আমার হিরো আমার বাবা

বয়স আমার চল্লিশের কোঠা পার হয়েছে বছর দুয়েক আগে। এখনো আমি আমার বাবার কাছে খোকা। বুড়ো খোকা। ফোন করলেই সেই একই ডাক আব্বুরে কেমন আছ বাবা। যেন চলন্ত বাস থেকে আমায় ডাকছেন মেঘনা ব্রিজের ওপর থেকে। তখন আমি নতুন চাকরিতে। বাবু ডাক কত জোরে দিয়েছিলেন কল্পনা করা যায়। মেঘনা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি কাজ করতাম তখন। ডাক শুনে পেছন ফিরে দেখি বাস চলে গেছে সেতুর মধ্যখানে। হাত দেখা যাচ্ছে বাবার।
যেদিন বাবা ফোনে আব্বু বলেন না, অল্প কথা বলেন, বুঝতে পারি আমার বাবার মন ভালো নেই। রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত উপসহকারী প্রকৌশলী আবদুল হক আমার বাবা। আমিই তার বড় সন্তান। আজ বাবা সত্তর পেরিয়েছেন। ডায়াবেটিক করেছে কাবু। দিনে কয়েবার ইনসুলিন নেন। চোখে লাগিয়েছেন লেন্স। একে একে চলে যাচ্ছেন বাবার ভাই-বন্ধু সব পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। যারা আমার ছাত্রজীবনে আমার বাবার সঙ্গে মিশেছে তাদের কাছেও আমার বাবা একজন আদর্শ পিতা, একজন ভালো বন্ধু ছিলেন। আজ স্মৃতিশক্তি, ধৈর্য, স্বপ্ন দেখানো, ওপরে উঠার সিঁড়ি দেখাবার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। কিন্তু আমাকে ডাকার স্টাইল রয়ে গেছে আগের মতোই, যেমন ডাকতেন শিশুবেলায়। বাবা ভীষণ অভিমানী এখন, পান থেকে চুন খসলেই পুরোনো স্মৃতির খাতা খুলে বসেন। রাগ করেন, অভিনয় করেন। আবার আব্বা বলে একবার ডাকলেই ভুলে যান সব।
প্রবাস থেকে বাবার এলোমেলো স্মৃতি বুকের পাঁজর কাঁপিয়ে চোখ থেকে ঝরাচ্ছে নোনা পানি। বাবার কথা মনে পড়ছে বারবার। জীবনের প্রথম যে হাতের স্পর্শে আমার প্রথম হেঁটে চলা, তিনি আমার বাবা। কলেজজীবন ও হোস্টেল জীবনে নাটক কবিতা নিয়ে যখন মহিলা সমিতি, গাইড হাউস, পাবলিক লাইব্রেরিসহ নানা জায়গায় ঘুরতাম ভবঘুরের মতো। বাবা হোস্টেলের সামনে আমাকে একনজর দেখার জন্য অপেক্ষা করতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
একবার ট্রেনে শ্রীপুর থেকে ঢাকা আসছিলাম। তেজগাঁও রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছেলে ট্রেনে পাথর ছুড়ে মেরেছিল। সেই পাথরে আমার মাথা ফেটে গিয়েছিল। রক্তাক্ত অবস্থায় স্টেশনের টিটি আমায় দেখছিলেন। সম্ভবত তারা বাবাকে ফোন করেছিলেন। শুনে শ্রীপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন ঢাকায়। ছোটবেলায় কঠিন অসুখে কাঁধে নিয়ে ডাক্তারদের কাছে গিয়েছেন।
সরকারি চাকরির সামান্য আয়। ব্যয় সামাল দিতে ঘড়ি মেরামত করতেন। ঘড়ির ছোট ছোট নাটবল্টু, স্প্রিং হুইল হারিয়ে গেলে সারা ঘর ঝাড়ু দিয়ে বালি একত্র করে কাগজের ওপর রেখে শত পাওয়ারের বিদ্যুতের বাতির কাছে নিয়ে ফুঁ দিয়ে খুঁজে বের করতেন। একটা ঘড়ি ওয়েলিং করলে পাঁচ–দশ টাকা পেতেন। তা দিয়ে ময়মনসিংহ থাকার সময় বসাকের দোকানের চিনি দেওয়া খাঁটি মিষ্টি দুধ, আড়িখোলা, কালীগঞ্জ থাকতে পুরি, নান রুটিসহ নানা রকমের খাবার খাওয়াতেন।
একবার নাকি লিচু খেতে চেয়েছিলাম, বাবা ফিরতে রাত হয়ে যায়। এসে দেখেন আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুমের মধ্যেই লিচু খাইয়েছিলেন। এ কথা বাবার মুখেই শুনেছি। বাবাকে বেশির ভাগ আব্বা বলেই ডাকি। কত বলব বাবার আদরের কথা। খাতা ফুরাবে লেখা ফুরাবে না। বাবার আদর যত্নের কথা ফুরাবে না। শিশুবেলায় কাঁধে করে নিয়ে যেতেন ময়মনসিংহ সিগন্যাল অফিসে। মা বাড়ি গেলেও আমাকে রেখে দিতেন তার কাছে।
১৯৯৫ সালে আমার নতুন চাকরিতে মেঘনা–সোনারগাঁয়ে আমাকে রান্না করে খাইয়ে এসেছিলেন। বিদেশ আসার আগে দেশের চাকরি ছেড়ে এসেছিলাম রাজশাহী থেকে। তখন আব্বার কাছে কমলাপুর মেসেই থাকতাম। ছিয়ানব্বই সালের শেষের দিকে ড্রাইভিং শিখতাম কমলাপুরে। বাবা থাকতেন মেসে স্টেশনের শেষ প্রান্তে। প্রতিদিন চকচকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট পকেটে দিয়ে বলতেন, আমি আছি, একদম চিন্তা করবি না। কখনো নিজের উচ্চতা নিয়ে আফসোস করলে স্টেশনে শুয়ে থাকা লম্বা মানুষদের দেখিয়ে বলতেন, শুকুর করো আল্লাহর দরবারে, তুমি সুস্থ। ঢাকা–চট্টগ্রাম–রাজশাহী থেকে গাড়ি এলে যাত্রীদের ভিড় থেকে তার চোখ খুঁজে বের করত লম্বা সুন্দরী মেয়েদের। বলতেন, যদি আমাকে সুযোগ দাও আমি এক পরি উপহার দেব এর চেয়ে সুন্দর। আমি কথা রেখেছি, বাবাও রেখেছেন। আমাকে শুধু পরি নয় এক লক্ষ্মী বউ দিয়েছেন। আজ আমি দুই কন্যার বাবা।
আমার বন্ধুরা যারা একবার বাবাকে দেখেছে, মিশেছে আমার বিশ্বাস, বাবার কথা সে কোনো দিন ভুলবে না। সিঙ্গাপুর প্রবাসে বসে আজ বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। সিঙ্গাপুরে এখন ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ছুটির দিন। এই ভোরে নাক ডেকে ঘুমোবার কথা। বাবার ছবি দেখছি, স্মৃতি মনে করে চোখ বেয়ে নেমে আসছে নোনা পানি। ভেবেছিলাম দু–একটি লাইন লিখব। চশমাটা গতরাতে ভুলে রেখে এসেছি কোথাও। ঝাপসা চোখে মোবাইলের বাটনে লিখছি। গত ছুটিতে দেশে থাকার সময় যৌতুক প্রতিরোধ আন্দোলন, সাহিত্যের কাজে সভা, প্রচারণা ও নিজ পরিবার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আব্বাকে সময় দিতে পারিনি। অনেক অভিমান করেছেন। আব্বা চান ভোরে তার সঙ্গে নামাজে যাই। সকালে হাঁটাহাঁটি করি গ্রামজুড়ে। বিকেলে এক সঙ্গে বাজারে যাই। ঘরে বসে তার পাশে শুই। গল্প করি। ছোট বাবুদের মতো তার চুল নিয়ে টানাটানি করি। গায়ের সঙ্গে গা ঘসি। জীবনে এই একবার এমনটি হয়েছে, আর হবে না, আর না। এবার থেকে কিছুদিন শুধু আব্বার কাছেই থাকব।
বাবা আজকাল ভীষণ অসুস্থ। তাঁর ধৈর্য কমেছে কিছু। শুধু অভিমান করেন। যদিও বুঝতে দিতে চায় না। টেলিফোনে কথা বললে আমি বুঝি, আব্বা ভালো নেই। আমার অসুখের কথা শুনলে বিচলিত হন। বলেন চলে আয়। আমি ভাবি চলে গেলেই কী সমাধান। কত কাজ এখন বাকি। যে আদর পেয়েছি, যে যত্ন পেয়েছি এমন বন্ধুর মতো বাবা না হলে আমার এই সম্মানজনক কাজ পেতাম না। পড়াশোনার জন্য, প্রাইভেট মাস্টারের টাকা জোগাড় করতে ভালো জামা কাপড় পরতে পারেননি। খুব যে সচ্ছল ছিলাম তা নয়। এক হিসাবে পরিবারের সবাই আমরা টানাটানিতেই বড় হয়েছি। বাবা কোনো কার্পণ্য করেননি তার সন্তানদের জন্য। দুরান্তে কাজে গেলে মায়ের হাতে রান্না করা খাবার নিয়ে যেতেন সাশ্রয়ের জন্য। ময়মনসিংহ উচ্চ বিদ্যালয়, কালিগঞ্জ পাইলট স্কুল, কালীগঞ্জ শ্রমিক কলেজ থেকে ঢাকা পলিটেকনিক, বাংলাদেশের চাকরি, প্রতিবার বিদেশে আসার পেছনে আব্বার অর্থ, শ্রম, ত্যাগ কী করে ভুলি। কী করে ভুলব।
ভবিষ্যতের ভাবনায় অমানুষ হয়ে যাই মাঝে মাঝে। বিদেশে থেকে সংসার জীবনের অনেক কিছুই সমস্যা অলক্ষ্যে থেকে যায়। রাগ হয়। যদিও সামনে গিয়ে আজও প্রকাশ করি না।
ভবিষ্যৎ ভাবতে গেলেই অন্যায় বেড়ে যায়। আমার শরীর ভালো থাকে না। রোগের এক ডিপো আমি। কখন কী হয়ে যায় জানি না। আব্বা তার প্রতিটি সন্তানকে কত ভালোবাসেন সন্তান হয়ে বুঝি না। আজও মাঝে মাঝে টেলিফোনে আব্বু বলে ডাক দেন। মন আনন্দে নেচে ওঠে আমি হয়ে যাই শিশু। যে দিন আব্বু ডাকেন বুঝি আব্বা ভালো আছেন। সেদিন প্রবাসে সারা দিন যেন কানে বাজে আব্বার ডাক, ‘আব্বু’ মন খারাপ হলে বলবে, বল!
মাকে যে কত ভালোবাসেন কী করে বলব। আমার বউ বলে আব্বা–আম্মাকে দেখে শেখ, তাদের ভালোবাসা এত গভীর, মা নানা বাড়ি গেলে বাবা অস্থির হয়ে যান। শূন্যতায় ঘিরে রাখে তাকে। আমার মেয়েরা দাদা ছাড়া কিছুই বোঝে না। বাবাও নাতিনদের বায়না, আদরে ভালো থাকেন। এখন ছোট ভাইয়ের ছেলে তার বন্ধু। বাবার বংশ প্রদীপ।
আমার বাবার একটা কষ্ট আছে, আমি চেষ্টা করেছিলাম দূর করতে পারিনি। ক্ষমা করো বাবা, আমি পারিনি। কষ্টটা মায়েরও। তবে আমি বলব আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা, আমার বাবা আমার হিরো।