আলোহীন আলোয় দেখেছি ভিন্ন এক পৃথিবী

আমি চোখে দেখছি না।
অসহনীয় এই সহন। তাই বলে গত দুই দিন সবার প্রোফাইলের ছবি বদলাতে হবে? ছবির ক্যাপশনগুলো কোনোরকমভাবে পড়তে পারছি। সেই পড়তে পারা আমার আরও জ্বালা বাড়িয়ে দিচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে। এর কোনো মানে হয়? চিল্লাচিল্লি করে ঘর মাথায় তুললাম। আমার প্রিয়তমকে বললাম আজই তুমি এর কোনো বিহিত করো। ইন্টারনেট প্রবলেম! আমি গত দুই দিন ধরে কোনো ছবিই দেখছি না।
দুই দিন কতটা দীর্ঘ হতে পারে এর আগে আমার ধারণাই ছিল না। তবে কীভাবে বছরের পর বছর কাটায় আমার দৃষ্টিহীন বন্ধুরা? ওদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সময়টা ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার। পাঁচতলা ভবনেই আমাদের ক্লাস। ছুটির ঘণ্টা বাজল না। কলেজে তা বাজে না। সবাই চলে গেল। ভুল করে কী যেন ফেলে গেলাম ক্লাসরুমে। কে জানত এই ভুলটাই আমার জন্য খুব প্রয়োজন ছিল। এসেই দেখি সমস্ত ক্লাস ফাঁকা। একা একটা মেয়ে বসে আছে চোখ ছল ছল জল নিয়ে। আশ্চর্যান্বিত হয়ে আমি মেয়েটাকে বললাম, তুমি বসে আছ কেন? মেয়েটা আতঙ্কিত হয়ে বলল, ক্লাসে কি কেউ নেই?
এইবার আমি বুঝে ফেলি। ওহ গড মেয়েটা দৃষ্টিহীন।' না কেউ নেই, এই কথা বলার শক্তি পাচ্ছি না আমি। আমার পৃথিবী নড়ে উঠল। মন খারাপ হলো। মেয়েটার এত প্রখর অনুমান ক্ষমতা। সে বুঝে ফেলে। আমাকে অভয় দিয়ে বলে, এই মেয়ে, মন খারাপ করতে হয় না, আমি সালিমা। তুমি?
সেই শুরু। সালিমার ডান হাত আর বাম হাত ধরলাম আমরা দুই বোন। আমরা যমজ। একই সঙ্গে পড়ি। যমজ হলে এই এক সুবিধা একসঙ্গে দুই বন্ধু পাওয়া যায়! আমরা তিনজন বন্ধু নামের বন্ধনে পা বাড়ালাম। অতপর আমরা প্রতিদিন রাস্তা পার হই। পাঁচতলা ভবন থেকে গুনে গুনে পা ফেলি। সেই প্রথম বুঝি সিঁড়িগুলো এত দীর্ঘ। রাস্তাগুলো এত রিস্কি। একবার রাস্তা পার হতে গিয়ে মৃত্যু প্রায় কাছাকাছি এসে গিয়েছিল। এত কঠিন। তবে কীভাবে আমাদের বন্ধু সালিমা এত দূর যায়? আমি ভাবতে পারি না। আমরা না হয় গাড়ি পর্যন্ত তুলে দিই? বাকি পথ? ভেবে আমি শিউরে উঠি। দশ মিনিটের এই গাড়িতে তুলে দেওয়ার যাত্রায় আমি আর রিপা দুজনেই হিমশিম।
কিছুদিন পর সালিমা আরেকটা বোনাস বন্ধু দেয়। ওর বোন তাসলিমা। নিয়তি ওর চোখেও দৃষ্টি দেয়নি। তবু ওর কথা বলায় এত প্রাণ। তাসলিমাও আমাদের ক্লাসে পড়ে। আমার বুঝতে দেরি হয় না, ওর হাতটাও ধরা চায়। আমরা দুই বোন সালিমা–তাসলিমা দুজনকে বন্ধুত্বের শামিয়ানায় নিয়ে সামলে নেবার শক্তি পেয়ে যাই।
এভাবেই দিন যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন আমাদের একই ক্লাসের সুদর্শন একটা ছেলে আমাকে ডাক দিয়ে বলল, শোন, দেখো তো এই খাতার পাতাতে কিছু লেখা আছে নাকি? ওর চোখের কালো গ্লাস আমার নজর এড়ায় না। ছেলেটা দৃষ্টিহীন এটুক বুঝতে পেরে আমি যতটা না স্তম্ভিত হয়ে পড়ি, তার থেকেও বেশি স্তম্ভিত হই খাতায় কিছুই লেখা নেই দেখে। কী করে বলি আমি তাকে তা? ছেলেটা কীভাবে যেন তা টের পেয়ে যায়। আমাকে বলে, আমার পাশে বসা একজনকে বলেছিলাম, পড়াটা লিখে দিতে। ও' বলেছে দিয়েছে। তুমি মন খারাপ কর না। এমন কত হয় আমাদের মতো দৃষ্টিহীনদের সঙ্গে।
তারপর আমাদের নৌকায় যুক্ত হয় সোলায়মান নামের সেই ছেলেটা। এমন করেই দিন যায়। আমরা জানতে থাকি সোলায়মানের অন্ধত্ব জন্মগত না। কী নির্মম, দুই–চার বছর পৃথিবী দেখেছে সে। এখন দেখছে না! সালিমা তাসলিমা তাও দেখেনি। ওদের অন্ধত্ব জন্মগত। ওরা গর্ভধারিণী মাকেও দেখেনি। এমনকি নিজেকেও দেখেনি।
আচ্ছা, রিমু আমি দেখতে কেমন? এই কথা যেদিন সালিমা আমার কাছে জানতে চায়, আমি বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। সালিমা কখনো নিজেকে দেখেনি। এটাই সত্য। সেদিনই আমি আয়নার কাছে প্রশ্ন রেখেছি, সত্য এত অসুন্দর হয় কী করে!
তবু আমি দেখি সালিমা–তাসলিমার জামার সঙ্গে ম্যাচিং কানফুল দোলে। মন তো এক মহাদেশ। ওতে এমন করেই কত রঙিন স্বপ্ন দোলে। দেখি আমাদের ক্লাসের সব থেকে পরিপাটি ছেলেটাই সোলায়মান। ওর সাদা শার্ট ছিল ক্লাসের সব থেকে ধবধবে শার্ট! হবেই বা না কেন? স্বচ্ছতার আর শুভ্রতার লালন তো ভেতর থেকেই উৎসারিত হয়।
যাচ্ছিল দিন এভাবেই। মাঝে একদিন আমাদের বন্ধু সোলায়মানের হাতটা ধরার প্রয়োজন পড়ল। ওকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে। আর তার জন্য ও'র হাতটা ধরতে হবে। আমি খুব ঘামছি। আমার সংকীর্ণতা আমার বিবেককে জেরা করছে। সোলায়মানের হাতটা আমার ধরতে হবে। খুব দরকার। খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। কীভাবে ধরব? এর আগে কোনো ছেলের হাত ধরিনি আমি। সংকোচ আর সংকটে অস্থির। এভাবে চলে গেল দুই–চার মিনিট। তারপর? তারপর আমার সমস্ত দ্বিধাকে আমার বিবেক জয় করল। আমি বলি, সোলায়মান আস, আমার হাত ধর। তোমাকে পৌঁছে দিই।
হ্যাঁ। আমি পেরেছি। কী শান্তি নিয়ে যে বাসায় ফিরেছি সেদিন।
কিন্তু বিধিবাম কে জানত সেই হাত ধরা ছেলেটাকে নিয়ে রাস্তা পার হওয়া দেখবে আমারই গ্রামের কোনো বড় ভাই। যা হওয়ার তাই হলো। রাতে আমার নম্বরে ফোন এল। শহরে পড়িস, ভালো। শুনলাম ইদানীং নাকি ছেলেদের হাত ধরে ঘুরে বেড়াস!
ঘৃণায় আমার গা জ্বলে উঠল। আমার মনের শান্তি আমাকে শক্তি দিল শক্ত একটা জবাব দেওয়ার জন্য। উত্তর করলাম, হ্যাঁ বেড়াই। কেননা চোখে আলো নিয়ে সেই আলোতে নোংরা জিনিস ভাবার মানুষদের চেয়ে আলোহীন তবু হৃদয়ের আলো দিয়ে ভুবন দেখা মানুষদের হাত ধরে হাঁটা খুব ভালো।
এমন করেই দিন যায়। কত গোপন, কত বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার গল্পে ভরে যায় আমাদের দুই বোনের কলেজজীবন। আমরা মানুষের রূঢ়তা দেখি, শঠতা দেখি। আরও দেখি ক্লাসের সব থেকে সুন্দরী মেয়েটার ক্লাসহীন মানসিকতা। আকস্মিক উড়ে এসে আমার বন্ধু সালিমাকে ন্যাকা করে বলতে দেখি, বলো তো সালিমা আমি কে?
ইচ্ছে করছিল কষে একটা থাপ্পড় দিই। কিন্তু চাইলেই কি সব করা যায়?
সালিমা বুদ্ধিমান। মৃদু হেসে উত্তর করল, দেখ ঈশিতা! তোমার পারফিউমের ঘ্রাণটা একটু কড়া। বদলে নিয়ো। তা ছাড়া তুমি কে তা বুঝতে পারা আমার জন্য বোধ হয় তেমন দরকারি কিছু না!
আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আমার এই বন্ধুদের নিয়ে আমার গর্ব হয়। ওরা বাংলাদেশের অন্যতম ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছে। অনার্স, মাস্টার্স পড়ছে ল, সমাজ বিজ্ঞানের মতো দারুণ সব বিষয় নিয়ে। লাখ লাখ দৃষ্টি থাকাদের পেছনে ফেলে ওরা করে নিয়েছে নিজের অবস্থান। ওরাই তো আলোর পথযাত্রী!
ভাবতে ভালো লাগে; তাসলিমা চাকরি করছে। মানুষ গড়ার কারিগর সে। সালিমা তার বিষয়বস্তুতে ভীষণ ভালো রেজাল্ট করেছে। সোলায়মান আইন বিষয় নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন সমাপ্ত করেছে। সোলায়মান গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনেও। দেশের বাইরে ক্রিকেট খেলার জন্য ওর এই যাত্রা। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের (চরম অনীহা সত্যেও এই বিশেষণটা লিখতে হলো। কেননা অনুষ্ঠানটির নামই ছিল তা) নিয়ে অনুষ্ঠিত প্রতিবন্ধীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে যোগ দিতে ওর এই যাত্রা। যাতে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ।
আমি তাই বলি, ডেল কার্নেগিই কেবল জেগে ওঠার শেষ মন্ত্র নয়। তবে তো যে মানুষ পড়তে জানে না তার কী হবে! স্বদেশ কিংবা বিদেশ হৃদয়ের জানালা দিয়ে তাকালে দেখতে পাওয়া যায়, এমন আলোর গল্প। আমি রূপকথার তারাদের গল্প শুনি না। তারারাও ঝরে যায় কিংবা হারিয়ে যায়। আমার কাছে আমার বন্ধুরা তারা নয়, নক্ষত্র। প্রত্যেক তিথিতে চাঁদেরও অবস্থান করতে হয় একেকটি নক্ষত্রের কাছে। কলেজজীবনের প্রতিটা দিন আমি সালিমা, তাসলিমা আর সোলায়মানের সংস্পর্শে থেকে ওদের আলোহীন আলোয় দেখেছি ভিন্ন এক পৃথিবী। যে পৃথিবীর অভিধানে হেরে যাওয়া নামে কোনো শব্দ নেই।
*জাহান রিমা, ভ্যালেন্সিয়া কলেজ, যুক্তরাষ্ট্র।