আমার সে ভুল
কৈশোরে যখন স্বপ্ন বুনে দুটি চোখ, ঠিক সেই বয়সে বিয়ে হয়ে যায় আমার। ঘর সংসারের কাজ শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকেই শিখেছি। তিনি বকাঝকা করলেও আমি ভয়ে কোনো টু-শব্দটি করতাম না। আমার স্বামী জয়নাল, বলেই জিভ কেটে নিলাম।
স্বামীর নাম যে মুখে নিতে নেই। আমি ‘উনি’ বলেই বলি, তাতে সবাই বুঝে যায়। উনি ঢাকা শহরে কমলাপুরের রেল স্টেশনে কাজ করেন; আমার চেয়ে বয়সে ১২/১৪ বছরের বড় হবেন। যখনই বাড়ি আসেন, পরিবারের জন্য কিছু না কিছু আনেন। আমার জন্য লেইস ফিতা, কাচের চুড়ি, কুমকুম, আলতা ইত্যাদি আনেন। আমি উনি থাকলে ঠোঁটে লিপস্টিক দিই, টিপ লাগাই। তবে তাঁর পছন্দ আমার হাতের মেহদি। কিন্তু শাশুড়ি খুব রাগ করেন। কারণ, মেহেদি দিলে কোনো কাজ করতে পারি না। তাই কোনো কোনো সময় রাতে দিয়ে রাখি। আমাদের বাড়ির বাইরের বড় ঘরে অনেক বাচ্চা বাংলা পড়তে আসে। আমার দেবররা ওদের পড়ায়। আমি প্রতিদিন কলসিতে পানি ও একটা গ্লাস দিয়ে রাখি। ওই ঘর ঝাড়ু দেওয়া বা পরিষ্কার রাখা—সেটা আমিই করি। এখন দিন বড় হওয়ায় দুপুরে খাবার পর কাঁথা সেলাই করি। শীত আশার আগেই শেষ করে ফেলব।
আমার ঘর আর ওই বড় ঘরটা আড়াআড়ি। তাই বাচ্চাদের পড়ার শব্দও আসে। আজ সারা দিন খুব বৃষ্টি। তাই ঘর আর লেপা হয়নি। হাঁস-মুরগি সব খোঁয়াড়ে। আমি উনুনে একটা বাটিতে অল্প চাল লবণ পানি দিয়ে খোলায় ভাজলাম। সঙ্গে সরিষার তেল, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, ধনিয়া পাতা দিয়ে মাখলাম। এমন সময় বড় ঘর থেকে আস্তে আস্তে কথা বলার শব্দ পাই। আবার মনে হচ্ছে কান্নারও শব্দ। যা হোক বাটিতে করে চালভাজা নিলাম সবাইকে দেব বলে। আবারও কান্নার শব্দ। আমি মাথায় কাপড় দিয়ে এলাম দেখতে। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। টিনের ঘর বলে উঁকি দিতেই দেখি দেবর একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করার জন্য চেষ্টা করছে। আমি জোরে ধাক্কা দেওয়ায় দরজা খুলে গেল। দেবর আমাকে দেখে দৌড় দিয়ে বের হয়ে গেল।
বাচ্চাটির তেমন কোনো খতি হয়নি আমি চলে আসায়। আর খাওয়া হলো না আমার। কাকে বলব এই কথা বুঝে পাচ্ছি না। উনি আসবেন পাঁচ দিন পর। রাতে খাবার বেড়ে দিলাম সবাইকে। কিন্তু দেবর আর খায়নি। আমিও খেতে পারলাম না। শুয়ে আছি মাঝরাতে হঠাৎ দরজায় শব্দ। কে, জানতে চাইলেই দেবরের উত্তর, ‘ভাবি, একটু কথা ছিল। আমি অনেক বড় অপরাধ করেছি। একটু দরজাটা খুলুন।’
আমি কিছু না ভেবেই খুললাম। ও ভেতরে ঢুকেই একটা ছুরি দেখিয়ে আমার সর্বনাশ করে ফেলল। যাওয়ার সময় বলে গেল, যেন কেউ না জানে। বাচ্চাটার কথা বলে, খারাপ কোনো কাজ সে করেনি। শুধু গায়ে হাত দিয়েছে। এটা সে সব মেয়েদের সঙ্গেই করে। এটাতে ওরা যদি কিছু না বলে, তবে কেন আমি গেলাম?
সেই বাচ্চাদের কথা মাথা থেকে চলে গেল। কিন্তু আমার কথা যদি কেউ জানে তাহলে সংসার আর করা হবে না। বিয়ের এখনো বছরও ঘোরেনি। আমি এই পোড়া মুখ সকালে কীভাবে দেখাব? খুব সকালে উঠে ভাবলাম, পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাই। বাপের বাড়িতেও মুখ দেখাতে পারব না। নানা রকম চিন্তার মধ্যেই ভোর হলো। পাকের ঘর থেকে শাশুড়ির শব্দ পাচ্ছি। তাড়াতাড়ি উঠে এলাম। আটা ছেনে রুটি বানাচ্ছি। শাশুড়ি বললেন, তাড়াতাড়ি করো। নাশতা খেয়ে ছেলে আমার বই আনতে শহরে যাবে। শুনে ভয়টা কাটল। কাজ শেষে চাপকল থেকে পানি ভরছি; দেখলাম ও বেরিয়ে গেল। দুপুরে খাওয়ার পর মা বললেন, ২-৩ দিন পর ও আসবে। আমি মনে মনে শান্তি পেলাম। এদিকে উনি আসার সময় ঘনিয়ে এল। হালকা শীতও পড়তে শুরু করেছে। প্রায় প্রতিদিনই কাঁথাগুলো রোদে শুকাই। শাশুড়ি আর আমি কিছু চালের গুঁড়ি করে রেখেছি। আম্মা খেজুরের গুড় প্রতিদিন জাল দিয়ে দিয়ে ঘন করেন। পিঠা বানানোর আয়োজন।
উনি সকালেই বাড়ি ফিরলেন। তখনো আমাদের নাশতা করা হয়নি। জানি না কেন যেন ওনাকে দেখে বুকের ভেতর ধড়ফড় করে উঠল। আনন্দের চেয়ে বেশি ভয় লাগছিল। আমাকে বললেন এক কাপ চা দিয়ো। চা নিয়ে ঘরে আসতেই শাশুড়ি বললেন, ‘এদিকে এস।’ দুপুরের খাবারের জোগাড় করছি—এমন সময় কিছু লোক এসে রামিম, আমার দেবরকে খুঁজছিল। উনি বের হয়ে তাদের সঙ্গে কথা বললেন। দুপুরে খাওয়ার সময় উনি বললেন, ‘শোনো রামিম এলে ওকে বল, বাচ্চাদের যেন গায়ে হাত না তোলে। বাচ্চারা পড়াশোনা না পারলে চেষ্টা করবে। আর তুমি তো আইএ পাস করেছ। তুমিও ওদের পড়াতে পার।’ মনে মনে ভাবি, যখন বলেছিলাম পড়ানোর কথা; রাজি হওনি। আমি ভয়ে ওনাকে আর কিছুই বলিনি। সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
তখন শেষ বিকেল। মুরগিরা খোঁয়াড়ে ঢুকছে। আমি দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে দিলাম। উঠানে তখনো কিছু আলো-আঁধারির উঁকিঝুঁকি। হন্তদন্ত হয়ে রামিম এল। আমি দৌড় দিয়ে আম্মাকে বলি, আপনি ওর সঙ্গে কথা বলবেন, যা উনি আমাকে বলেছেন। আম্মাসহ আমরা তিনজনেই খেতে বসি। মাটিতে মাদুর পেতে। রামিম খায় আর আমাকে দেখে। আমি তাড়াতাড়ি উঠে যাই। সে আমার ঘরে এসে বলে, ‘ভালোই হলো। তুমি বাংলা পড়াও, আর বাকিটা আমি দেখব।’
রামিম আর আমার সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করেনি। বরং আমার অনেক খেয়াল রাখতে শুরু করে। এভাবে ভালোই দিন কেটে যাচ্ছে। আমি ক্রমেই ওর প্রতি দুর্বল হতে শুরু করি। ও বুঝতে পারে। একদিন বৃষ্টির সন্ধ্যায় ও ঘরে রেডিওতে গান শুনছে। মনে হলো আমাকে শোনাচ্ছে। অনেক রাতে হঠাৎ দরজায় হালকা শব্দ। আমি অপেক্ষা না করেই খুলে দিই। এবার কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়েনি। হেসে বলেছে, ‘জানতাম আমার অপেক্ষায় আছ।’
আমি পাগলের মতো ওর ভালোবাসার অপেক্ষায় থাকতাম। বেশ অনেক দিন পার হলে উপলব্ধি করি, আমি এক সর্বনাশের দিকে এগোচ্ছি। এক-দুই করে আমি চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামী বাড়ি এলে তাঁকে সুখবরটা দিই। উনি শুনে খুশি হন। কেন যেন শাশুড়ি খুব একটা খুশি হননি। ছেলে আর মা অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলেন। সকালে উনি চলে গেলে রামিমকে বলি, কী নিয়ে এ কথা হলো, তুমিও তো ছিলে? সে বলে, ‘না তেমন কিছু না। বাংলা ঘরে একজন মাস্টারনি দরকার। তুমি তো অসুস্থ তাই।’ আমিও অবুঝের মতো ওকে বিশ্বাস করি। পরদিন আম্মা বলেন, ‘রামিম তোমাকে তোমার বাপের বাড়ি দিয়ে আসবে।’ আমি খুশি হই। যাত্রাপথে রামিম আর আমার খুব বেশি কথা হয়নি।
আমি এখানে আছি প্রায় দু মাস। রামিম বা ওর ভাই কেউ আমার খোঁজ না নেওয়াতে আব্বা যান ওদের বাড়ি। আব্বা ফিরে আমার সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করেন। সন্তানের বাবা কে, তা আমার কাছে জানতে চান। আমি তো হতবাক। ওদের বাড়িতে সালিস বসানো হয়। আমাকেও আনা হয়। সেখানে উনি বললেন, ‘আমি যেহেতু প্রতি মাসে আসতে পারি না এবং ওর শরীর ভালো থাকে না, তাই আমি হিসাব করে দেখেছি, এই বাচ্চা কখনোই আমার নয়।’ উনি কথা শেষ না করতেই আমার চোখ রামিমের দিকে যায়। ও বলে ওঠে, ‘মাঝেমধ্যে ভাবির ঘর থেকে ফিসফিস কথার শব্দ আসত। ভাবতাম, ভাইজান হয়তো এসেছেন। কিন্তু না পরপুরুষেরা প্রায় প্রতি রাতেই আসত। একদিন ধরেও ফেলেছিলাম। ওনার বাপের বাড়ির পুরোনো আশিক। মাফ চেয়ে চলে গেছে। এখন আপনারা যদি ওকে নাম বলার চাপ দেন, তাহলে আমার নামও নিতে পারে। এই গ্রামে আমাদের একটা মান-ইজ্জত আছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের আপনারা সবাই চেনেন। আপনারাই বিচার করুন।’
আমি শুধু আমার অসহায় আব্বার মুখটা দেখছিলাম। অপমানে আমার আত্মহত্যা করার ইচ্ছা হচ্ছিল। সবাই এত খারাপ কথা বলছিল যে, তা আর শুনতে না পেরে মূর্ছা যাই। জ্ঞান ফিরলে দেখি খাটে শুয়ে আছি। আমি কী আশায় কী পেলাম? বয়সের থেকে বেশি বয়স্ক স্বামী, আর যাকে ভালোবাসলাম সে দিল এত বড় ধোঁকা? আমার জন্য বাবা-মা কত অপমানিত হলেন। আমি আর বেশি কিছু না ভেবেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিই। আমার অবর্তমানে একদিন ধীরে ধীরে সব কথা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু আমার ভালোবাসার ভুলের মাশুল আমাকেই দিতে হলো।