ইতির জন্য কান্না

প্রতীকী ছবি। অলংকরণ: তুলি
প্রতীকী ছবি। অলংকরণ: তুলি

ভাইয়া প্লিজ, এক টান দিয়ে একটু কলেজে নামিয়ে দিয়ে আয় না, প্লিজ। ইতি অনেকক্ষণ ধরেই রাজুকে অনুনয়-বিনয় করছে। কিন্তু রাজুকে ওঠাতে পারছে না। কারণ রাজু টিভিতে বাংলাদেশ-ভারত ক্রিকেট খেলা দেখছে। ক্রিকেট খেলা হলে সে নাওয়া খাওয়া সব ভুলে যায়। আর সে খেলা যদি হয় বাংলাদেশের, তবেতো কথাই নেই। প্রত্যেকটি বলই তার দেখতে হবে।
ইতি রাজুর একমাত্র ছোট বোন। পরিবারের সকলের চোখের মণি। এবার উপজেলা সদরে মহিলা কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। ওদের গ্রামের বাড়ির কয়েক শ গজ সামনে দিয়ে ব্যস্ততম সড়ক চলে গেছে। সারাক্ষণই সেখান দিয়ে বাস–টেম্পো চলাচল করছে। ইতি ওখান থেকেই কখনো বাসে, কখনো টেম্পো করে কলেজে যায়। আবার একইভাবে ফেরত আসে। কিন্তু প্রত্যেক দিন কলেজে যাওয়ার সময় ইতি বায়না ধরে, রাজু যেন তাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে আসে। কারণ রাজুর একটা মোটরসাইকেল আছে। আর মোটরসাইকেল চড়া ইতির সবচেয়ে পছন্দের। চলন্ত মোটরসাইকেলে দুরন্ত হাওয়া যখন ইতির চোখ মুখ ছুঁয়ে যায়, চুলগুলো হাওয়ায় ওড়ে, তখন ইতির নিজেকে মনে হয় আকাশে উড়ে বেড়ানো কোনো পরি। আর এই লোভেই বারবার মোটরসাইকেলে চড়ার বাহানা খোঁজে। রাজুও বোনের এই ভালো লাগার কথা জানে। তাই অধিকাংশ দিন সকালে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিরক্তি নিয়েও ইতিকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে আসে। কিন্তু আজ খেলা ছেড়ে রাজু কিছুতেই যেতে চাইছে না। তাই সে ইতিকে বলল, তুই এখন বাসে করে যা, আমি তোকে কলেজ শেষে নিয়ে আসব।

আমি জানি তুই কলেজ শেষে যাবি না। তুই এখনই আমাকে নিয়ে যাবি। আমি এখন বাসে করে গেলে দেরি হয়ে যাবে। প্লিজ চল না।
তুই কিন্তু এখন আমাকে বিরক্ত করছিস। আমি এখন খেলা ফেলে যাব না। একটু উচ্চ স্বরেই রাজু কথাগুলো বলল।
ঠিক আছে তোর যেতে হবে না। তোর মোটরসাইকেলে আর কখনোই উঠব না। বলেই ইতি চোখ মুছতে মুছতে রুম থেকে বের হয়ে গেল। এই মেয়েকে নিয়ে এই এক সমস্যা। বাসার সবার আদর পেয়ে পেয়ে এমন হয়েছে যে, কিছুই বলা যায় না। সম্ভবত ইতির চোখের মধ্যে নায়াগ্রা লুকানো আছে। জোর গলায় কিছু বললেই চোখ দুটো দিয়ে অঝোরে পানি ঝরতে থাকে। ইতি রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মুহূর্তেই রাজুর মা রুমে ঢুকলেন। ঢুকেই চিৎকার করতে শুরু করলেন।
আমার মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে কলেজে যাচ্ছে, আর তোর কাছে খেলা বড় হলো। বন্ধ কর টিভি। যা ওকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে আয়।
রাজু ভেবে দেখল এখন আর বসে থাকা সম্ভব নয়। এখন না গেলে মায়ের চিৎকার চেঁচামেচিতে ওর খেলা দেখার বারোটা বেজে যাবে। তার ওপর আবার ইতি কাঁদছে। তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হলো। বড় রাস্তায় এসে দেখল ইতি বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
ওঠেন মহারানি সাহেবা। ইতির সামনে মোটরসাইকেল থামিয়ে রাজু বলে উঠল।
আমি তোর সঙ্গে যাব না। তুই তোর খেলা দেখ, যা।
আমি সরি। দেখ আর ভেজাল করিস না। সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার কাছে নাই। তোকে তাড়াতাড়ি নামিয়ে দিয়ে এসে খেলা দেখতে হবে। এমনিতেই অনেকগুলি বল মিস হয়ে যাচ্ছে।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ইতি কারও ওপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারে না। বিশেষ করে রাজুর ওপর তো নয়ই। ইতি মুচকি একটি হাসি দিয়ে মোটরসাইকেলের পেছনে উঠে পড়ে। এক হাতে রাজুর কাঁধ ধরে বসে। রাজু হেলমেটের গ্লাসটা নামিয়ে মোটরসাইকেল টান দেয়। বাতাসে ইতির চুলগুলো উড়তে থাকে। রাজু মোটরসাইকেলের গতি বাড়িয়ে দেয়। রাজু সাধারণত বেশি গতিতে মোটরসাইকেল চালায় না। কিন্তু আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এসে খেলা দেখতে হবে, যার কারণে গতি বাড়াতে থাকে। সাঁ সাঁ শব্দে বাতাস কেটে মোটরসাইকেল ছুটে চলছে। বাতাসের তীব্রতায় ইতি চোখ খুলে রাখতে পারছে না। কিন্তু ইতির খুবই ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে সে হাওয়ায় ভাসছে। রাজু প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়ে সারাক্ষণ আসা যাওয়া করে। এই রাস্তার প্রতিটি ইঞ্চি তার মুখস্থ। অথচ তাড়াহুড়া করতে গিয়ে ভুলেই গেল সামনে একটা স্পিড ব্রেকার আছে। যখন নজরে এল ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবুও চেষ্টা করল মোটরসাইকেলের গতি কমিয়ে নিরাপদে স্পিড ব্রেকার পার হতে। একটি ছোটখাটো জাম্প দিয়ে রাজু মোটরসাইকেল নিয়ে স্পিড ব্রেকার পার হয়ে গেল। অনেক কষ্টে মোটরসাইকেলের ব্যালেন্স ঠিক রাখল। কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি বলে মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিল। স্পিড ব্রেকার পার হয়ে একটু যেতেই হঠাৎ রাজু খেয়াল করল ওর কাঁধে ইতির হাত নেই। পেছনের সিটে ইতি নেই। জাম্প দিয়ে স্পিড ব্রেকার পার হওয়ার সময় ইতি যে মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গেছে সেটা রাজু বুঝতেই পারেনি। কড়া ব্রেক করে মোটরসাইকেল থামিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল ইতি রাস্তার ওপর পড়ে আছে। কপাল ভালো পেছনে কোনো গাড়ি ছিল না। মোটরসাইকেলটি রাস্তার পাশে ফেলে রাজু ইতির দিকে দৌড় দিল। ইতি রাস্তার ওপর নিথর হয়ে পড়ে আছে। ইতিকে নাম ধরে কয়েকবার ডাকাডাকি করল। কিন্তু ইতির কোনো সাড়া শব্দ নেই। রাজু বোনকে পরম মমতায় কোলে তুলে নিল। ইতিমধ্যে আশপাশে অনেক লোকজন জড়ো হয়ে গেছেন। তাদের সহায়তায় বোনকে নিয়ে আসে হাসপাতালে। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলেন, দুঃখিত।
ডাক্তার সাহেব আপনি এসব কি বলছেন? বাংলা সিনেমার মতো ডায়ালগ দেবেন না। কোথাও কাটেনি, ছেঁড়েনি, একটুও রক্ত বের হয়নি, আর আপনি বলছেন দুঃখিত। আপনি আবারও পরীক্ষা করেন। আমার ধারণা ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। প্লিজ ডাক্তার। আপনি বলেন তো আমি ঢাকা নিয়ে যাই। এক নাগাড়ে চিৎকার করে কথাগুলো বলে রাজু। ডাক্তার রাজুর সন্তুষ্টির জন্য আবারও পরীক্ষা করেন। কিন্তু ফলাফল একই। রাজুর দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ওর কিছুতেই বিশ্বাস হয় না ইতি নেই। মনে হচ্ছে ইতি ওকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য নিশ্বাস বন্ধ করে চুপ করে আছে। হয়তো এখনই চোখ খুলে বলবে, ভাইয়া দেখলি তো কেমন ভয় পাইয়ে দিলাম। কিন্তু না ইতি চোখ খোলে না।
আসলে আঘাতটা লেগেছে মাথায়। মাথায় হেলমেট থাকলে হয়তো ইতি এভাবে চলে যেত না। ইতি কখনোই হেলমেট পরতে চাইত না। ও বলত হেলমেট পরে মোটরসাইকেলে উঠলে, মোটরসাইকেল চড়ার মজাটাই নষ্ট হয়ে যায়। কারণ তখন দুরন্ত বাতাসগুলো ঠিকমতো চোখে মুখে লাগে না, চুলগুলো বাতাসে ওড়ে না। বাসার সবাই ওকে বারবার বলেও হেলমেট পরাতে পারেনি। একবার রাজু বলেছিল, দেখ বলাতো যায় না কখনো যদি অ্যাকসিডেন্ট হয়, তখন? নিরাপত্তার জন্য হেলমেটটা জরুরি।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

উত্তরে ইতি বলেছিল, আমি যার তার সঙ্গে মোটরসাইকেলে উঠি না। আমি আমার ভাইয়ের সঙ্গে মোটরসাইকেলে উঠি। আমার ভাই হচ্ছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষ পাইলট। যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভরসা করি। ওপরে আল্লাহ, নিচে আমার ভাই।
ইতি মজা করে রাজুকে বলত পাইলট। আর রাজুর ওপর ইতির ছিল অগাধ ভরসা। অথচ সেই বোনকে রাজু আজ নিজ হাতে হত্যা করল। শুধুমাত্র ক্রিকেট ম্যাচ দেখার জন্য! চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। চারদিকটা বনবন করে ঘুরতে থাকে। এরপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হারায় রাজু।
ইতি মারা গেছে আজ প্রায় চার মাস হলো। রাজু এখন আর ক্রিকেট খেলা দেখে না। যেদিন ইতি মারা যায়, সেদিনই রাজু টেলিভিশন ভেঙে ফেলেছে। ওদের বাসায় এখন আর কোনো টেলিভিশন নেই। ইতি মারা যাওয়ার পর থেকে প্রত্যেক দিন সকালে কলেজ টাইমে রাজু মোটরসাইকেল নিয়ে ইতির কলেজে যায়। তারপর কলেজের সামনেই বসে থাকে। আবার কলেজ ছুটি হলে বাড়ি ফেরে। ওর আচরণ দেখলে মনে হয়, সে বোনকে কলেজে আনা নেওয়া করছে। সমস্যা হচ্ছে কলেজে যাওয়া ও আসার পথে রাজু মোটরসাইকেল চালিয়ে যায় না। হেঁটে হেঁটে মোটরসাইকেল ঠেলে নিয়ে যায় আবার ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসে। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কেন মোটরসাইকেল ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন। বলে পেছনে ছোট বোন বসা, ও পড়ে যাবে। এই কাঠফাটা গরমে মাথায় হেলমেট পরে পাঁচ কিলোমিটার মোটরসাইকেল ঠেলে নিয়ে যেতে আসতে দরদর করে ঘামতে থাকে। অনেকেই বলে ছেলেটা পাগল হয়ে গেছে। রাজু এসব গায়ে মাখে না। কিন্তু রাজুর বাবা–মা এসব দেখে শুনে নীরবে কাঁদেন।
ইতি সব সময় বলত, এ বাড়ি ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। রাজু বলত, বিয়ে করবি না? বিয়ে হলে তখন কি করবি?
আমি বিয়েই করব না। আর বিয়ে যদি করতেই হয়, তাহলে এমন ছেলে খুঁজে আনবি যে ঘরজামাই থাকবে। বাসার সবাই ইতির কথায় হাসত। কিন্তু রাজু জানত ওর বোন মজা করছে না সত্যি বলছে। তাইতো রাজু জোর করে ওদের বাড়ির উঠোনে ঠিক মাঝ বরাবর ইতিকে কবর দিয়েছে। এলাকার সবাই বলেছিল গ্রামের কবরস্থানে কবর দিতে। রাজু কারও কথা শোনেনি। এখন আর ইতিকে এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে হবে না। আল্লাহই ওর আশা পূর্ণ করে দিয়েছে। ইতি ছোটবেলা থেকেই অন্ধকারকে ভয় পায়। রাতে রুমের বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাত। এখন ইতি অন্ধকারে ঘরের বাইরে একাকী কীভাবে থাকবে। সে জন্য রাজু ইতির কবরের চারদিকে খুঁটির সাহায্যে বাতি ঝুলিয়েছে। আর কবরের পাশে একটি চৌকি পেতেছে। রাজু সারা রাত ওই চৌকিতে বসে বা শুয়ে থাকে। সারা রাত কবরের দিকে তাকিয়ে বোনের সঙ্গে কথা বলে। কথা বলতে বলতে কখনো হাসে, কখনো কাঁদে।
আজ ইতির জন্মদিন। ইতির মৃত্যুর পর এটাই প্রথম জন্মদিন। ইতি বেঁচে থাকতে এই দিনটা খুবই আনন্দে কাটাত পুরো পরিবার। আজ পুরো বাড়ি রাজু নিজ হাতে সাজিয়েছে। ডেকোরেটর আনিয়ে আলোকসজ্জা করেছে।। আলোর বন্যা বইছে যেন পুরো বাড়িতে। যে কেউ দেখলেই ভাববে আজ এ বাড়িতে কারও বিয়ে হচ্ছে। বিশাল কেক আনা হয়েছে। ইতির কবরের পাশেই কেক কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাউকেই দাওয়াত দেওয়া হয়নি। শুধু বাবা-মা ও রাজু। রাজু ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে নিজেই কেক কাটে। নিজেই বেসুরো গলায় গায়, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ...। বাবা-মাও রাজুর সঙ্গে গলা মেলান। ওদের গান শুনে মনে হচ্ছে গান নয় তিনজন মানুষ করুন সুরে কাঁদছেন। রাজু সুন্দর করে এক পিস কেক কেটে পিরিচে করে ইতির কবরের ওপর রাখে। বলে, পুরাটাই খাবি। আজ ডায়েটের চিন্তা করবি না। একটু থামে রাজু। এরপর আবার বলা শুরু করে। এবার রাজুর কণ্ঠ ধরে আসে, কিরে ভাইয়াকে খাওয়াবি না? দে না ভাইয়াকে একটু খাওয়ায়ে। দে না বোন, প্লিজ। প্লিজ। শুধু একবার। শুধু একবার। আর বলতে পারে না। ডুকরে কেঁদে উঠে। অঝোরে অশ্রু ঝরতে থাকে দুই চোখ থেকে। এসব দেখে ওর বাবা–মাও ঠিক থাকতে পারেন না। তিনজনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। ইতি কি দেখছে তিনজন অসহায় মানুষ কীভাবে কাঁদছে তার জন্য। কে জানে হয়তো ইতিও এখন কাঁদছে।
বি. দ্র.: নিরাপদ সড়ক চাই, এ দাবি তো অনেক করেছি। আসুন না এবার নিজেরাই সতর্ক হই। নিজেকে ও নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে আপনাকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল নয়। ইতিদের ছাড়া নয়, ইতিদের নিয়েই জন্মদিন পালন করতে চাই। শুধু সময় নয়, সবকিছুর চেয়েই জীবনের মূল্য অনেক বেশি।