আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবার গল্প

সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক

বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব ইতিহাস ও এর স্বাধীনতা নিয়ে ‌‌অনেক নাটক, সিনেমা, গল্প, উপন্যাস আমরা পড়েছি, দেখেছি। জেনেছি অনেক হৃদয়বিদারক ইতিহাস ও ব্যক্তি জীবনের মর্মান্তিক ঘটনার কথা। জেনেছি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা; একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের কথা। সব স্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তখন। বাঙালিদের অস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও তারা বুদ্ধি দিয়ে হানাদারদের যুদ্ধে কুপোকাত করেছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল এক অন্যতম অধ্যায়।

দেশের সাধারণ মানুষ, পেশাজীবী, নারী-পুরুষ, গণমাধ্যমকর্মীসহ প্রবাসী বাঙালিরাও এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অবদান রেখেছেন। এই সব ইতিহাসই আমরা জানি। তারপরও কথা থেকে যায়। ইতিহাসে কিছু ঘটনা, কিছু কাহিনি না বলা থেকে যায়।

সেই দুঃসময়ে যারা এক গ্লাস পানি দিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের তৃষ্ণা মিটিয়েছেন, তাঁদেরও আমি মুক্তিযোদ্ধা বলে সম্মান দিতে চাই। আমরা আজকের প্রজন্ম সেই আড়ালে থেকে যাওয়া অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা, সৈনিকদের কথা তেমন জানি না। নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাওয়া এমনই একজন আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবা, যাকে নিয়ে কখনো দুটি শব্দ লেখা হয়নি আমার।

আমার বাবা সামসুদ্দীন আহমেদ এছাক। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন অন্য রকমভাবে। যুদ্ধকালে বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষদের খাদ্য বিতরণসহ মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া, অস্ত্র সুরক্ষিত রাখা, শারীরিকভাবে যোদ্ধাদের সেবাসহ বিভিন্ন এলাকায় জনতাকে উৎসাহিত ও ‌অনুপ্রাণিত করেছেন তিনি। বাবা ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নাম না জানা বহু মানুষের অংশগ্রহণ ছিল বহুমাত্রিক। দেশের ভেতরে ও বাইরে শরণার্থী ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করা, চাঁদা তোলা, ওষুধ, খাবার, কাপড় সংগ্রহ করা, ক্যাম্পে ক্যাম্পে রান্না করা, সেবা করা, চিকিৎসা করা, অস্ত্র শিক্ষা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবে কাজ করা, আরও কত কী। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের বাবার নীরবে সহযোগিতার কথা নরসিংদীর এলাকাবাসী এখনো স্মরণ করেন। এর সবই আমার মা-বোনের মুখে, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীর মুখে শোনা।

যুদ্ধের সময় বাবা বাস করছিলেন এখনকার নরসিংদী জেলা শহরের বৌয়াকুড়ে। সে সময় আমার বড় তিন ভাইবোন ছোট ছিল। সেজো ভাই তখন হামাগুড়ি দিতে শিখেছে মাত্র। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। থমথমে মধ্যরাত। অন্য সব রাতের চেয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসে এই রাতটি একটু আলাদা। কারণ, এই রাতের মধ্য দিয়েই শুরু হয় আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের এই অভিযানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্বিচারে সাধারণ মানুষদের হত্যা করে।

মূলত সেদিনই শুরু হয়েছিল আসল যুদ্ধ। ২৫ মার্চ পরিকল্পিত গণহত্যার মুখে সারা দেশে শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ। জীবন বাঁচাতে হাজার হাজার নেতা-কর্মী পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। সাধারণ মানুষ নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য আশ্রয় খোঁজে। শহরের লোকজন নিরাপত্তার জন্য গ্রামাঞ্চলের দিকে যাত্রা করে। কিন্তু সেই ভয়াবহ দুঃসময়েও আমার বাবা নিজ এলাকা ছেড়ে যাননি। পারিপার্শ্বিক অবস্থা ছিল ভয়ানক তখন।

বাবার নিজ আত্মীয়দের কেউ কেউ ছিলেন পাকিস্তানি হানাদারদের অনুগত দাস। রোজ রাতে সেই আত্মীয়রা এসে দাদিমার কাছে জানতে চাইতেন তাঁর ছেলে কোথায়! দাদি বলতেন, ‘ঘরেই আছে।’ তাঁরা ঘরে ঢুকে পরখ করে দেখে নিতেন আসলেই বাবা বাড়িতে আছেন, নাকি যুদ্ধে গিয়েছেন।

আমার বাবা ছোট থেকেই ছিলেন বুদ্ধিমান। পরিস্থিতি সামাল দিতে জানতেন। তাই সারা দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় থাকলেও রোজ রাতে তিনি ফিরে আসতেন বাড়িতে। বিধবা মা, বোন, স্ত্রী ও তিনটি শিশু সন্তানকে নিরাপদ রাখতে এবং নিজেকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখতে তিনি এই কৌশল অবলম্বন করতেন। বাবা ছিলেন দাদির তিন সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে সন্তান। দাদিমা তাঁর একমাত্র ছেলে সন্তানটিকে নিয়ে আতঙ্কে থাকতেন। দাদি ছিলেন বেশ সুন্দরী। আমার মা তখন কিশোরী। তাঁরা দুজনও ছিলেন বাবার আতঙ্কের কারণ।

তবে একটা সময়ের পর বাবার আত্মীয়রা সন্দেহ করতে শুরু করেন। তাঁরা নানাভাবে দাদিকে ইঙ্গিত করতেন, হুঁশিয়ার করতেন। পরে পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয় যে, পরিবার নিয়ে বাবা তাঁর আদি বাসস্থান নরসিংদীর চরাঞ্চল নজরপুর ইউনিয়নের নবীপুর গ্রামে চলে যান। নিরাপদে সেখানে পরিবারকে রেখে একই উদ্যমে বাবা যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।

সারা দেশের অগণিত মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রতিরোধের মুখে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে হাজারো সৈন্যসহ পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের অবসান হয়। আমরা পাই এক স্বাধীন বাংলাদেশ।

আমার বাবা শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন সফল রাজনীতিবিদ। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ১৯৬৮ সালে প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন শ্রমিক সংগঠনের মাধ্যমে। শ্রমিক নেতা হিসেবে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৯ সালে নরসিংদীতে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন তিনি। বেশ কয়েকবার আন্দোলনের জেরে কারাভোগও করতে হয়েছে তাঁকে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শ্রমিক নেতা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে ১৯৭৩ সালে নরসিংদী পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বাবা। ১৯৭৯ সালে প্রথমে ইউনাইটেড পিপলস পার্টিতে (ইউপিপি) যোগ দিয়ে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। এর পর ১৯৮৪ ও ১৯৮৯ সালে দুবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। শিল্প-সাহিত্য অনুরাগী আমার বাবা ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার ও সুরকার।

বাবা গত হয়েছেন মাত্র ৬৪ বছর বয়সে; ২০০৫ সালের ২৭ মার্চ। এ মাসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি আমার বাবা সামসুদ্দীন আহমেদ এছাকসহ সব মুক্তিসেনাদের, যাদের অবদানে আজকের এই বাংলাদেশ। বাবা বেঁচে থাকলে আজ বলতাম, ‘বাবা! একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত।’