আমার বড় খালা

ডিসেম্বর ১৭, ভোরবেলা। মেসেঞ্জার কলে ঘুম ভেঙে গেল। এত সকালে ফোনকল রিসিভ করতে চাইনি। অনেক রাতে ঘুমোতে গিয়েছিলাম। দেখলাম, মামাতো ভাই সরোয়ার মস্কো থেকে। টেলিফোন ধরলে তাঁর সঙ্গে অনেক সময় কথা বলতে হবে। হয়তো নিউইয়র্কের সময় নিয়ে ভাবেনি। মস্কোর সঙ্গে সময়ের পার্থক্য আমারও মনে থাকে না। কিছু সময় ঘুমিয়ে তাকে রিটার্ন কল করব, তাই আবার ঘুমাতে গেলাম। এক ঘণ্টা পর আবারও কল। এবার আমার বন্ধু সুনামগঞ্জ ও সিলেট বারের আইনজীবী শহীদুজ্জামান চৌধুরী। ভয় পেয়ে গেলাম, বেদনাদায়ক কোনো দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে হয়তো। বিদেশ বিভুঁইয়ে। তিনি জানালেন, আমার বড় খালা হাছন রাজার কনিষ্ঠ ছেলে দেওয়ান আফতাবুর রাজা চৌধুরীর সহধর্মিণী সৈয়দা জেবুন্নেছা খাতুন চৌধুরী (সুরমা বিবি) আর নেই। কয়েক ঘণ্টা আগে পরপারে চলে গেছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। ৯৬ বছর বয়সে তাঁর এই মৃত্যু অত্যন্ত স্বাভাবিক হলেও আমাদের জন্য বিরাট মহিরুহের চলে যাওয়া। আমরা ভাই–বোনেরা তাঁকে বড় মই বলে ডাকতাম। মুহূর্তে আমাদের অসহায় ছোট বেলার স্মৃতিগুলো ভেসে উঠল।

১৯৬৬ সাল। খুব ছোট তখন। সন্ধ্যায় খেলাধুলার পর বাসায় এসে দেখি ছোট মই, চাচি ও আত্মীয়স্বজনে আমাদের বাসা পরিপূর্ণ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জানলাম, আম্মা আর নেই। কিছুক্ষণ আগেও সবাইকে দেখেছি আম্মার সঙ্গে কথা বলতে। ছোট ভাই ও বোনকে কেউ কোলে তুলে সরিয়ে নিলেন।

বিকেলে এক পলক আম্মাকে দেখেছিলাম ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছিলেন। ছোট মইকে খবর দিতে বলেছিলেন। আমাদের পুকুর পাড় আর তাদের পুকুর পাড় লাগোয়া। আমি না এনাম ভাই ছোট মইকে আম্মার খবর দিতে গিয়েছিলাম, মনে পড়ছে না। আম্মা সুস্থা নাকি অসুস্থ, সেটা বোঝার মতো জ্ঞান আমার হয়নি। আম্মার শরীর এতটা খারাপ ছিল না যে, পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে। সবার সঙ্গে হতবিহ্বল হয়ে আমিও কাঁদছিলাম। আব্বা অফিসের কাজে বাইরে ছিলেন। টেলিগ্রাম পেয়ে তাৎক্ষণিক ফিরে আসলেন। মনে হলো, আম্মাকে বাজপাখির মতো কেউ ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেছে। আমাদের ভাইবোনদের আর কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকল না। আম্মাকে হারিয়ে মুহূর্তে আমরা অকুল সাগরে ভাসতে লাগলাম।

আম্মার আকস্মিক মৃত্যুর খবর পেয়েই বড় মই ঢাকা থেকে উড়ে এসে আমাদের পাঁচ ভাইবোনকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। আব্বার কোনো কথাই শুনলেন না। আব্বাকে বললেন, আমার বোনের এমন মৃত্যুর পর তাঁর ছেলেমেয়েদের এখানে রেখে যেতে পারেন না। আব্বা হয়তো অফিসের কাজে ট্যুরে যাবেন, তখন বোনের ছেলেমেয়েদের জন্য আবার কোন সর্বনাশ অপেক্ষা করবে। আব্বা বড় মইকে অনেক শ্রদ্ধা করতেন। কৃষি কর্মকর্তা হওয়ায় আব্বাকে বাধ্য হয়ে ঘনঘন মফস্বলে পরিদর্শনে যেতে হতো। বড় মইর কথার ওপর কিছুই বলতে পারলেন না। আমরা সুনামগঞ্জ থেকে ঢাকায় চলে আসলাম।

আপন ছোট বোনের এমন অপ্রত্যাশিত মৃত্যু বড় মই সহ্য করতে পারেননি। আব্বা ও চাচার ওপর ভয়ানক ক্ষেপে গিয়েছিলেন। যতটুকু মনে পড়ে, তাঁরা কোনো প্রতিবাদ করেননি। আব্বার হয়তো কিছুই করার ছিল না। শহরে মাত্র একটি হাসপাতাল, একটি মাতৃমঙ্গল ও দু-একজন এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন। এলএমএফ ডিগ্রিধারীও কয়েকজন ছিলেন। মাতৃমঙ্গল থেকে দু-একজন নার্স এসেছিলেন মাত্র আম্মাকে দেখতে। বড় হওয়ার পর আম্মার মৃত্যুর কারণ জেনে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। বিষয়টি আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মায়েরা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। এটাই নিয়তি। আমাদের মা তারই শিকার। শৈশবেই মাতৃস্নেহ না পাওয়ার কষ্ট আমাদের অবুঝ মনে গেঁথে গিয়েছিল।

আব্বাকে অনেকবার পদোন্নতি দিয়ে দিনাজপুর, রংপুর ও ফরিদপুর বদলি করা হয়েছিল। আব্বা যাননি। গেলেও কয়েক মাস থেকে চলে আসতেন। আব্বার গাফিলতি হয়তো ছিল না।

ছোট শহরে আত্মীয়স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে আম্মার দিনগুলো কেটে যেত। নানাবাড়ি শহরেই। বাপের বাড়ি যেতে কোনো অসুবিধা হতো না। একমাত্র ছোট ভাইও আম্মাকে নিয়মিত দেখে যেতেন। নিয়তিকে শেষ পর্যন্ত এড়ানো যায়নি। আম্মার অস্পষ্ট স্মৃতির আড়ালে আমরা বড় মইর কাছে স্নেহ–মমতা খুঁজে নিতাম।

তখন থেকে আমাদের ভাগ্যও পেন্ডুলামের মতো ঘুরতে থাকে। ভাইবোনেরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। বড় মই আমাদের ঢাকায় স্থায়ীভাবে রাখতে নিয়ে গেলেন। আব্বার পক্ষে সেটা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।

মালিবাগের বাসায় আমাদের দিন কাটছিল। বড় মইর দুটি স্টেট বাস ছিল। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা-টাঙ্গাইল রুটে চলত। টাঙ্গাইলের চমচম সে সময় প্রথম খাওয়া। সিরাজ মামা বাসের আয়ের টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার সময় প্রায় প্রতিদিনই হাঁড়িতে করে চমচম নিয়ে আসতেন। সে কি স্বাদ! আমাদের মিষ্টি খুব খাওয়া হতো। অনেক দিন এই বাসে করে খালাতো ভাইবোনসহ সারা ঢাকা ঘুরে বেড়াতাম। স্কুটারে করে সিনেমা দেখতে যেতাম। প্রথম মুক্তি পাওয়া ভাওয়াল রাজা সন্ন্যাসী ছবি দেখতে সবাই মিলে গেলাম অভিসার হলে। বড় মই সবার জন্য সিনেমার টিকিটের ব্যবস্থা করে দিলেও নিজে যেতেন না। মোহাম্মদ আলী, অহিদ মুরাদ, জেবা—অনেক নায়ক-নায়িকার বিরাট বিরাট ছবি রমনা পার্কের কোনায়, চৌরাস্তার মোড়ে শোভা পাচ্ছে দেখতাম। টিন দিয়ে বানানো গাছের ফাঁকে থাকা নায়ক–নায়িকার অপূর্ব ছবি এখনো মনে পড়ে। অভিসার হলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুরভিত বাতাস হৃদয় জুড়িয়ে গিয়েছিল। বাতাস এত সুগন্ধ হয়, প্রথম অনুভব করলাম। বাসার সামনে আইসক্রিমের গাড়ি আসলে বাদশাহ নুর আপার কাছ থেকে, কখনো বড় মইয়ের কাছ থেকে পয়সা নিতাম। হট পেটিস তখনই জীবনে প্রথম খাওয়া। স্বাদে ঘ্রাণে অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনাই হয় না। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ঢাকা শহর স্বপ্নের মতো লাগত। সেই দিনের ঢাকার স্মৃতি এখনো উঁকি দেয়।

বড় মই ও বাদশাহ নুর আপার স্নেহ–মমতা পেয়ে আমরা ভাইবোনেরা আম্মার কথা ভোলার চেষ্টা করতাম। ছোট দুই বোন আসমা ও হোছনা, মাসুদ আম্মার জন্য ভীষণ কান্নাকাটি করত। ছোট বোনের কান্না এক মুহূর্তের জন্যও থামতো না। বড় মই খুব ব্যস্ত থাকতেন। ঢাকা শহরে তাঁর আভিজাত্যপূর্ণ চালচলন ও ব্যক্তিত্ব দেখে অবাক হতাম। অধ্যক্ষ দেওয়ান আজরফসহ প্রায় সবাইকে তুমি বলে সম্বোধন করতেন। ফকফকা সাদা মিহি সুতার কাজ করা শাড়ি, ঘিয়ে রঙের কাশ্মীরি শাল ও কালো অবগুণ্ঠনে আবৃত ও শারীরিক গড়নে লম্বা চওড়া অত্যন্ত মার্জিত স্বভাবের বড় মই সুনামগঞ্জে বেড়াতে আসলে পরিবেশ মুহূর্তে বদলে যেত। তিনি যে অসাধারণ সুন্দর ছিলেন, দেখা মাত্রই বলে দেওয়া যেত। আমি দেখেছি, দেওয়ান এখলিমুর রাজা, আনোয়ার রাজা, ওবায়দুর রাজা, কামাল রাজা, আমান রাজা ও অ্যাডভোকেট রফিকুল বারীসহ সবাই বড় মইর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে নুইয়ে পড়তেন। নিজের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব ও গুণাবলি দিয়ে তিনি সেই যোগ্যতা ধরে রেখেছিলেন আমৃত্যু।

শুরুটা খুব কঠিন ছিল। খালু হঠাৎ মারা গেলে শক্ত হাতে পরিবারের হাল ধরেছিলেন। ঢাকা শহরে তাদের অনেক জায়গা–জমি ছিল। প্রচুর জায়গা নিয়ে আগারগাঁওয়ের বিশাল বাড়িটি পাকিস্তান সরকার অধিগ্রহণ করলে ঢাকা থাকার পরিকল্পনা হোঁচট খায়। ভাগ্যক্রমে স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে সুনামগঞ্জে এসেছিলেন। বাদশাহ নুর আপার জেদের কাছে নতি স্বীকার করে পরমাণুবিজ্ঞানী দুলাভাই নুরুজ্জামান চৌধুরী পাকিস্তান অটোমেটিক এনার্জির চাকরি ছেড়ে রাওয়ালপিন্ডির থেকে ঢাকায় চলে আসেন। দেওয়ান জোহের রাজা ভাইও তাদের সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডি গিয়েছিলেন। সেখানকার কলেজ থেকে টিসি নিয়ে ঢাকায় এসে ভর্তি হন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল, তাই আপার জেদে দুলাভাই চাকরি ছেড়ে রাওয়ালপিন্ডি থেকে চলে আসেন নতুবা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সেখানে বন্দী থাকতে হতো।

আব্বা মইয়ের কাছে অনেক কাকুতি–মিনতি করে আমাদের তিন ভাইকে সুনামগঞ্জে এনেছিলেন। বোনেরা ঢাকায় থেকে যায়। আমাদের নতুন আম্মা আসলে প্রায় পাঁচ বছর পর ভাইবোন সবাই একত্রিত হই। মায়ের অভাব গোছাতে সুখে–দুঃখে বড় মইয়ের কাছে চলে যেতাম। তাঁর স্নেহের পরশে হৃদয় জুড়িয়ে যেতো। চমৎকার ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্যে সবাই মুগ্ধ থাকত। কারও সাহায্য–সহযোগিতায় বিন্দুমাত্র পিছপা হতেন না। সে জন্য দেখতাম, ছিন্নমূল পরিবারগুলো ও অসহায় গরিব নারীরা সাহায্যের আশায় বড় মইকে ঘিরে ধরতো। কখনো বাড়িতেই তাদের ঘর বানিয়ে থাকতে জায়গা দিতেন। ওদের ছেলেমেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠলে স্বেচ্ছায় চলে যেত। কেউ কেউ মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে আর যেতে চাইতো না। শেষ দিনগুলোতে বড় মই তাদের নিয়েই সময় কাটিয়ে দিতেন। ওরা নিশ্চিন্তে তাঁর আশ্রয়ে থাকত। বড় মইয়ের বয়সে আর কেউ জীবিত ছিলেন না। এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ নিবেদিত সাহসী বিদুষী নারী ব্যক্তিত্ব আমি দেখিনি। অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।

স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় স্টেট বাস দুটি ধ্বংস হয়ে যায়। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য না গেলেও বেশির ভাগ সময় ঢাকা থাকতেন। রাজধানী তাঁকে খুব কাছে টানতো। বিগত বছরগুলোতে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। আম, জাম, পেয়ারা, কাঁঠালসহ নানা প্রজাতির গাছে সমৃদ্ধ বিশাল বাংলো টাইপের বাগান বাড়ি থেকে খুব একটা বের হতেন না। বাড়ির সামনে ও পেছনে বিরাট পুকুর। মনে হতো, জঙ্গলের ভেতরে নীরবে নিভৃতে এই বিশাল বাড়িতে বাকি দিনগুলো নাতি–নাতনিদের সঙ্গে কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আপনজনেরা দেশে-বিদেশে। মৃত্যুর সময় সুবক্তা রাজা ভাই কাছে ছিলেন। বাদশাহ নুর আপা জার্মানিতে। আমার শেষ দেখা হয়েছিল দুবছর আগে।

দূরদেশে আপনজনদের দুঃসংবাদ এভাবেই চমকে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে আসার কয়েক বছর পার হতেই ১৯৯৫ সালের জানুয়ারিতে আব্বা পৃথিবী থেকে চলে গেলেন। তারও কিছুদিন আগে আমার শ্বশুরকে সমাহিত করা হলো বনানী কবরস্থানে আমার শাশুড়ি আম্মার কাছাকাছি। ছোট মইকেও মৃত্যুর সময় দেখিনি। প্রিয় রোজি ভাবিকেও শেষ দেখা হলো না। কয়েক বছর আগে বনশ্রীর বাসায় আপন বড় বোনের স্নেহমমতা দিয়ে পাশে বসে অনেক গল্প করছিলেন। ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি, সেদিনই ছিল রোজি ভাবির সঙ্গে ঢাকায় আমার শেষ সান্ধ্যভোজ। বিদেশ বিভুঁইয়ে জীবনে হাপিত্যেশ করে আমাদেরও সময় ঘনিয়ে আসবে। ক্ষণস্থায়ী এই ছোট্ট জীবনে কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম! দূরদেশে চিরবিদায় বেলায় পাশে কারা থাকবে, জানা নেই।