আমি আর বড় হতে চাই না...
মাঝরাত। চারপাশজুড়ে পিনপতন নীরবতা। আপাদমস্তক স্মৃতিরা জাপটে ধরেছে আমায়। অতীতের স্মৃতিগুলো প্রলয়ংকরী ঝড় হয়ে বুকের পাঁজর বিদীর্ণ করে চোখের বিলে আছড়ে পড়ছে। দিশেহারা আমি নস্টালজিক হয়ে পড়ছি। ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছি স্মৃতির মহাসাগরে।
মনে পড়ে ঈদের দিন। প্রথম ভোরের শীতল বাতাসে থই থই সুখের সবুজ ঢেউ চারদিকে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে প্রাণের আনন্দঘন উচ্ছ্বাস। মন কেমন করা ঈদের নতুন জামার মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠেছে ঘর-বাড়ি। মুয়াজ্জিনের সুরেলা আজানের ডাকে, আম্মার নামাজের অজু করা কলের জলের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। সকালের সোনালি আলোয় শিশিরস্নাত হাসনাহেনা মাথায় গুঁজে ঘুম থেকে উঠেই নারিকেল পাতার সলার ঝাড়ু দিয়ে পুরো বাড়ি পরিষ্কার করেছি নিজ হাতে। ঈদ উপলক্ষে বিছানায় পাতা নতুন চাদরে অকারণেই গড়াগড়ি করছি। জানালার নতুন পর্দা দক্ষিণা বাতাসে দোল খাচ্ছে। বিদেশ থেকে আব্বার পাঠানো সুরমা চোখে লাগিয়ে আম্মা মাটির চুলায় উঁচু পিঁড়িতে বসে সেমাই রাঁধতে বসেছেন। এক মাস সিয়াম সাধনার পরে সাতসকালেই আম্মার মুখভর্তি কারুকার্যময় পান খাওয়ার মুহূর্ত আমার চোখে দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর দৃশ্য। আমি আম্মাকে নারিকেল ছিলে দিচ্ছি সেমাইয়ের জন্য। পায়েস রান্নার জন্য তাড়াহুড়ো করে শিলপাটায় কালিজিরা চাল ভেঙে দিচ্ছি। আম্মা ট্রেতে ডিম, কাঁচামরিচ দিয়ে নুডলস সাজিয়ে দিচ্ছেন। বড় আপার হাতে বানানো সুজি পিঠা, চালের গুঁড়োর হরেক রকম সাজের পিঠায় ডাইনিং টেবিল ভরে গেছে। ইশ! আর অপেক্ষা সহ্য হচ্ছে না; কখন আম্মার হাতের তৈরি সুস্বাদু সেমাইর জর্দা খাব!
এর মধ্যে বড় ভাইয়া বাজার থেকে গরুর মাংস কিনে পাঠিয়ে দিয়েছেন বাড়িতে। রান্নার জন্য আম্মাকে জিরা, আদা, গোলমরিচ, রসুন পিষে দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখি ১০টা বেজে গেছে। ওহহো! কখন যে গোসল করে নতুন জামা পরব! ভাইয়ারা, মামা সবাই ঈদের নামাজ থেকে ফেরার আগে নতুন জামা পরতেই হবে! আম্মার হাতে ঘি দিয়ে রান্না করা পোলাওর সুঘ্রাণে বাড়ি মৌ মৌ করছে। কত দিন ধরে যেন অধীর আগ্রহে আজকের এই ঈদের দিনটির অপেক্ষায় আছি! কারণ? কারণ ঈদের দিন আম্মা কখনো এক চামচ পোলাও দিয়ে পরের প্লেটে সাদা ভাত তুলে দেবেন না! আজ যে ঈদের দিন। মাটিতে শীতল পাটি পেতে আম্মার সাথে সব ভাই-বোন মিলে একসঙ্গে বসে পোলাও-মাংস খাব! আম্মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, মামাসহ সবার থেকে আজ ঈদ সালামি পাব। কত ভাবনা! কত উদ্গ্রীব অপেক্ষা।
নতুন পাঞ্জাবি গায়ে ঈদের নামাজ থেকে ফেরা ভাইদের কোলাকুলি দেখে আপ্লুত হচ্ছি। আম্মা সবাইকে নিজ হাতে সেমাই খাইয়ে দিচ্ছে। আর আমি পরেছি নতুন জামার সঙ্গে মিলিয়ে জুতা-মোজা। চুলে বাঁধা রঙিন ফিতাও বাদ নেই। দিনভর পাখির মতো এই বাড়ি, ওই বাড়ি চষে বেড়াব! সূর্যের তীক্ষ্ণ চোখকে ফাঁকি দিয়ে তীব্র দুপুরে সুপারি বাগানের ছায়ায় বসে দখিনা বাতাসে পাড়ার সব বান্ধবী মিলে গলা ছেড়ে গান গাইব। সময় ভুলে মজে থাকব আড্ডায়।
আজ রাতে পড়ার টেবিলে বসতে হবে না। রেডিওর আওয়াজ বাড়িয়ে দিয়ে এক এক করে অনুরোধের আসরের সব গান শুনব। কেউ বকবে না। দূরের বাজার থেকে ঈদের রাতের জন্য নানার বাড়িতে মামা-মামিদের ভাড়া করে আনা ভিসিআর সেট, ক্যাসেট, রঙিন টিভিতে রাত জেগে সিনেমা দেখব আশ মিটিয়ে। বকবে না কেউ। চাইলেই মিলে যাবে আম্মার অনুমতি। আম্মার কোনো শাসন-বারণ থাকবে না। পড়াতে আসবেন না স্যার। আহা জীবন! আমায় দিয়ে চলে গেছে আঁজলা ভরা সুখ।
রাতভর বাড়ির আঙিনায় ফুটে থাকা হাসনাহেনা, বেলি ফুলের সুগন্ধে আমি হারিয়ে যাব রূপকথার দেশে বাবার রাজকন্যা হয়ে! লুকোচুরি খেলার সঙ্গী হবে ঝিঁঝি পোকার দল। মাঝরাতে কুয়াশায় ভেজা নারিকেল পাতায় চাঁদের আলোর ঝিকিমিকি খেলা দেখব। কোনো স্কুল, কোনো মক্তব থাকবে না। বন্ধ সবই। সকালে ঘুম থেকে ওঠার কোনো তাড়া থাকবে না।
ছেলেবেলায় ফেলে আসা স্বপ্নের রঙে আঁকা বাংলাদেশের ঈদের দিনগুলোর কথা মনে করে কাতর হয়ে পড়ি। স্মৃতি হাতড়াই। বহু বিচিত্র এই জীবন। আরও বিচিত্র এই জীবনের রঙেরা। বিচিত্র সেসব রঙে চিত্রিত জীবনকে কখনো ইচ্ছায়, কখনো অনিচ্ছায় মেনে নিয়ে আমাদের জীবন যাপন করতে হয়। প্রিয় অতীত সবুজ শাড়ির আঁচল উড়িয়ে আমার মনের গহিন বিলের পথ ধরে হেঁটে যায় রোজ। আমি নিশ্চল, নিশ্চুপ পাথর চোখে চেয়ে থাকি তার চলে যাওয়ার দিকে।
অতীতের মধুর ঈদের স্মৃতিগুলোকে অন্তহীন আকাশে উড়িয়ে দিয়ে নিয়ম বাঁধা জীবনের স্বাভাবিক গতিতে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ভিন্ন গোলার্ধের এই দূর দেশে ঈদ আনন্দে মেতে উঠলেও বুকের ভেতর মাঝেমধ্যেই চিনচিন ব্যথা বাজে। ঈদের দিন শেষে মাঝরাতের গাঢ় অন্ধকারে চোখের ঘোলা জলে যখন চাঁদের আলো এসে পড়ে, তখন নিজের মনে নিজেই আওড়াই; ‘আমি আর বড় হতে চাই না...’।