আর কতটা ইতিহাস ধারণ করলে কমলাপুর ঐতিহাসিক হয়ে উঠবে
বাঙালি জাতির জন্য বিংশ শতাব্দী ’৫২ ও ’৭১–এর মতো সালগুলোকে ধারণ করে।
সময় বহমান হলেও কালের সাক্ষী হয়ে সময়কে জয় করা প্রতিটি ঐতিহাসিক নিদর্শন বা স্থাপনাগুলো একটি জাতির অর্জনগুলো তুলে ধরে আগামী প্রজন্মের সামনে।
বাংলাদেশে বিংশ শতাব্দীর কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনার নাম যদি লিপিবদ্ধ করা হয়, তবে জাতীয় সংসদ ভবন, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, জাতীয় জাদুঘর, বায়তুল মোকাররম মসজিদের পাশাপাশি উঠে আসে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের নাম।
১৯৪৭–এর ভারত ভাগের পর, ঢাকার ক্রমবর্ধমান জনগণের কথা মাথায় রেখে তৎকালীন ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনটিকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দুজন মার্কিন স্থপতি ড্যানিয়েল বার্নহ্যাম ও বব বুই তাঁদের রেলস্টেশনের নকশায় আমাদের দেশের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার নান্দনিকতা ফুটিয়ে তোলেন, যা আজকের কমলাপুর রেলস্টেশন। ১৫৬ একর জায়গার ওপর স্থাপিত স্টেশনটি সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় ১৯৬৮ সালে শুরুর দিকে, যা ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে প্রায় ১০ গুণ বড় (তথ্যসূত্র: দ্য ডেইলি স্টার)।
স্টেশনটি নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত, প্রতিদিন ১ লাখ ২০ হাজার মানুষের জন্য পরিষেবার ব্যবস্থা করে চলেছে নিরন্তন (তথ্যসূত্র: পিপিপিএ)। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই স্থাপনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবনে আজ আমরা ব্যর্থ হয়েছি।
তবে অতীব পরিতাপের বিষয় হলো, গণমাধ্যমের কল্যাণে এই স্থাপনাকে প্রতিস্থাপনের মতো সিদ্ধান্তের কথা আমাদের আজ অজানা নয়। এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা নিয়ে সিধান্তের সূত্রপাত এমআরটি (ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট) লাইন–সিক্সের মধ্য দিয়ে।
ঢাকাবাসীকে যানজটের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে মেট্রোরেল একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
যদিও ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ কিংবা অন্যান্য বিভাগীয় শহরে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে এর সমাধান নিহিত বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, যার আলোচনা এই নিবন্ধে অপ্রাসঙ্গিক। বর্তমানে মেট্রোরেলের জন্য নির্মাণাধীন রেলপথটি হলো এমআরটি লাইন-সিক্স। প্রাথমিক পর্যায়ে এর নকশা উত্তরা থেকে সায়েদাবাদ হলেও পরবর্তী সময়ে তা আরএসটিপি (রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান) অনুযায়ী পরিবর্তন করে উত্তরা থেকে মতিঝিল করা হয় (তথ্যসূত্র: দ্য ডেইলি স্টার)। এমআরটি লাইন-সিক্সের জন্য কমলাপুরে মাল্টিমডেল হাব তৈরির পরিকল্পনা করা হয়, যেখানে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের সব ব্যবস্থার সমন্বয় সাধন করা হবে (তথ্যসূত্র: পিপিপিএ)।
এই হাব বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান জাপানের কাজিমা করপোরেশনের নকশায় কমলাপুর রেলস্টেশনকে বর্তমান অবস্থান থেকে ১৩০ মিটার উত্তরে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়। একই সঙ্গে মেট্রোরেল বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) তাদের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করে, মেট্রোরেলের দিক পরিবর্তন করলে দু–তিন কিলোমিটার পথ বেড়ে যাবে। তাই মেট্রোরেলের দিক পরিবর্তন না করে কমলাপুর রেলস্টেশন সরানো ভালো হবে।
প্রথমে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও ডিএমটিসিএলের মধ্যে মতের ভিন্নতা থাকলেও এখন উভয়ের সম্মতিতে এমআরটি–সিক্সের বর্ধিত অংশের জন্য কমলাপুর রেলস্টেশনকে সরানোর প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে (তথ্যসূত্র: দ্য ডেইলি স্টার)।
বুয়েটের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন দেশের এক সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই ঐতিহাসিক স্থাপনা প্রতিস্থাপনের প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, জাপানের কাজিমা করপোরেশনের সঙ্গে তাঁর কয়েকবার সভা হয়েছে এবং সভা শেষে উভয় পক্ষই সম্মত হয়েছে এই রেলস্টেশনকে মাঝখানে রেখে এমআরটি-সিক্সের বর্ধিত অংশের জন্য যেকোনো ধরনের অনুভূমিক বা উলম্বিক সম্প্রসারণ বা উন্নয়ন সম্ভব।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, পরিকল্পনাটি এখনো প্রক্রিয়াধীন, সেখানে চূড়ান্ত অনুমোদনের খসড়া তৈরি তাঁর কাছে অজানা।
আমরা যে সমস্যার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, তা একেবারেই নতুন, এমনটি বলার সুযোগ নেই। জুরিখ রেলস্টেশন হলো সুইজারল্যান্ড রেলওয়ের প্রধান কেন্দ্রস্থল, যা সুইজারল্যান্ড বাদে আরও চারটি দেশকে পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছে। স্টেশনটি ভূমি থেকে ভূমির নিচ পর্যন্ত কয়েকটি স্তরে বিন্যস্ত। ভূমির ওপরে উলম্বিক সম্প্রসারণে না গিয়ে কী করে ভূমির নিম্নতল ব্যবহার করতে হয়, তা স্বাধীনতার আর কত বছর পার করলে আমরা রপ্ত করতে পারব, তার উত্তর আমার জানা নেই। যদিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (কর্ণফুলী) সুড়ঙ্গ আমাদের সে সক্ষমতারও জানান দেয়।
অন্যদিকে মিউনিখ সেন্ট্রাল স্টেশনটি জার্মানির মিউনিখ শহরের প্রধান রেলস্টেশন, যা প্রতিদিন ৪ লাখ ৫০ হাজার যাত্রীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের মেট্রো স্টেশনের জন্য ১০ দশমিক ৫ কিলোমিটার বিস্তৃত ইউ–নাইন লাইন নামে নতুন একটি রেলপথ নির্মাণ করছে মিউনিখ পৌর শাসন, যেখানে মেট্রো স্টেশনটি মিউনিখ সেন্ট্রাল স্টেশনের সঙ্গেই তৈরি হবে (তথ্যসূত্র: আইআরজে), কিন্তু তা ভেঙে নয়।
এমন উদাহরণ হয়তো এই লেখাকে কেবল দীর্ঘায়িতই করবে। আমাদের লক্ষ্য যদি উন্নত দেশের কাতারে নিজেদের অবস্থান তৈরি করা, তবে ওপরের উদাহরণ কি যথেষ্ট নয়?
ঐতিহাসিক স্থাপনার বিষয়ে আমাদের উদাসীনতা বরাবর। ২০১৫ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর কর্তৃক লালবাগ কেল্লার দেয়াল ভেঙে গাড়ি রাখার স্থান নির্মাণ তারই প্রমাণ বহন করে। সেই একই ধারায় উন্নত দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দোহাই দিয়ে রেলমন্ত্রী বর্তমান স্থাপনাকে একই স্থাপনার প্রতিলিপি দিয়ে প্রতিস্থাপনের যে আশ্বাস দিলেন, তা কেবল আমার মনে একটি প্রশ্নেরই জন্ম দেয়, সবকিছু কি প্রতিলিপি দ্বারা প্রতিস্থাপন সম্ভব? বিভিন্ন দূষণে আগ্রার তাজমহলের সৌন্দর্য সাদা থেকে হলদে বা সবুজাভ হয়েছে (তথ্যসূত্র: রয়টার্স)।
তার মানে তো এই নয় যে তাজমহল সরিয়ে নেব, কিন্তু দূষণ কমাব না। এখানে তাজমহলের সঙ্গে আমাদের কমলাপুর রেলস্টেশনকে এক কাতারে নিয়ে আসা হয়তো নতুন বিতর্কের জন্ম দেবে। তবে কেউ কি এই স্টেশনকে বাদ দিয়ে ঢাকায় অবস্থিত ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকা করতে পারবেন, সে বিষয় নিয়েও আলোচনা করা যেতে পারে।
আমাদের পরিকল্পনাগুলো যে ত্রুটির ঊর্ধে এমন নয়, অতীত তার সাক্ষী। মেট্রোরেল ঢাকাবাসীর জন্য স্বস্তির বার্তা নিয়ে এলেও কমলাপুর রেলস্টেশন ভেঙে ফেলার খবর নিঃসন্দেহে বাঙালির জন্য অস্বস্তির বার্তাই বহন করে।
দেশের আর্থসামাজিক উন্নতির জন্য অবকাঠামোর উন্নয়ন জরুরি নয়, এমন বিতর্কে বোকারা ছাড়া কেউ যাবে না। তবে আমাদের মধ্যে খুব প্রচলিত এক প্রথা আছে, বিদ্যমান অবকাঠামোতে সুবিধাভোগীদের জন্য সেবার মান উন্নয়নের দিকে আমাদের দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা বেশি; এর বিপরীতে তাঁদের আগ্রহ বেশি দেখা যায় অবকাঠামো উন্নয়নে। আফসোস!
*লেখক: শিক্ষার্থী, কানাডা। [email protected]