একজন নিভৃতচারী স্বপ্নদ্রষ্টা

চান্দাইকোনা হাজি ওয়াহেদ-মরিয়ম ডিগ্রি কলেজ
চান্দাইকোনা হাজি ওয়াহেদ-মরিয়ম ডিগ্রি কলেজ

স্বপ্ন পূরণের আগে একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখাটা জরুরি। স্বপ্ন সেটাই, যেটা মানুষের কল্পনায় থাকে। কল্পনাতো আর এমনি এমনি আসে না। বাস্তবে যদি তার এতটুকু অস্তিত্ব না থাকে তাহলে মানুষ সেই স্বপ্নটি দেখে না। আমাদের প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখতে হয়। স্বপ্ন দেখে বাঁচি, স্বপ্ন পূরণের আশায় আমরা অবিরাম কাজ করি। আর আমাদের জীবনে কিছু কিছু স্বপ্নদ্রষ্টার প্রয়োজন হয়। যারা স্বপ্ন দেখিয়ে বেড়ান। কেউ প্রকাশ্যে আর কেউবা অন্তরালে।

আমার ম্যাট্রিক পাসের পর প্রথম যেদিন চান্দাইকোনা হাজি ওয়াহেদ–মরিয়ম ডিগ্রি কলেজের করিডরে পা রাখলাম সেদিন একটি স্বপ্নের জন্ম হয়েছিল। গ্রাম থেকে আসা আমি। চান্দাইকোনা আমার অপরিচিত কোনো জায়গা ছিল না। আমার বড় বোনের বিয়ে হয়েছে সেখানে। প্রতিনিয়ত গিয়েছি। সেই সুবাদেই চান্দাইকোনা কলেজে ভর্তি হওয়া। বোনের বাড়িতে থেকে কলেজে পড়ব, এর চেয়ে মজার ব্যাপার আর কী হতে পারে। খুব মনে আছে। আমার প্রথম ক্লাস ছিল বায়োলজি। বলাই বাহুল্য বায়োলজি ছিল আমার ফোর্থ সাবজেক্ট। আমার শিক্ষক ছিলেন সামাদ স্যার। প্রথম ক্লাসে কী অদ্ভুত এক ভালো লাগা। আমি বিমোহিত হয়ে স্যারের কথাগুলো শুনছিলাম। প্রথম ক্লাস তাই তিনি বায়োলজি কোর্সের কোনো বিষয় নিয়ে পড়াননি। নিজের সম্পর্কে বলেছেন। আমাদের সম্পর্কে জেনেছেন। কী সুন্দর সহজ সরল উপস্থাপনা। আমাদের ক্লাসে সব মিলিয়ে ১৮ থেকে ২০ জন ছাত্র ছিলাম। সবাইকে এক এক করে তিনি জিজ্ঞেস করেছেন আমাদের স্বপ্নের কথা। কী বলেছিলাম মনে নাই। কিন্তু স্যারের প্রত্যেকটা কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, স্বপ্ন হলো a series of thoughts, images, and sensations occurring in a person's mind during sleep. কিন্তু সেই স্বপ্নের কথা তিনি বলছেন না। তিনি স্বপ্ন বলতে বোঝাচ্ছেন contemplate the possibility of doing something. স্যার বলেছিলেন, একটি, শুধু একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখ, সেই স্বপ্নকে পূরণ করবার জন্য মরিয়া হও। চেষ্টা কর, স্বপ্ন পূরণ হবেই।
সেই ক্লাসে স্যারকে অনেক প্রশ্ন করেছিলাম। তার বেশির ভাগই ছিল বায়োলজি সম্পর্কিত। তিনি খুব সুন্দরভাবেই আমার সব প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছিলেন। ক্লাস শেষ হওয়ার পরে কেন জানি তিনি আমাকেই তাঁর অফিসে নিয়ে গেলেন। আমার হাতে ঝকঝকে সুন্দর রঙিন মলাটের তিনটি বই দিলেন। তিনটা বইয়ের টাইটেল একই রকম। ইমিগ্রেশন টু কানাডা, ইমিগ্রেশন টু অস্ট্রেলিয়া ও ইমিগ্রেশন টু নিউজিল্যান্ড। হাতে দিয়ে বললেন, তোমার আরও স্বপ্নগুলোর সঙ্গে এটিকেও স্বপ্নের তালিকায় রাখতে পার। সত্যিকার অর্থে এর আগে আমি ইমিগ্রেশন সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। তিনি আরও বললেন, যদি তুমি একজন প্রফেশনাল হিসেবে ইমিগ্রান্ট হতে পার তাহলে নিজেকেও কিছু দিতে পারবে, নিজের দেশকেও দিতে পারবে। কিন্তু স্যার আমাকে কখনোই বলেননি, একজন বায়োলজিস্ট হতে অথবা মাইক্রোবায়োলজিস্ট হতে। কী জানি একটি স্বপ্ন সত্যিই দানা বেঁধেছিল আমার মনে সেদিন। আমি প্রতিনিয়ত ওই বইগুলো পড়তাম আর ভাবতাম আহা যদি যেতে পারতাম। এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। আমার ফোর্থ সাবজেক্ট নিয়েই আমার মূলত পড়ালেখা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে ভর্তি হলাম। অণুজীব বিজ্ঞানে মাস্টার্সের থিসিস করলাম। অণুজীব বিজ্ঞানেই ডক্টরেট করলাম টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচডির পরে জাপানে দুই বছর কাজ করলাম। খুব ইচ্ছে ছিল আমেরিকা যাব। ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে একটি জবের অফার থাকার পরেও ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে আমেরিকা যাওয়া হলো না। কিন্তু সে বছরই আমার ভাগ্য আমাকে অবাক করে দিয়ে একই সঙ্গে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া দুই জায়গা থেকেই পোস্ট ডকের অফার পেলাম। শেষ পর্যন্ত কানাডাকেই বেছে নিলাম। এই যে পথচলা, সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমা, এর পেছনে কিছু স্বপ্ন কাজ করেছে সব সময়। উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, গবেষণার জন্য সুন্দর একটি প্ল্যাটফর্ম এসব। কিন্তু এসবের পরেও আমার সব স্বপ্নকে ছাপিয়ে আমার স্বপ্নদ্রষ্টা প্রিয় সামাদ স্যারের দেখানো স্বপ্নটি সবচেয়ে বেশি মটিভেশনাল ফোর্স হিসেবে কাজ করেছে বলে আমি মনে করি।
স্যারকে আমি মনে করি। সব সময়ই মনে করি। আমার গবেষণা সংক্রান্ত যেকোনো কাজেই স্যারকে আমি অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে দেখতে পাই। যদিও কলেজজীবন শেষ করার পরে কয়েকবার দেখা হওয়া ছাড়া স্যারের সঙ্গে আমার খুব একটা যোগাযোগ হয়নি। আমার মনে হয় আমার আজকের এই অবস্থানের পেছনে স্যারের সেই স্বল্প সময়ের সান্নিধ্যর ভূমিকা অপরিসীম। আমার সেই উর্বর মনের কোমল মাটিতে সামাদ স্যারের বপন করা স্বপ্নের বীজটি অঙ্কুরিত হয়ে শাখা প্রশাখা বিস্তার করে আজ ফুলে ফলে সুশোভিত। কিন্তু স্যার কি সেটা জানেন? হয়তো জানেন না। কারণ স্বপ্নদ্রষ্টারা সেটা জানেন না। তাদের কাজ হলো স্বপ্ন দেখানো। কাউকে সুন্দর ও সত্যিকারের একটি স্বপ্ন দেখানো কোনো সহজ কাজ নয়। আমার জীবনে সামাদ স্যার সেটা পেরেছেন। অনেক দিন স্যারের সঙ্গে দেখা হয়নি। স্যারকে বলা হয়নি, আপনার দেখানো স্বপ্নের পথে আমি হেঁটেছি, এখনো হাঁটছি। সেই স্বপ্নটিকে আমি একান্তই আমার করে নিয়েছি। আমি সেখানে কিছুটা হলেও পৌঁছতে পেরেছি, যদিও যেতে হবে আরও দূরের পথ। স্যার, আপনাকে ধন্যবাদ।