? সংগঠনের কর্মকাণ্ড ঠিক করো। আদর্শ, উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করে নেওয়া ভালো না? ”
মোবিন বলল, ‘লোগো ঠিক করলে দেখবে, বাকিগুলো সব পরিষ্কার হয়ে যাবে, স্ফটিক স্বচ্ছ। আমি কিন্তু ওর মতো স্ফটিক স্বচ্ছ হতে পারলাম না। একটি সংগঠন করতে হলে প্রথমেই লোগো নিয়ে ভাবব কেন?
মুখে বললাম, ‘ঠিক আছে। কেমন হবে লোগো, বলো?’
মোবিন খুব সুন্দর করে তার লোগোর ধারণা আমার সামনে তুলে ধরল। সংগঠনের লোগোতে দেখা যাবে, অনেক মানুষ মাথায় করে বাংলাদেশের মানচিত্র সূর্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আরেকটি ধারণা হলো, বাংলাদেশের মানচিত্রের সামনে সবুজের সমুদ্র, মানুষ সেই সবুজ সমুদ্রকে আঁকড়ে ধরে আছে।’
আমি বললাম, ‘তোমার ধারণা অসাধারণ। লোগো কিন্তু ছোট আকারের হয়ে থাকে, তোমার ধারণাকে ছোট আকারের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। আমার পরিচিত একজন চিত্রশিল্পী আছেন। তাকে দিয়ে এ কাজটি করানো যাবে।’
মোবিনের মুখে হাসি দেখা গেল। বলল, ‘ঢাকায় কি আমার বন্ধুর সংখ্যা কম? বুঝেছ, আমি কেন তোমার সঙ্গে আলোচনা করার জন্য মধ্যগ্রাম থেকে এসেছি।’
আমার মুখেও স্মিত হাসি।
আলোচনাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বললাম, সংগঠনের নামের ব্যাপারে কিছু ভেবেছ?
মোবিন বলল, ‘হ্যাঁ, ভেবেছি। নাম হবে, ‘নিউ নরমাল—একটি সমাজ উন্নয়ন সংগঠন। ‘নামটি উচ্চারণ করে আমার মুখের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকল। নামটি আমার পছন্দ হলো। আমি বললাম, নামটি ভালো। তবে লোকজন হয়তো, করোনা পরবর্তী নিউ নরমাল জীবনধারার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে পারে।
মোবিন তার উজ্জ্বল চোখে নিউ নরমালের একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিল। ‘করোনা পরবর্তী নিউ নরমাল হলো সব আগাছা, সব অসচ্ছতাকে দূর করে নতুনভাবে এগিয়ে যাওয়া। আমরা তো তাই করতে যাচ্ছি।’
আমি নিউ নরমালের কর্মকাণ্ড বোঝার জন্য কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই সংগঠনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বলো।
মোবিনকে খুব উদ্দীপ্ত মনে হলো, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, ফুল চার্জড। বলল, ‘দেখো, আমরা এই নিউ নরমালে সংগঠনের মাধ্যমে কিছু নিউ অ্যাবনরমাল কাজ করব।’
আমি বললাম, ‘এটা আবার কী?’ আমার চোখেমুখে রাজ্যের কৌতূহল ও বিস্ময়।
মোবিনের স্বতঃস্ফূর্ত জবাব, ‘করোনার পর পরই আমরা কাজ শুরু করব। তাই সব রকম স্বাস্থ্যবিধি মেনে বেশ কিছু সমাবেশ করব, এসব সমাবেশে ‘মাস্ট টু ডু’ কাজ হিসেবে থাকবে শপথ গ্রহণ।’
বিস্মিত হয়ে বলে উঠলাম, ‘শপথ গ্রহণ কেন? আর সমাবেশে অংশগ্রহণকারী কারা থাকবেন?
মোবিনের ঠোঁটের কোণে ফেলুদার মতো গোয়েন্দার হাসি। বলল, এসব সমাবেশে থাকবেন, প্রশাসনসহ সব বিভাগের নীতিনির্ধারকেরা। জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড়কর্তা, শীর্ষ ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, উচ্চপদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তারা।
মোবিন বলতে থাকল, আমরা সরকারের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করব। এসব সমাবেশের নাম হবে ‘শুভ সমাবেশ’, ‘শুভশক্তির সম্মেলন’। আমরা মনে করি, আমাদের সব আমলা, সব জনপ্রতিনিধি নীতিহীন নন। তাদের মধ্যে অনেক দেশপ্রেমিক, উচ্চনীতি জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ আছেন। তাদের সঙ্গে নেব। খুব ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে চাই। গ্লাসটি অর্ধেক খালি না বলে আমরা বলব গ্লাসটি অর্ধেক ভর্তি।
সমাজ সেবা সংগঠনের আয়োজন, সমাজের লোক কোথায়। সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি? আমার সরাসরি প্রশ্ন।
–অবশ্যই থাকবেন, তাঁরা উপস্থিত না থাকলে আয়োজনটি ইনক্লুসিভ হবে না, মোবিনের সুস্পষ্ট জবাব।
আমি বললাম, খুব উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা, এ রকম কি সম্ভব? সরকার কেন তোমাদের এ রকম আয়োজনের অনুমোদন দেবে।
প্রত্যয়ী মোবিন বলল, দেবে, বন্ধু দেবে। দিন শেষে ভালো ফলাফল হলে কেন দেবে না? আর আমরা তো ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মধ্য দিয়েই যাব। আমি সন্দেহের দোলাচলে দুলছি এবং মোবিনের কাছে মুখানুভূতি লুকোনোর চেষ্টা করছি।
মোবিনকে প্রত্যয়ী ও আস্থাশীল মনে হলো। বলল, প্রচুর মেধাবী ও দেশপ্রেমিক তরুণ আছে। তাঁরা সবাই টগবগে এবং কিছু করার জন্য উদ্গ্রীব। বোতলের মুখের ছিপি খুলে গেলে যেন, মোবিন বলতে থাকল, অংশগ্রহণকারী যারা আছেন, তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে নেব। সবার কাছে গ্রহণীয় উচ্চ মূল্যবোধ সম্পন্ন আমলা ও রাজনীতিবিদেরাও থাকবেন সমাবেশের সহায়তাকারী হিসেবে। তবে শপথ গ্রহণ করাবেন শিক্ষকেরা।
সমাবেশে আলোচনা হবে একটি বিষয় নিয়ে—‘প্রিন্সিপাল অ্যান্ড ভ্যালুজ অর্থাৎ নীতি ও মূল্যবোধ।’ অংশগ্রহণকারীরা শপথ গ্রহণ পর্যায় অবধি পৌঁছালে সমাবেশ শেষ হবে।
অংশগ্রহণকারীরা নীতি ও মূল্যবোধ কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন, তার পরিকল্পনা এবং শপথপত্র নিজেরাই রচনা করবেন। শপথপত্র রচনা হয়ে গেলে তাদের শিক্ষকেরা শপথ গ্রহণ করাবেন।
–বেশ কয়েক দিন সময় লাগবে, সময় কি পাওয়া যাবে? আমার প্রশ্ন।
মবিনের ধারালো জবাব, পেতেই হবে। এই সমাবেশের এজেন্ডার থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কী আছে দেশে?
ভেবে দেখো, নীতি মূল্যবোধের অভাবের পরও আমাদের অর্থনীতি কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আর যদি আমরা কিছুটা মূল্যবোধ সম্পন্ন হতাম, তাহলে কী হতো?
মোবিন এবার চায়ের অর্ডার দিল। বাইরে সন্ধ্যা নেমে আসছে, পানশালার পর্দার ফাঁক দিয়ে স্ট্রিট লাইটগুলোর উজ্জ্বল আলো দেখা যাচ্ছে।
ধূমায়িত চায়ের কাপ আমাদের সামনে।
দুজনেই তাকিয়ে আছি কাপের দিকে। মনে হচ্ছে, এখানে যারা বসে আছেন, সবাই একেকজন মোবিন। রাস্তা দিয়ে যারা হাঁটছেন, তারাও মোবিন। রাস্তায় যেন মোবিনেরা মিছিল করে এগিয়ে যাচ্ছেন।
দুজনে এখনো চায়ের কাপ ঠোঁটের কাছে নিয়ে আসিনি। কাপের উড়ে যাওয়া বাষ্পের দিকে চোখ। ইউটোপিয়ান ভাবনার সমাবেশ এবং মোবিনের শেষ কথা মাথার মধ্যে ঘুরছে, এই সমাবেশের এজেন্ডার থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কী আছে দেশে? ঢক ঢক করে দুজনেই দ্রুত ঠান্ডা চা খেয়ে ফেললাম।
হোক না ইউটোপিয়ান ভাবনা। এ রকম স্বপ্ন দেখতেই তো উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় স্বপ্নবাজ রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞানী এ পি জে কালাম। কী সুন্দর তাঁর উদ্দীপনা, স্বপ্ন দেখতে হবে। কারণ, স্বপ্নটা চিন্তায় পরিণত হয়। আর চিন্তা মানুষকে কর্মে অনুপ্রাণিত করে।
এক সময় চায়ের কাপ শূন্য হলো। আমরা ধীরে ধীরে স্বপ্নকে বুকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে থাকলাম। ঘোরের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি আর শুনছি, মোবিন নিম্ন অথচ দৃঢ় কণ্ঠে আবৃতি করছে, সুকান্তের ‘উদ্যোগ’ কবিতাটি,
‘বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত,
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।’