এই লজ্জা সবার

কলম্বিয়া জার্নালিজম স্কুলে আমার কোর্সের মেজর ছিল অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। সেখানে কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে হয় তা নিয়ে পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া প্রতিবেদকদের ক্লাস করার সুযোগ হয়েছিল। সোর্স কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে উদাহরণ তুলে ধরেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথিতযশা সাংবাদিকেরা। এ ক্ষেত্রে একজনের নাম বলতেই হয়, ডেভিড ফাহরিনহোল্ড। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আর্থিক দুর্নীতির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন তিনি। যে প্রতিবেদনের কারণে ট্রাম্প ফাউন্ডেশন বন্ধ হতে বাধ্য হয়। ট্রাম্পের নারী কেলেঙ্কারি, অবৈধ শ্রমিকদের ট্রাম্প হোটেলে কাজ করার তথ্যও চলে আসে সেখানে। আর এই প্রতিবেদনের কারণেই ২০১৭ সালে পুলিৎজার পুরস্কার পান ডেভিড।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটা খুব সাধারণ খবর। তবে মজার তথ্য হলো—ওয়াশিংটন পোস্ট ও এনবিসি নিউজের এই সাংবাদিক ট্রাম্পের আর্থিক অনিয়মের অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন ছোট্ট একটি ঘটনা থেকে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইওয়া ককাসের নিউজ করতে গিয়েছিলেন ডেভিড। তখন রিপাবলিকান শিবিরে বড় বড় তারকা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে। টেড ক্রুজ, মার্কো রুবিও, বেন কার্সন, জেব বুশ, মাইক হাকাবি, ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ ডজনের বেশি প্রার্থী। অফিস থেকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডেভিডকে পাঠানো হলো ট্রাম্পের দিক খেয়াল রাখতে। ট্রাম্প তখন প্রার্থী হিসেবে পেছনের দিকের তারকা। যাই হোক, মন খারাপ নিয়ে নিউজ করতে যাওয়া ডেভিডের প্রধান কাজ হচ্ছে ট্রাম্পকে অনুসরণ করা। সে সময় একটি নির্বাচনী সমাবেশে ট্রাম্প এক মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেন একটি বড় সংগঠনকে। চেকে দেওয়া এই অর্থ সহায়তা বেশ ঘটা করেই করেন ট্রাম্প। চেকের নিচে লেখা ট্রাম্প ফাউন্ডেশন। হার্ভার্ড থেকে পড়া ডেভিড এখানেই পেয়ে যান তাঁর প্রতিবেদনের উৎস।

বেশ কয়েকটি প্রশ্ন আসে ডেভিডের মাথায়। এক. নির্বাচনে এভাবে ঘটা করে অর্থ বরাদ্দ করার ঘটনা বিরল। দুই. ট্রাম্প ফাউন্ডেশনের কাজ কী? তিন. কেন একটি সংগঠনকে এক মিলিয়ন ডলার দেওয়া হলো? চার. আর ট্রাম্প কি এতই ধনী যে নির্বাচনী সমাবেশে এভাবে এক মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া তাঁর জন্য কিছুই না!

ওই নির্বাচনে টেড ক্রুজ জয়ী হন। মিথ ছিল, আইওয়া ককাসে রিপাবলিকান যে প্রার্থী জয়ী হোন তিনিই দল থেকে টিকিট পান। ট্রাম্প দ্বিতীয় হয়েছিলেন। তাই মনোযোগ ট্রাম্পের দিকেও আসে। তবে ওয়াশিংটন ফিরে এসে ডেভিডের আগ্রহ আর আইওয়া ককাসের ফলের দিকে নেই। তাঁর মনে আসা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে চান তিনি। ট্রাম্পের চেয়ে ট্রাম্প ফাউন্ডেশনের দিকে মনোযোগ দিতে চান শুরুতে। বিষয়টি সম্পাদককে বললে, সম্পাদক রাজি হলেন। কিন্তু সময় প্রয়োজন অনেক। শুরু করলেন ট্রাম্প ফাউন্ডেশন দিয়েই। কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেলেন মজার তথ্য। নন প্রফিট চ্যারিটেবল এই অর্গানাইজেশন ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর সর্বোচ্চ অর্থ সহায়তা দেওয়ার রেকর্ড এক হাজার ডলারের নিচে। তবুও সেটি দিয়েছিলেন তাঁর ছেলের বয়েজ স্কাউটে। সেই সংগঠনটি কীভাবে এক মিলিয়ন ডলার দিল—প্রশ্ন আরও ঘনীভূত হতে থাকে। তিনি সেই সংগঠনের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলেন। এই কাজ খুব সহজ ছিল না। সহায়তা নিলেন টুইটারের। টুইট করলেন সংগঠনের নাম ঠিকানা প্রয়োজন। দুই সপ্তাহ পর একজন উত্তর দিলেন, তিনি সেই সংগঠনের একজন কর্মরতা। তবে ট্রাম্প ফাউন্ডেশন ঘটা করে ক্যামেরার সামনে চেক দিলেও সেই অর্থ তখনো তাঁদের হাতে পৌঁছায়নি। যোগাযোগ করলেন ট্রাম্পের প্রচারণা দলের সঙ্গে। ক্যাম্পেইন ম্যানেজার বললেন, অর্থ সংগঠনটি পেয়ে যাবে। আর এই এক মিলিয়ন, দুই মিলিয়ন অর্থ সহায়তা দেওয়া ট্রাম্প ফাউন্ডেশনের জন্য ডাল-ভাত।

ট্রাম্পের ম্যানেজার মিথ্যা বলেছেন, তাঁর হাতে থাকা তথ্য উপাত্তের সঙ্গে তাঁর কথা মিলছে না। এক সপ্তাহ পরও যখন ওই সংগঠনটি যখন অর্থ পাচ্ছিল না, তখন আবার যোগাযোগ করলেন ট্রাম্পের প্রচারণা দলের সঙ্গে। তবে এরপর যার ফোন আসে তা খুবই অপ্রত্যাশিত ছিল ডেভিডের কাছে। ট্রাম্প ফোন করেছেন নিজেই। এক ধরনের হুমকি দিয়েই বলেন, রাজনৈতিক রিপোর্টার, রাজনীতি নিয়েই থাকুক না। সংগঠন নিয়ে এত মাথা ব্যথা কেন? তবে ট্রাম্প ফোন করার পর সংগঠনটি জানায়, তারা অর্থ পেয়েছে।

ডেভিড এখানেই থামতে চাননি। ট্রাম্প হোটেল, সুন্দরী প্রতিযোগিতা, নারী কেলেঙ্কারি, একের পর এক তথ্য বের করে আনেন। যার ফলে ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকার সময়েই আদালতের রায়ে ২০১৯ সালে ট্রাম্প ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এতগুলো তথ্য দেওয়ার কারণ হলো—ক্লাসে ডেভিডের একটি বাক্য আমাকে খুব মুগ্ধ করেছিল। তিনি বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা একদমই যখন ছিল না ট্রাম্পের, সেই সময় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করা শুরু করেছিলেন। প্রতিবেদনের আগ্রহ আরও বেড়ে যায় যখন ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন। কারণ একজন প্রেসিডেন্টের একটি সংগঠনের দুর্নীতি তদন্ত করে প্রতিবেদন তৈরি করতে তিনি আরও উৎসাহ পেয়েছিলেন।

হয়তো যুক্তরাষ্ট্র বলেই ডেভিড এত উৎসাহ পেয়েছিলেন একজন প্রেসিডেন্টের ৩০ বছরের পুরোনো একটি চ্যারিটেবল সংগঠনের দুর্নীতির খবর প্রচার করার সাহস দেখিয়ে। ডেভিডের অফিস থেকে চাকরি হারানোর ভয় ছিল না, আমলাতান্ত্রিক চাপ ছিল না। পরে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পান। তিনি এখন তাঁর এই অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আর আমরা? আমাদের কাছে সাংবাদিকতা করা যেন সবচেয়ে সহজ কাজ এখন? চাটুকারদের দখলে আমাদের সমাজে একজন রোজিনা ইসলামের গলা চেপে ধরার সাহস একজন আমলা দেখাতেই পারেন। কারণ তাঁর সরকারি চাকরি। তাঁর চাকরি হারানোর ভয় যেমন কম, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তাও নেই। আর আমাদের? প্রতিবাদ হবে? বিক্ষোভ হবে? দিন শেষে কেউ কেউ পিছুটান দেবে।

এই লজ্জা আমার, আপনার, আমাদের। যারা এখনো এই পেশাকে ভালোবেসে বেঁচে আছি।