আমার বন্ধু মিঠু

প্রতীকি ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকি ছবি। সংগৃহীত

মিঠুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা যেদিন সে অ্যারিজোনা যায়। সেদিন ওকে পৌছে দিতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম। জীবনের সবচেয়ে ভালো ও কাছের বন্ধুটিকে বিদায় বলতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। যেকোনো সময় যেকোনো পরিবেশে মানিয়ে নিতে পাড়া সেই মিঠু এখন হয়তো অ্যারিজোনাতে ভালোই আছে। মেধা, মনন, বিনয়, চটপটেভাব আর অধ্যবসায়—এসব বৈশিষ্ট্য দিয়ে সবার মন জয় করে নিত নিমিষেই। এত ভালো বৈশিষ্ট্য আর দুর্ভাগ্যের সমন্বয় মিঠু ছাড়া আর কারও মধ্যে আমি দেখিনি। কোনো দিন দেখব বলে মনেও হচ্ছে না। অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর ভর্তির ব্যাপারটি যখন নিশ্চত হলো, তখন ওর বাসায় গিয়েছিলাম ওকে অভিনন্দন জানাতে। সেই দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে ওর সে কী কান্না! আমি বারবার বলছিলাম, ‘আজ তো তোর আনন্দের দিন। তোর সব সাধনার ফল আজ তুই পেয়েছিস। আজ তোর হাসার দিন। আজ আর কোনো কান্না নয়...।’ ওই দিন সারা দিন ধরে ওর সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় ওকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘মিঠু তুই কি আর কোন দিন বাংলাদেশে ফিরে আসবি না?’ জবাবে ও বলল, ‘বাংলাদেশ আর এ দেশের মানুষের সঙ্গে আমার এক অদৃশ্য সুতার বন্ধন আছে। কোনো দিন সেই বন্ধন যদি ছিঁড়ে না যায়, তবে হয়তো ফিরে আসব।’
সেই কলেজ থেকেই আমাদের চেনাজানা। শিক্ষা জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় অসাধারণ ফল করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মিঠু সরকারি বৃত্তি নিয়ে লেখাপড়া করত। এমনকি বুয়েটেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অসাধারণ ভদ্র, বিনয়ী আর চটপটে স্বভাবের মিঠু খুব সহজেই ওর চটপটে ভাবের আড়ালে দুঃখকষ্টকে লুকাতে পারত। গভীর চাপা স্বভাবের মিঠুকে বাইরে থেকে দেখে ওর জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। দারুণ আত্মবিশ্বাসী মিঠু কখনোই ওর কথায় বা কাজে কাউকে আঘাত পেতে দিত না। কলেজের পাঠ চুকিয়ে ওর মেধা আর যোগ্যতা বলে ও স্থান করে নিল বুয়েটে। কিন্তু আমি আর অঞ্জন সেটা পারিনি। ব্যাচেলর শেষে মিঠু চলে যায় অ্যারিজোনায়, অঞ্জন চিটাগাং আর আমি চলে আসি চীনের উহান।
আজ কেন জানি না, মিঠুকে খুব মনে পড়ছে। মনে পড়ছে সেই কলেজ জীবনের কথা। ক্লাসের ফার্স্টবয় হিসেবে মিঠু সবার কাছেই বেশ পরিচিত ছিল। আমি কখনোই ওর মতো মেধাবী ছিলাম না। তাই মিঠু ও অঞ্জন সব সময়ই ক্লাসে আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকত। কিন্তু আমাদের তিন বন্ধুর সম্পর্ক এমন ছিল যে, তা অনেকেরই চোখে লাগত। এমনকি মিঠু যখন আমাদের বাড়ি যেত, মা যেন আমাকে ভুলে মিঠুকেই তার সন্তান ভাবতে শুরু করতেন। আর মিঠুও মাকে সব সময় মা বলেই ডাকত।
প্রথম বর্ষ সমাপনী পরীক্ষা শেষে বনভোজনে গিয়ে আবিষ্কার হলো মিঠুর জীবনের নতুন গল্প। ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী আর সবচেয়ে ধনাঢ্য বাবার একমাত্র কন্যা অজন্তা যে মিঠুকে গোপনে গোপনে এত ভালোবাসে, সেটা আমরা কেন, মিঠু নিজেও জানত না। এ নিয়ে সবার মধ্যে হালকা তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। “রতনে রতন চিনে” এ রকম একটা সমর্থনসূচক উত্তেজনা সবার মধ্যেই দেখা গেল।
বনভোজন থেকে ফিরে এসে অঞ্জন আর আমি মিলে মিঠুকে বেশ উৎসাহ দিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মিঠু নামের সেই অচল পাথরটি যেন কিছুতেই সচল হচ্ছিল না। এত উচ্ছল, চঞ্চল মিঠু, অজন্তা প্রসঙ্গ এলেই যেন একদম চুপ। কিছুতেই ওকে রাজি করানো যাচ্ছিল না। শেষে একদিন অনেকটা জোর করেই অঞ্জন মিঠুর শেষ মতামত জানতে চাইল। মিঠু হাত জোর করে বলল, ‘তোরা আমার জীবন ইতিহাস না জেনে আমাকে আর জোর করিস না।’ আমি বললাম, ‘কী তোর জীবন ইতিহাস, যা আমরা জানি না। বল, আমরা শুনতে চাই।’ জবাবে মিঠু বলল, ‘বলব, আমি তোদেরই তো বলব। তবে এখন নয়, সময়মতো আমি সব বলব তোদের। তবে শর্ত হচ্ছে, আমার এ গল্প কাউকে জানাতে পারবি না। আমি চাই না আমার এ গল্প শুনে কেউ আমাকে করুণা করুক।’ আমরা ওর শর্তে রাজি হলাম।
এর কয়েক দিন পর এক সন্ধ্যায় মিঠু অঞ্জন আর আমাকে ওর রুমে যেতে বলল। বুঝতে বাকি রইল না যে, আজ ওর জীবনের সেই না বলা গল্প শোনাবে। এমনিতেই আমরা একসঙ্গে হলে হই হুল্লা আর হট্টগোলের অন্ত থাকে না। আর সেদিন মিঠুর সেই গল্প শোনার জন্য ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল। কিন্তু মিঠুর জীবনের সেই নিগূঢ় নিদারুণ গল্প আমাদের সব উচ্ছলতা কেড়ে নিল। মিঠু আমাদের কলেজের পেছনে খোলা আকাশের নিচে এক মাঠে নিয়ে গিয়েছিল। মিঠু বলতে শুরু করল, ‘তোর মাকে আমি কেন মা বলে ডাকি জানিস? কাউকে মা বলে ডাকতে আমার খুব ইচ্ছে করছিল। জীবনে তো কাউকে মা বলে ডাকিনি। তাই এই অপূর্ণ সাধটা তোর মাকে দিয়েই পূর্ণ করলাম। মা বলে ডাকতে পাড়ার আগেই তো মাকে হারিয়েছি। এরপর বাবা নামের দেবতুল্য যে মহান বটবৃক্ষ তলায় আমি বড় হতে লাগলাম, একটু বুঝতে শেখার পরে জানলাম, আমাকে ছায়াদানকারী সেই দেবমানবটিও আমার বাবা নয়।’
ওর গল্প শুধু আমাদের উচ্ছ্বলতাকেই নয়, সমস্ত বাকশক্তিকেও কেড়ে নিল। কারণ, ও ঈদের ছুটিতে ওদের বাড়ি যেত। প্রায়ই বলত, আমার মাকে হুবহু ওর মায়ের মতো মনে হয়। ওর কাছে নাকি মনে হয়, পৃথিবীর সব মা–ই সমান। তখনি কেবল জানলাম, এ সবই ওর কল্পনা। আর ঈদে বাড়ি যাবার কথা বলে ও আসলে অন্য কোথাও যেত। সবার পরে যেত এবং সবার আগে আসত। ওর গল্প শুনে বুঝলাম এর কারণ। মিঠু ননস্টপ বলে চলল, ‘কিন্তু যতদিন আমার সেই বাবা বেঁচেছিলেন, শত কষ্টের মধ্যেও আমাকে কোনো আঘাত পেতে দেননি। কিন্তু আমি যে দুর্ভাগা। এ রকম বাবার সান্নিধ্য কি আর আমার ভাগ্য বেশিদিন জোটে? ক্লাস সেভেনে এসে আমি আমার সেই বাবাকেও হারাই। এরপর থেকে শুরু হলো আমার জীবনে টিকে থাকার লড়াই। আমার সেই চাচারা কখনোই চাননি আমি তাদের বাড়িতে থাকি। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তাঁরা তাঁদের ইচ্ছেটা স্পষ্ট করেই প্রকাশ করতে লাগলেন। এমনকি তাঁরা এ জন্য ভয়ানক কিছু ব্যবস্থাও নিলেন। তাই জীবন বাঁচাতে আমাকে সেই বাড়ি ছাড়তে হলো। এরপর কত দিন, কত রাত যে কত কষ্টে কাটিয়েছি, তা কাউকে বোঝানো যাবে না। হঠাৎ কোনোভাবে আমার স্থান হয় খুলনার এক দিনমজুরের বাসায় লজিং মাস্টার হিসেবে। এর পরে ভর্তি হই স্থানীয় এক স্কুলে। এসএসসি শেষ করে ভর্তি হলাম এই কলেজে। আমি জানি না কে আমার মা, কে আমার বাবা, কিই বা আমার পরিচয়। এই পৃথিবীতে আমার তো কিছুই নেই। আমার এই ছন্নছাড়া জীবন আর অনিশ্চিৎ ভবিষ্যৎ আমি না হয় কোনোমতে কাটিয়ে দিব। কিন্তু অজন্তার মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো এত ভালো কোনো মেয়ের ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা কি আমি রাখি, বল! তোরা ওকে বলিস, ও যেন আমাকে ক্ষমা করে...’
তরিকুল ইসলাম তারেক
উহান, চীন থেকে
<[email protected]>