আমার দেশ বুকভরে ধরে রাখে কিছু শান্তি

চারদিকে সমুদ্রবেষ্টিত অস্ট্রেলিয়া। এরই মাঝে একখণ্ড সাগর সৈকত মারোবরা। চোখ জুড়ানো মনোরম এ সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে সাগরের ঘ্রাণমাখা নির্মল বাতাসে তৃপ্তির নিশ্বাস। অবিরল পাথরের ভেজা বুকে হিম সবুজ ঘাস। মনে হয় ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে’ কে যেন আসবে এখন। হৃদয়ের সব ভালোবাসা দিয়ে হয়তো বলবে, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন’। এভাবেই আশার বৃষ্টিতে একদিন জুড়াবে আমার এ ক্লান্ত দেহ।
পৃথিবীর প্রথম সারির এ দেশে এত রকমারি আয়োজনের ভেতরও কী এক অতৃপ্তি গুমরে গুমরে কাঁদে এ বুকে। হয়তো আমি বাঙালি বলেই আমার শেকড় ক্ষণে ক্ষণে আমাকে ডাক দেয়। তাই এবার দেশে বেড়াতে গিয়ে আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ভ্রমণে যাই। সেদিন বন্ধুরা সবাই সমুদ্রে নেমে উল্লাসে মেতে আছে। রঙিন ছাতার নিচে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছি। অসংখ্য মানুষের ভেতর থেকে হঠাৎ করেই কেউ আসে বাদাম নিয়ে, কেউ ঝালমুড়ি, আমড়া, বরই আচার। আতিথেয়তার শেষ নেই যেন। এরই মধ্যে দোতারা নিয়ে হাজির হলেন এক বাউল শিল্পী। মনটা যেন কেমন করে ওঠে। শিল্পীকে অনুরোধ করতেই শুরু হলো শাশ্বত বাংলার গান। দোতারার সুরে সুরে কখনো লালন, কখনো বা শাহ আবদুল করিম। আহা, গান। কী সেই গান—
‘ভবের জনম বিফল গেল
মিটল না প্রেম পিপাসা
ভালো-মন্দের ধার ধারি না
লোকে বলে কুলনাশা।’
এই সাগর। দিগন্ত নীল ওই আকাশ। ঢেউ, প্রেম, প্রকৃতি। আমার বাঙালি মন, সব একাকার হয়ে মিশে গেছে যেন। পড়ন্ত রৌদ্রে প্রেমিকের মুখ। জীবন্ত মায়া ঘর। বাংলার হৃদয়। ফেরার পথে হিমছড়ির ঝরনায় শরীর ধুয়ে জুড়িয়ে গেল পরবাসের ক্লান্তি। এইতো আমাদের বাংলা। আমার মনের মতো করে সর্বত্র তার ছড়ানো শান্তি। আমার হৃদয় হয়তো এই শাস্তিটুকুর খোঁজেই ওই পরবাসে হয় দিশেহারা।

পরদিন আপন ঘ্রাণে ভরপুর ভোরে আসি টেকনাফে। সেখান থেকে নাফ নদ ধরে চলল আমাদের জাহাজ। অদূরে খেয়ালের মতো পাহাড়ের সারি। সবুজ পাহাড়ের গায়ে স্নিগ্ধ কুয়াশার নীরব শয়ন। কাকে যেন মনে পড়ে। কৈশোরের ওই দূরন্ত দিনগুলোর মাঝে লুকানো কোনো স্বপ্নের মতো।
সমুদ্র অলংকারে সজ্জিত এ অস্ট্রেলিয়া, নীল দর্পণের মতো স্বচ্ছ জল তার। তবে সেখানে কি আছে এই বাংলার ঘ্রাণ? এই অকৃত্রিম বন্ধু সব? আমি ভালোবাসি আমার দেশ। জানি, এই অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তুলনা দেওয়ার মতো তেমন বড় কিছু নেই আমার দেশে। আমি ইকোনমিকস কিংবা পলিটিক্যাল সায়েন্সের বড় বড় থিওরির ভেতর নিজেকে খুঁজে পাই না। আমাকে পাই, যেখানে গাথা আছে আমার মমতার শেকড়। আমার ভালোবাসা। হৃদয় দর্পণে শৈশবের ছবি। ওই সব মানুষের মাঝেই আমার শান্ত, যারা বোঝে আমার মন।

ওই দিকে মিয়ানমার সীমান্ত। মনে হয় ‘সবুজ ঘাসের দেশ’। আমাদের জাহাজকে ঘিরে অসংখ্য গাঙচিলের বিহার। বেশ কিছু চিপসের প্যাকেট নিয়ে বসে গাঙচিলদের খেতে দিই। সাদা এই সব পাখিরা আমাদের সাথি। আনন্দ। শান্তি। মায়া মাখা কোনো এক রোমাঞ্চকর স্মৃতির ভেতর মজে গিয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বিরামহীন চলার পর দেখা গেল আমাদের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন সেই সেন্টমার্টিন দ্বীপ। এখানেই প্রথম দেখতে পেলাম অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রের মতো সেই স্বচ্ছ নীল দর্পণ জল। সেই ঢেউ। সুস্থ সুন্দর মনের কিছু মানুষ। শান্ত-নীরব কেয়া গাছের সারি। স্থানীয় লোকজন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঝিনুক কুড়ায়...। ভালোবাসা মাখা ঝিনুকের মালা। ঝিনুকের ফুল। ওই কোমল চুলের, ওই মায়ামুখের কত অলংকার। সব স্মৃতি, হৃদয়, শিল্প, ঝুড়ি ভর্তি করে নিই। কারে যেন দেব আমি। সাগরের ভেতর মিশে আছে আমাদের স্বপ্ন সাধ, না বলা কথা সব। প্রেম। প্রকৃতি। জোছনায় সাজানো ঘর। আমি ভালোবাসি তাই।
জাহাজ ঘাট থেকে বেশ দূরে দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত ছিল আমাদের রিসোর্ট। সেদিন বেলা শেষে ভাটা পড়ে বহুদূরে সরে গেছে জল। কালো, কখনো ধূসর প্রবাল শেওলায় ভেজা। স্নিগ্ধ বাতাসে সজীব নিশ্বাস। মৃদু ঢেউ সরে যাওয়া স্মৃতি রেখা। ভেজা বালুকা বেলায় কিছু নীরব মায়া। মরে যাওয়া কিছু না বলা কথা। একদিন কে যেন এসেছিল এখানে। বালির বুকে ঢেউয়ের সুরে আঁকা যেন তারই পদরেখা।
‘পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো?’

নির্জন জোছনায় যখন পূর্ণিমার চাঁদটা অস্তাচলে হেলে পড়েছে। ওরা সবাই ঘুমিয়ে। চাঁদের প্রেমে অস্থির সাগর আমারে ডাক দেয়। নারকেল বনে জোছনার শয়ন। নীরব বিকাশে প্রকৃতি খুঁজে নেয় আপন শান্তি। আমার এ শূন্য ঘর। তুমি শুধু নাই। সমুদ্রের ঝাপসা বুকের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে শ্রান্ত ঢেউ। আমাদের সেই না মেটা সাধ-অতৃপ্তি। হাল ভাঙা জীবন। আমরা তবু বেঁচে থাকি। আশার মতো একখণ্ড মেঘ তবু জমে থাকে জীবনের আকাশে। হয়তো একদিন আসবে সুখের বৃষ্টি। ছেঁড়াদ্বীপে তখন দেখি—ভোর হয়ে আসে।
পাথর। প্রবাল। ঝিনুক। বালির বুকে এক টুকরো জলাশয়...শ্রান্ত শ্রান্ত জীবনে এক ঝলক শান্তির মতো। ওখানে শামুকের বিচরণ। স্বচ্ছ জলে রুপালি ঝিনুক। মমতাস্নিগ্ধ বিস্মৃত স্মৃতি সব। বুকের ভেতর নিঃশব্দ কিছু কষ্ট। কেয়া বন ছুঁয়ে আসা বাতাস। নির্জন ঝোপ। প্রকৃতির মায়া মাখা ভোরের নরম আলো। মুক্ত জীবনের সুর। আমার দেশ। এই জলে আপন ঘ্রাণ। সমুদ্রের নীল জলের ওপর দিয়ে ওই নীল দিগন্তে ভীরু লজ্জার মতো একখণ্ড মেঘ। আমার মনের মতো।
এদিকে ওই দক্ষিণে অনেক দূরে অস্ট্রেলিয়া। কর্মস্থল। ওখানে অনেক শখের অভিবাসী আমি...। ওখানে আমার শখের ভেতর নেই কোনো ভালোবাসা। মনে হয় মানুষের অস্তিত্বের ভেতরই বিরাজ করে মনের মানুষ। মনের অজান্তেই মন বদলে যায়। একদিন আপন সুর বেজে ওঠে বুকের ভেতর। তাই এই বাংলার ডাক হৃদয়ের গভীরে এক প্রিয়-গান। আমি ভালোবাসি—তাই ওদিক থেকে আসা বাতাসেও আমার ভয়। ওখানে ডলারের মোহ-শৃঙ্খল ধীরে ধীরে শুষে নেয় আমার জীবন। কোনো গণ্ডি আর মানতে চায় না এ মন। আমার এই বাংলার পথ ঘুরে শান্তি কুড়ানো পথভোলা এক পথিক আমি আজ। দীর্ঘ পরবাসের পর আমার দেশ আমাকে উপহার দেয় আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুদের অকৃত্রিম ভালোবাসা। আমার দেশ বুকভরে ধরে রাখে কিছু শান্তি। নীল গিরির মেঘের পরশে মনে আসে-বাড়ির আঙিনায় ওই আমলকী গাছটা। সেবার বাবার সঙ্গে বসে খেয়েছিলাম কাঁচা আমের ভর্তা। আজ বাবা নেই। মহাকাল আমাদের শান্তির ভেতর থেকে ছোবল মেরে নিয়ে গেছে তাঁকে। ওই আমলকী গাছটার ছায়ায় মিশে আছে তাঁর মায়া। আজ ফিরে এসে এ অস্ট্রেলিয়া জুড়ে ওই ঘ্রাণটুকু পাই না আর।

সিডনি শহরের অদূরে মারোবরা বিচের ওই নীরস পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। অনেক ক্ষণ। সাগরের বুক ছোঁয়া ওই অবারিত দিগন্তে অপলক চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করেই হৃদয়-শ্রবণে বেজে ওঠে, দোতারার হৃদয়গ্রাহী সুরে কক্সবাজার সৈকতে বাউল শিল্পীর ওই গানটি—
আমার ঘরের চাবি পরের হাতে।
কেমনে খুলিয়া সে ধন দেখব চোক্ষেতে।
আপন ঘরে বোঝাই সোনা
পরে করে লেনাদেনা
আমি হলাম জনম কানা
না পাই দেখিতে।
একমাত্র বাংলা ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও প্রেম, প্রকৃতি, সুর আর ভাবের এমন অপূর্ব সমন্বয় সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয় না। হলেই বা কী—আমার বাঙালি মনের তাতে কীই বা আসে যায়। আমার বুক জুড়ানো এমন শান্তির সুর কোথায় আছে আর। দেখা যায় সিডনি শহরের ওপর ওই মেঘছোঁয়া টাওয়ার। কী এক খেয়ালের ভেতর শুনতে পাই, জীবনানন্দ এক গম্ভীর কণ্ঠে বলছেন!
‘পৃথিবী রয়েছে ব্যস্ত কোনখানে সফলতা শক্তির ভেতর
কোনখানে আকাশের গায়ে রূঢ় মনুমেন্ট উঠিতেছে জেগে,
কোথায় মাস্তুল তুলে জাহাজের ভিড় সব লেগে আছে মেঘে।
জানি নাকো;--আমি এই বাংলায় পাড়াগাঁয়ে বাঁধিয়াছি ঘর।’
আমার সুন্দরের ভেতর থেকে সাগরের ঢেউয়ের গর্জনের মতো প্রতিধ্বনি ভেসে আসে—বাংলার মায়া বুকে, পৃথিবীর পথে এক পথভোলা পথিক তুমি। বিশ্বময় ছড়ানো তোমার বাঙালি হৃদয়ই তোমার বাংলা-তীর্থভূমি।
লেখকের ইমেইল:
ফেসবুক: