আশায় আশায় দিন যায়, আশা পূরণ হয় না

স্ট্রবেরি খেত
স্ট্রবেরি খেত

বলাই বাহুল্য কানাডার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ঋতু হচ্ছে গ্রীষ্ম (সামার)। সাত-আট মাস চক্ষু জমাট বাঁধানো শীত থাকলে সেখানে গ্রীষ্মকালকে তো প্রকৃতির আশীর্বাদ হিসেবে সবাই নেবেই? তীব্র শীতের হাড়কাঁপুনি যন্ত্রণা থেকে গ্রীষ্মের উঁকিঝুঁকি শুরু হতেই এখানকার লোকজনগুলো যেন তাদের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। বিভিন্ন আউটডোর অ্যাক্টিভিটিজে সমস্ত দেশ মেতে ওঠে! এর সঙ্গে আবার বোনাস হিসেবে যুক্ত হয় দুই মাস স্কুলের বন্ধ। সব পরিবারই তখন ছেলেমেয়েসহ বেড়ানোর জন্য এদিক-ওদিক যাওয়ার প্ল্যান করেন। এমনকি সন্তানহীন পরিবার কিংবা একক ভাবেও অনেকে ছুটি উপভোগ করে থাকেন। আর এই সুযোগে পিক সিজনের নাম করে এয়ার লাইনসগুলো টিকিটের দাম বাড়িয়ে দেয়। অনেকটা বাংলাদেশের ঈদ মৌসুমে দূরপাল্লার বাসের মতো আর কি! মওকা যাকে বলে। অধিকাংশ ভ্রমণপিয়াসী এসব মওকা টওকার ধার না ধেরে কিংবা গ্যাড়াকলে ফেঁসে গিয়ে ঘর হতে বেরিয়ে পড়েন।
আমার ব্যাপারটি অবশ্য ভিন্ন। এমনিতে আমার কাজের ধরনটাই হচ্ছে একটা ভেজাইল্লা কিছিমের। শনি-রবির উইকএন্ডসহ সরকারি ছুটিগুলিতে ছুটি হয় স্বাভাবিক নিয়মেই। কিন্তু ভ্যাকেশনের চিন্তাভাবনা মাথায় আসলে মাথা শুধু ঘোরে আর ঘোরে। ডাহুক পাখির ডিম ফোটানোর মতোই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ম্যানেজ করতে হয়। সপ্তাহ খানেক না হয় ম্যানেজ করা যায়, কিন্তু এটাকে দুই সপ্তাহ করতে গেলেই আমের সঙ্গে ছালাটি খোয়ানোর একটা সমূহ সম্ভাবনার ঝুঁকি উঁকিঝুঁকি মারা শুরু করে। এক মাস কিংবা দুই মাসের কথা চিন্তার মধ্যেই ধরা দেয় না।
এই অবস্থায় দেশে আসলে এক সপ্তাহ তো শীতের পাখির মতো আসতে যেতে পাখা মেলে শূন্যে উড়াল দিয়ে চলে যাবে। এত দূর থেকে এসে এক সপ্তাহে পোষায় না বলেই ততটা আগ্রহ পাই না দেশ ভ্রমণের। তারপরেও দুই একবার দুই সপ্তাহের জন্য নিমরাজি মনোভাব নিয়ে চেষ্টা করি। যতবার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে দেশে আসার প্ল্যান করি ততবারই পরিচিত ট্রাভেল এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলি। কথাটথা বলার পর ইনিয়ে-বিনিয়ে যতই বলি ভাই অফ সিজনের প্রাইসটা দাও না! চক্ষু বিস্ফোরিত করে ভয়ার্ত কণ্ঠে যা বলে তার সারমর্ম হলো, ভাই! কন কি আপনে? আমি কি আমার জমি বিক্রি কইরা আপনেরে অফ সিজনের প্রাইস দিমু?

এর পর আর কি কথা থাকতে পারে? হতাশ আমি প্রাইস নিয়ে উইন্ডো শপিং করি। সবাই বলে সবচেয়ে কম প্রাইসের টিকিট দেবে, কিন্তু আমি আর কম খুঁজে পাই না। এদের কাছে যেটা কম আমার কাছে সেটাকেই রকি পর্বতমালার সমান বড় মনে হয়। যারা একটু নামীদামি ব্যস্ত এজেন্ট তাদের তো আবার ঠাট বাঁট-ই আলাদা। এদের কাছে ফোন করলে এরা গ্রিটিংসটা অনেকটা ফাস্ট ফরোয়ার্ড টেপ রেকর্ডারের মতো কিলবিল করে কোনোরকম তোতা পাখির মতো উচ্চারণ করে হোল্ড অন প্লিজ বলেই বোধ হয় বসে বসে অন্যদের সঙ্গে খাজুরে আলাপ জুড়ে দেয়। ধৈর্যের ট্যাবলেট, ক্যাপসুল খেয়ে দীর্ঘক্ষণ কানের সঙ্গে ফোনটি লাগিয়ে রেখে একটানা বেসুরো মিউজিক আর তাদের কোম্পানির বিজ্ঞাপন শুনে কান ঝালাপালা করে যদিও বা কারও সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয় কিন্তু দেখা যাবে আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নিজে নিজেই গড়গড় করে বলে যাবে ট্রাভেল ডেট, কতজন যাত্রী, গন্তব্য কোথায়? আমি বলি ঢাকা যাব সস্তা রেট দাও। ওপাশ থেকে বলে বুকিং দাও তা হলে সস্তা টিকিট দেব। আমি বলি আগে সস্তা প্রাইস পরে বুকিং। আরও বলি অফ সিজনের দাম দাও, আমাকে বলে আমাদের ওয়েভ সাইটে গিয়ে প্রাইস দেখো, আমার হাতে একদম সময় নাই, স্যরি হ্যাভ এ নাইস ডে বলেই লাইন কেটে দেয়।
পোড় খাওয়া অভিজ্ঞ সেলসম্যান তো! হয়তো বুঝতে পেরেছে এখানে বিজনেস হবে না। অযথাই সময় ক্ষেপণ। তার চেয়ে আলোচনা দীর্ঘায়িত হওয়ার কোনো সুযোগ না দিয়ে দ্রুত সরাসরি ফোন হ্যাং আপ। তাই আর দেশে যাওয়া হয় না। অবশ্য গনি মিয়ার মতো আসতে চাইলে প্রতি এক দুই বছর পর পরই সপরিবারে এসে খুব আমোদপ্রমোদ করে বেড়িয়ে যেতে পারতাম। এমনিতেই গাড়ির ইন্স্যুরেন্স, বাড়ির মর্টগেজ আর এই বিল ওই বিলসহ ইউটিলিটিজ বিল টানতে টানতে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। তার ওপর প্লাস্টিক কার্ডের ঘষাতে যে আলাদিনের দৈত্য তৈরি করব তাকে সামাল দেওয়ার কথা ভাবতে ভাবতেই দেখি সেবারের মতো সিজন পার হয়ে গেছে। আশায় বুক বাঁধি, সামনের বার আসব বলে। আর মনে মনে সেই গানটি প্যারোডি করে আওড়াই, আশায় আশায় দিন যে যাচ্ছে, আশা পূরণ হচ্ছে না!

ঝুড়িতে স্ট্রবেরি
ঝুড়িতে স্ট্রবেরি

বাচ্চাদের দেশে আসার ব্যাপারে আমার মতো তীব্র টান নেই। দেশে না আসলেও এই ছুটির দিনগুলোতে এরা তো কেউ ঘরে বসে থাকতে চাইবে না! এই অবস্থায় সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিবেশীর মতো কাছের যে জায়গাটি আমরা বেছে নেই সেটি হচ্ছে নায়াগ্রা ফলস ও তার কোল জুড়ে অবস্থিত মেরিনল্যান্ড। মেরিনল্যান্ডের সিজন পাসের বদৌলতে এক এক সিজনে কম করে হলেও ছয়-সাত বার তো যাওয়া হয়ই। এর অতিরিক্ত হিসেবে আছে দেশ বিদেশ থেকে আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধু বান্ধব বেড়াতে এলে তাদের চলনদার (চড়নদার) হয়ে নায়াগ্রা পরিদর্শন করানো। টরন্টো আসবে আর নায়াগ্রা দেখা হবে না অথবা দেখানো হবে না এটা কল্পনা করাটাও তো রীতিমতো ক্রাইমের শামিল! তাই তো কখনো কখনো মাইনাস ২০ ডিগ্রির তীব্র শীতেও নায়াগ্রাতে নিয়ে যেতে হয়েছে। যদিও আমার বাচ্চাদের কাছে নায়াগ্রার আবেদন এখন টেপ কলের পানির প্রবাহ ধারার পর্যায়ে নেমে এসেছে, কিন্তু মেরিনল্যান্ডের আবেদন তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী অবস্থানে আরোহণ করছে। এর কারণ হচ্ছে, যতই বড় হচ্ছে ততই নতুন নতুন আকর্ষণীয় রাইডগুলোতে চড়তে পারছে। বাল্লুগা হোয়েল (সাদা তিমি), কিলার হোয়েল, ডলফিন, সি লায়ন এসবের চমৎকার ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন ছাড়াও বাচ্চাদের মজার মজার অনেক রাইড আছে সেখানে। মেরিনল্যান্ডের সিজন পাসের যে নিয়ম, তার কথা ভাবতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের বুদ্ধির লেবেল নিয়ে ধান্দায় পড়ে যাই। একবারের জন্য একজনের প্রবেশ ফি ৩৫ ডলার আর সিজন পাস করলে একজনের জন্য ৪০ ডলার। ৫ ডলার অতিরিক্ত খরচ করলে সারা গ্রীষ্ম প্রতিদিন আসতে পারবে। কি তাজ্জবের কারবার! ঘর থেকে ৪৫ মিনিটের দূরত্বে পাঁচ ডলার তো মাগনার কাছাকাছি! চোখ বন্ধ করে সিজন পাস করে ফেলি।
নায়াগ্রা গমনের পাশাপাশি এদিক সেদিকও যাওয়া হয়ে থাকে। কানাডাস ওয়ান্ডারল্যান্ড নামে ক্রেজি একটা অ্যামিউজমেন্ট পার্ক আছে। যত সব ভয়ংকর রাইড আপনি চান, তার সবই পাবেন ওখানে। কয়েক বছর আগে খুব উত্তেজনার আতিশয্যে বাঞ্জি জাম্প দিয়ে ফেলেছিলাম। এর থ্রিল পার্টটি হচ্ছে বিশাল উঁচুতে তুলে হঠাৎ ছেড়ে দেবে। মনে হবে ২০-২৫ তলা ভবনের উচ্চতা থেকে আমি নিচে পড়ে যাচ্ছি। ছয়-সাত সেকেন্ডের ব্যাপার, কিন্তু এই সময়টাই মনে হবে মালাকুল মউত বুঝি পেছন থেকে ঝাপটে ধরে ফেলেছে। কোমরে রশি বাঁধা আমাকে যখন ক্রেনের সাহায্যে ওপরে উঠানো হলো আমার তো শরীরের রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার অবস্থা। নিজের ওপর এমন রাগ হচ্ছিল যে মনে মনে আমার নির্বুদ্ধিতার চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করছিলাম। সঙ্গে ছিল আমার ভাগনে। দুজনে পাশাপাশি ওপরে উঠেছিলাম। ভাগনে আমাকে বলে মামা চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছেন কল্পনা করেন। তা হলে আর ভয় লাগবে না। আমিও চোখ বন্ধ করে আছি মামা। আমি ভাগনেকে বলি, চুপ বান্দর কোনো কথা বলবি না। মনে মনে দোয়া দরুদ পড়ার চেষ্টা করি। কিছুই দেখি মনে আসছে না। শুধু নিজেকে ধিক্কার আর আল্লাহ তুমি বাঁচাও তুমি বাঁচাও ছাড়া আর কিছুই মনে আসছে না। ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম ও শেষ বাঞ্জি জাম্প।
আরেকটা রাইড আছে ওটার নাম সল্ট অ্যান্ড পেপার সেক। ওটাতে এক একজনকে ওপরে তুলে জাম যেভাবে জুমে সেভাবে জুমা হয়। ওটা চড়ার পর ঘাড় গর্দান আর কোমর পাঁচ দিন পর্যন্ত নাড়াতে পারিনি। এগুলো অবশ্য বাচ্চাদের রাইড না, তাই বাচ্চাদের পক্ষ থেকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার ততটা আবদার না থাকলেও আমার নিজেরই সেই যে ভয় থেকে একটা অনীহা ভাব চলে এসেছে এর জন্য ইদানীং আর যাওয়া হয় না তেমন একটা। এ ছাড়া অন্যান্য আউটডোর অ্যাক্টিভিটিজের মধ্যে ফ্যামিলি ফান হিসেবে রয়েছে চেরি পিকিং কিংবা স্ট্রবেরি পিকিং অথবা বড়শি বাইতে দূরের লেকগুলোতে যাওয়া আর কোনো কোনো বছর কটেজ ক্যাম্পিং করা।
স্ট্রবেরি ফার্মে সব সময় যাই খুব বেশি দূরে নয় বলে। স্ট্রবেরি সিজনের সঙ্গে আবার আমাদের দেশি জামের দারুণ মিল আছে! সিজন থাকে বড়জোর দুই সপ্তাহ। প্রথমবার যখন স্ট্রবেরি পিকিংয়ে যাই সেটা এক মজার কাহিনি। দুই তিন ফ্যামিলি মিলে আগে থেকেই শনিবার সকালে স্ট্রবেরি পিকিংয়ের দিন ঠিক করা হয়। আমি মনে মনে খুব এক্সাইটেড। স্ট্রবেরি দেখতে যেহেতু অনেকটা লিচুর মতো, আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে এটি বিশাল গাছের মধ্যে থোকায় থোকায় ধরে থাকে। অনেকটা আমাদের দেশের লিচু অথবা অরবরই কিংবা জামগাছের মতো। বিশাল গাছের মগডালে উঠে এক ডাল থেকে আরেক ডাল বেয়ে বেয়ে স্ট্রবেরি পাড়তে হবে। অনেক দিন পর গাছে উঠব এই উত্তেজনাতেই রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। স্ট্রবেরি পিকিংয়ের পারফেক্ট টাইমিং হচ্ছে অতি প্রত্যুষে যাওয়া। তা হলে ফ্রেশ পিক করা যাবে। সূর্য ওঠার পর থেকে সময় অতিক্রান্তের সঙ্গে এর সতেজতার জৌলুশ ভাটা পরতে থাকে। আরেকটি নিয়ম হলো ফার্মের ভেতর স্ট্রবেরি তোলার সময় যত ইচ্ছা খাওয়া যাবে, কোনো নিষেধ নেই। পাবলিকের জন্য স্ট্রবেরি পিকিংয়ের সময় আগে থেকেই পরিষ্কার পানি স্প্রে করে মাঠেই খাবার উপযোগী করে রাখে। এই নিয়মটা প্রথমবার জানতাম না বিধায় তেমন বেশি খেতে পারিনি। এর পরের বার থেকে যাওয়ার সময় লবণ-মরিচের গুঁড়া মিক্স করে কাগজের পোটলা বানিয়ে পকেটে ভরে সাথে নিয়ে যেতাম আর ইচ্ছা মতো খেতে বসে সাবাড় করতাম।
যা হোক, খুব ভোরে ওঠার কারণে আধো আধো ঘুম চোখেই রওনা দিই। হঠাৎ বলা হলো ফার্মে চলে এসেছি, কিন্তু আমার মনে খটকা! আমি তো কল্পনা করে বসে আছি গিয়ে দেখব বিশাল বিশাল স্ট্রবেরি বৃক্ষের সারি সারি বাগান। কিন্তু এখানে তো কোনো গাছ পালার নাম নিশানা পর্যন্ত নেই!
দূর থেকে পামির মালভূমির মতো দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল প্রান্তরে সারিবদ্ধভাবে আইল করে রোপিত আলু কিংবা মাষকলাই খেতের মতো দেখা যাচ্ছে। না বুঝেই প্রথম ধাক্কাতে আগ্রহটা দেখলাম চুপসানো বেলুনের মতো হয়ে গেল। গাড়ি পার্ক করে ফার্মের মালিকের সেলস সেন্টার থেকে আমরা সবাই একটি একটি করে ঝুড়ি নিয়ে ধীরে ধীরে যখন খেতের কাছে এলাম। তখন দেখি আমাদের মতো এমন আরও অনেক পরিবার এসেছে। দূরের খেতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাক্টরের পেছনে ছাদ খোলা ট্রেনের বগির মতো তিন-চারটি বগি যুক্ত করে আনা নেওয়া করে থাকে। আসলে সস্তায় স্ট্রবেরি পাওয়ার জন্য সেখানে কেউ যায় না। প্রকৃতির কোলে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে অবারিত নৈসর্গিক আবেশে নিজেদের বিলীন করে দেওয়ার আনন্দতেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেখানে যাওয়া। সুবর্ণ আলোক রশ্মি অরোরা অবলোকন, মৎস্য শিকার ও কটেজে রাত্রি যাপন নিয়ে পরবর্তীতে লেখার ইচ্ছা রইল।
প্রকৃতির কথা যখন এসেই পড়ল তখন আমি খুঁজে বেড়াই আমার চির পরিচিত সেই শ্যামল বাংলাকে। ফিরে চলে যাই আমার সেই শৈশব কৈশোরের সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো দিনগুলোতে। আমার দাদা নিজে কৃষিকাজ করতেন না, কিন্তু বাড়ির দক্ষিণে শৌখিন কৃষিকাজ করার জন্য এক খণ্ড জমি নিজের কাছে রেখে দিতেন। সেখানটায় রবিশস্য আর বনেদি ধানের চাষ করা হতো। বিশ্বস্ত আপনজনরা এসে নিজেদের থেকেই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে চাষ, মই, নিরানি আর সেচের কাজগুলো করে দিত। এমনিতে আমাকে কিছুই করতে দেওয়া হতো না, কিন্তু আমি শখ করে অন্যান্যদের সঙ্গে ছোট টুকরি নিয়ে মাথায় করে ছাইয়ের টাল থেকে ছাই নিয়ে জমিতে ছিটিয়ে দিতাম। খেতে মই দেওয়ার সময় মইয়ের ওপর উঠতে পারার সাফল্যকে মনে হতো বোয়িং ৭৮৭ এর গর্বিত পাইলট হিসেবে। আলু তোলার সময়ে খাড়ি (এক ধরনের টুকরি বিশেষ) নিয়ে এক দৌড়ে সবার আগে জমিতে চলে যেতাম আর আলু তোলার আনন্দের পাশাপাশি এদিক-ওদিক ছোটাছুটি, দৌড়াদৌড়ি আর হই হুল্লোড় করে মাঠ গরম করে ফেলতাম। অবশ্য সবকিছুই হতো সকলের সোহাগ মাখানো ভালোবাসার প্রচ্ছন্ন আসকারা পেয়ে। এইবেলা এসে এখন সত্যিকার অর্থেই চিন্তা করি, খেত থেকে সদ্য উঠানো ছোট ছোট গোল আলু দিয়ে আমার দাদির জাদু হাতে রান্না করা মুরগির মাংসের ঝোল অথবা শোল, টেংরা, পাবদা, পুঁটি আর বোয়াল মাছের ঝোলের তরকারির স্বাদ কি ম্যাকডোনাল্ডস, বার্গার কিং, সুইস শ্যালে কিংবা কেএফসি জীবনেও দিতে পারবে।
(লেখকের ইমেইল: [email protected])