একটা নিজের মানুষ খুব দরকার
আমি একজন আপুকে চিনি, যিনি অনেক বেশি ক্রিয়েটিভ মনের। ফেলনা জিনিসপত্র দিয়ে তিনি দারুণ সব কাজের জিনিস বানাতেন, এমব্রয়ডারি করতেন, নকশিকাঁথা বানাতেন, কাপড়ের ওপর বিভিন্ন রকমের ডিজাইন করতেন নিজ হাতে। তরুণ একজন উদ্যোক্তা ছিলেন।
একটা মানুষ এত ক্রিয়েটিভ মনের হয়, তার সঙ্গে পরিচয় নাহলে জানা হতো না। একদিন আপুর সঙ্গে পরিচয় হলো, জানলাম আমরা একই শহরের। তারপর আরেক দিন এক আত্মীয়ের বাসায় একটা দাওয়াতে গিয়ে তাকে দেখে অবাক হই, তারপর জানতে পারি, তিনি আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়, কিন্তু যোগাযোগ কম ছিল বলে আগে জানতাম না তিনি কিংবা আমি।
তারপর নিয়মিত যোগাযোগ হতো, অনেকবার তার বাসায় গিয়েছি। তার ঘরের দেয়ালে, টেবিলে যেদিকে তাকাই, তার হাতের কারুকাজ দেখে মুগ্ধ হই। হ্যান্ড মেড জুয়েলারি, ওয়াল ডেকোর, কাঁথা, এমব্রয়ডারি বিছানা—কী নেই ঘরের মধ্যে। আমাকে তাকে বেশ কিছু কাজ গিফট করেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, একদিন তার কাজের এত এত বিস্তৃতি ঘটবে, একদিন দেশ–বিদেশে তার কাজ ছড়িয়ে যাবে। আপু কিন্তু চমৎকার আবৃত্তি করতেন, অল্পস্বল্প কবিতা লিখতেন। সর্বোপরি তিনি চমৎকার একজন মানুষ।
তারপর অনেক বছর যোগাযোগ হয়নি আপুর সঙ্গে। দেশে গিয়ে শুনলাম, বিয়ে হয়ে গেছে। আরও শুনলাম, তিনি সব কাজ বিয়ের কিছুদিন পর থেকে অফ করে দিয়েছেন।
তার স্বামী এসব পছন্দ করেন না, তাই এখন তিনি আর এসবে মন দেন না। একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছেন। যা–ই হোক, এরপর আর খবর নেওয়া হয়নি। গতবার যখন লকডাউনের সময় দেশে যাই, তখন সেই আত্মীয়ের ছোটখাটো একটা ঘরোয়া আয়োজনে গিয়ে আবার দেখা হয়। তখন তার পাশে সাত–আট বছরের একটা ফুটফুটে শিশুকন্যা। আপুর চেহারায় সেই আগের মতো নেই। ফরসা–উজ্জ্বল বর্ণের সেই চঞ্চলা আপুটি এখন বেশ শান্ত লাগছে। টেবিলের এক কোণে তিনি একটা চেয়ার পেতে বসে আছেন চুপচাপ। কোলে তার মেয়েটি বসে আছে। আশপাশের মানুষের আসা যাওয়া দেখছেন।
এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম।
এত দিন পর আমাকে এখানে দেখে আপু বেশ অবাক হলেন। কথায় কথায় আমাদের অনেক কথা হলো সেদিন।
আপুর কাছে থেকে তার গল্প শুনলাম। মাস্টার্স করেও আপুকে ভালো চাকরি করতে দেওয়া হয়নি। বিয়ের পর দুজন দুই জেলায় থাকা লাগে স্বামীর চাকরির জন্য। আপুকে নেওয়া হয়নি সঙ্গে নানা কারণে। মাঝেমধ্যে তিনি আসতেন কেবল গ্রামে, যেখানে আপু থাকেন। একদিন কোলজুড়ে এল ফুটফুটে একটা মেয়ে। সেই মেয়েকে নিয়েও কটূক্তি। তার স্বামীর চাওয়া ছিল একটা ছেলে। তিনি প্রতিনয়ত মানসিক, অর্থনৈতিক এমন কোনো কষ্ট নেই যে দেননি। মেয়ে হওয়ার পর মেয়ের খাবারের খরচ পর্যন্ত দিতে চাইতেন না। বাড়িতে আসা পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছেন।
এই যুগে একটা মানুষ এমন হয়, ভাবতেই কেমন লাগে।
আপু নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়েছেন। তার ক্রিয়েটিভিটি তিনি পছন্দ করেন না, কারণ এগুলো বিক্রি করতে গেলে অনেকের সঙ্গে কথা বলবেন আপু, এটা তিনি চান না। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেলে ডমিনেট করতে পারবেন না, তাই কোনো অবস্থাতেই আপুকে দাঁড়াতেই দেন না। সংসারের নিমিত্তে আপু সব মেনে নেন।
একটা সময় আপু জানতে পারেন, অন্য জেলায় তিনি অন্য মেয়েদের সঙ্গে চ্যাট করেন, প্রেম করেন, কথা বলেন। কিন্তু কিছুই করার নেই, নীরবে সব মেনে নেওয়া ছাড়া। আপু বলেন, ‘আমার সাহস নেই ভাই। একটা মেয়ের যখন কেউ পাশে এসে দাঁড়ায় না, তখন তার সাহস তলানিতে থাকে।’ ছয় মাস রাগ করে সেপারেশনে থাকেন এরপর। এই সময় প্রাইমারিতে জব হয়। সেটা নিয়ে আরও কটূক্তি। এই একটা কাজ আপু সাহসের সঙ্গে করছেন কেবল।
অতঃপর মীমাংসা হয়ে আবার স্বামীর সঙ্গে সংসার করছেন, তবে স্বামীর কথামতোই। তিনি আবৃত্তি করতেন, সেটা বন্ধ করে দিতে হয়েছে, হ্যান্ড মেড সব কাজ বন্ধ, এমনকি সেদিন শুনলাম, তিনি গান শিখেছিলেন, তা–ও করা হয়নি সংসারের জন্য।
সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আপু একটু সুখ খুঁজছেন। আদৌ সেটা তার হবে কি না, কে জানে। সারা শহরভর্তি মানুষ, ঘরভর্তি মানুষ, অথচ একটা নিজের মানুষ অনেকের হয় না।
আপু আশা করেন, একদিন সত্যি সব বদলে যাবে। নিজের মানুষটা সব বুঝতে পারবে। বিদায় নিয়ে যখন আসি তখন দেখতে পাই, কথা বলতে বলতে আপুর চোখভর্তি জল। সে জল তিনি আঁচলে মুছেন, পাশে যদি কেউ দেখে ফেলেন। মনটা ভারী হয়ে আসে। কেবল মনে হয়, একজীবনে মানুষের এত অপ্রাপ্তি কেন? কেন এত কষ্ট মানুষের। চিরকাল একটা মানুষের কাছে সব সুখ বন্ধক দিয়ে নিঃস্ব হয়ে আছেন, যাতে মেয়েটা তার মতো একা না হয়। যেন বাবা ছাড়া মেয়েটা একাকিত্ব ফিল না করে, সমাজে নিজেকে ছোট করতে না হয়। আসলে সবাই সাহসী হতে পারে না। অসংখ্য মেয়ে এ দেশে আছে, যারা এমন করেই নিজের সব বিসর্জন দিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখার প্রতিযোগিতা করছে। তবু কেউ হয়তো জিতে যায়, কেউ কেউ হেরে যায়।
একটা কবিতা দিয়ে ইতি টানি..
আমার একটা নিজের মানুষ দরকার,
বড্ড বেশি দরকার।
এই শহরে যখন রাত–বিরাতে ঝুমঝুম বৃষ্টি হবে
আমি তাকে নিয়ে ছাদে যাব,
তার হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজব।
এই আকাশ বাতাস, জলাশয় সব জানবে সেদিন
আমার একটা নিজের মানুষ আছে,
আমার একটা ভালোবাসার মানুষ আছে।
এই যে আমার সংসারে আমি ভীষণ রকম একা,
আমার রাত কাটে বিরহ ভরা তারা গুনে
একদিন আকাশজুড়ে শুকতারা আসবে
একদিন আমারও নিজের মানুষ হবে।
এই যে আমার এত কষ্ট, এত চোখে জল আসে,
একদিন আমার চোখের জল মুছে দেয়ার কেউ হবে,
সত্যি সত্যি আমার নিজের একটা মানুষ হবে।
একটা আপন মানুষ,
নিজের একটা মানুষ।