আমলা নির্ভরতা ও মানবিক রাষ্ট্র গড়ার আন্দোলন

দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে এল, তখন সংসদ ও সংসদীয় কার্যক্রম কিছুটা প্রাণ ফিরে পেল। সক্রিয় হয়ে উঠল সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলো। সংসদের ভেতরে কী ঘটছে এ নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে অনেক কৌতূহল লক্ষ্য করা গেল। আমার মনে আছে, মানুষ সংসদ অধিবেশনের নানা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক, আগ্রহ ও গুরুত্বের সঙ্গে উপভোগ করা শুরু করল।

১৯৯৬ সালের সংসদীয় অধিবেশনগুলোর শুরুর দিকের কথা মনে হলে অবাক লাগে। এখন যেমন ক্রিকেট পাগল বাঙালি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা দেখতে পথে ঘাটে, অফিস আদালত, চায়ের দোকান যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের খেলা উপভোগ করে। ঠিক এভাবে ৯৬ সালের সংসদীয় অধিবেশনও মানুষ যেকোনো জায়গায় বসে, দাঁড়িয়ে উপভোগ করার জন্য উদ্‌গ্রীব থাকত। তবে খেলা দেখার মতো শৌখিন মানসিকতা নিয়ে নয়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে অনুধাবন করার জন্য।

৯৬ সালের সংসদের গোড়ার দিকে সংসদীয় কার্যক্রমে সামান্য গতি পাওয়াতে মানুষের ভেতর এক অভাবনীয় সাড়া এবং সীমাহীন আশাও পরিলক্ষিত হলো। রাজনীতি সচেতন মানুষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ভাবলেন, বাংলাদেশ বুঝি বাংলাদেশের পথে হাঁটা শুরু করল। সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি অনুযায়ী সংসদকে সব ধরনের আলোচনা, বিতর্কের মূল কেন্দ্র করে সংসদীয় গণতন্ত্রের শুভ যাত্রা দেখে, আশায় বুক বাধা শুরু করল বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা নাগরিকেরা।

এর দুই বছর পর বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধী দল ভিন্ন মত পোষণ করায় সংসদীয় রীতি অনুযায়ী ওয়াক আউট করা শুরু হলো। প্রথমত কম সময়ের জন্য এরপর দীর্ঘ ওয়াক আউট এবং সর্বশেষে সংসদ বর্জন। সংসদকে কেন্দ্র করে মানুষের মনে যে আশা-আকাঙ্ক্ষার ডালপালা বিস্তৃত হতে শুরু করেছিল, তা ক্রমেই যেন বিবর্ণ হতে শুরু করল। একপর্যায়ে মানুষ কিছুটা আশাহত হতে শুরু করল।

২০০১ থেকে ২০০৬ সালের সংসদ অধিবেশনের কার্যক্রম পূর্বের ধারা অনুসরণ করায়, সংসদীয় গণতন্ত্র কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ল। স্বাভাবিকভাবে সংসদীয় কার্যক্রম চলতে না পারায়, সংসদের ভেতর সুরাহা হওয়ার মতো রাজনৈতিক ইস্যুগুলো ধীরে ধীরে রাজপথে আসা শুরু করল। সংসদীয় রাজনীতির যে নবজন্ম ঘটেছিল ১৯৯৬ সালের সংসদে, ধীরে ধীরে তা রুটিন কার্যক্রমে রূপান্তরিত হতে শুরু করল। সংসদীয় কার্যক্রমের বিষয়ে নাগরিকদের মনে জন্ম নেওয়া কৌতূহলও ধীরে ধীরে উবে যাওয়ার উপক্রম হলো। এরপর ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারিতে শুরু হওয়া নবম জাতীয় সংসদ এবং ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারিতে শুরু হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ একইভাবে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া রুটিন কার্যক্রমেই মনোযোগী হলো; আশা জাগানিয়া সংসদীয় রীতির বিকাশ পরিপূর্ণ মেলতে ব্যর্থ হলো। সংসদীয় রাজনীতি, সংসদীয় গণতন্ত্রের আজকের এই জীর্ণ অবস্থার জন্য কারা দায়ী, বিকশিত না হওয়ার অন্তর্নিহিত কারণগুলো কী ছিল সে বিশ্লেষণ বা বিতর্কে না গিয়ে এর ফলে কী ঘটল, সেই আলোচনার কিছুটা সূত্রপাত করি আজ।

ফলাফল নিয়ে আলোচনা করতে হলে প্রেক্ষাপটের সামান্য বিশ্লেষণ প্রয়োজন। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, বাংলাদেশের রাজনীতি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতির পথ থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি দুর্বৃত্তরা। তাঁরা পরিকল্পিতভাবে কারা-আইন লঙ্ঘন করে কারাগারের সেলে প্রবেশ করে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে। এই চার নেতা হত্যার মাধ্যমে প্রক্রিয়াগত গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে নিষ্ঠুরভাবে আক্রমণ করা হয়। রাজনীতির মাঠ থেকে অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের দূরে সরিয়ে দেওয়া হয় ক্রমান্বয়ে। তাঁদের শূন্যস্থানে রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ কিন্তু বাণিজ্যে অভিজ্ঞ শিল্পপতিদের নিয়ে এসে পূর্ণ করা হয়। রাজনীতিতে আগমন ঘটে স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতাকারী, আত্মগোপনকারী বাংলাদেশ বিরোধীদেরও।

তৃণমূল থেকে রাজনীতির পাঠ নিয়ে ধীরে ধীরে, জনগণের অন্তরের বাণী অনুভব করে, রাজনৈতিক নেতা হওয়ার সর্বজনীনভাবে গৃহীত গণতান্ত্রিক পথকে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। রাজনীতির মাঠ থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের পরিকল্পিত উপায়ে বিযুক্তকরণের প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটে, যে প্রক্রিয়া সময়ের আবর্তে আজ অনেক শক্তিশালী রূপ ধারণ করেছে। যে প্রক্রিয়া এখন অনেকটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। অবসরপ্রাপ্ত আমলারা এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী উপদেষ্টা। রাষ্ট্র পরিচালনায় কর্মরত আমলাদের গুরুত্ব ও প্রভাব দিনে দিনে বেড়ে চলেছে।

সম্প্রতি বাজেট অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বিষয়টিকে আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। তিনি সরকারের আমলা নির্ভরতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। বাজেট অধিবেশন চলাকালে গত ২৮ জুন এ বিষয়টি যখন আলোচনা হয়, তখন সংসদ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও সাংসদ তোফায়েল আহমেদ অনেকের মনে জমে থাকা ক্ষোভের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন।

গণতন্ত্রের মূল বাণী অনুসরণ করে যে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স আছে, সেখানেও জনপ্রতিনিধিদের আমলাদের ওপরে স্থান দেওয়া আছে অর্থাৎ ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা সচিবদের ওপরে স্থান পান। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ এ বিষয়টি আমলাদের মনে রাখতে অনুরোধ করেছেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগেরই উচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্মান, দায়িত্ব বাড়িয়ে তোলার জন্য কাজ করা। দিনের শেষে তাঁদের নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে জবাবদিহি করতে হয়। সরকারের আমলা নির্ভরতা আওয়ামী লীগের ভেতরেই এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের যেসব গণমুখী নেতা এখনে আছেন তাঁদের মূল দুশ্চিন্তা, দলটি কি এই প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো বিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনা শুরু হয়েছে, এটি অত্যন্ত আশার বিষয়। তবে পরিতাপের বিষয়, গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে যতটুকু প্রতিক্রিয়া আশা করা গিয়েছিল, সে রকম প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। গণতন্ত্রের বিকাশ, জবাবদিহির সংস্কৃতি, রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে এ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

আমলা নির্ভরতার উদাহরণ হিসেবে যে বিষয়গুলো সংসদে উঠে এসেছে তাঁর অন্যতম হলো, মুজিব বর্ষের অনুষ্ঠান এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানমালায় আমলাদের প্রাধান্য। বিষয়টি যদি ব্যবস্থাপনার সক্ষমতার জন্য করা হয় তাহলে রাজনীতিকদের প্রাধান্য দিয়ে আমলাদের কি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া যেত না। সরকারি দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা এ বিষয়টি নিয়ে আড়ালে আবডালে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন তা হলো, করোনা সংক্রমণ ও ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ে প্রতিটি জেলায় নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের পাশ কাটিয়ে একজন করে সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া। জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় সংসদ সদস্যদের কিন্তু সংক্রমণ ও ত্রাণ বিতরণের মূল দায়িত্ব সচিবদের। বিষয়টি গণতন্ত্রের মূল বাণীর সঙ্গে এতই সাংঘর্ষিক যে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিবেচনায় এ ধরনের সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতীও বলা যায়।

এ বিষয়ে তোফায়েল আহমেদের ভাষ্য সুস্পষ্ট ধারণা দেবে। তিনি সংসদে তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘...এখন আমাদের জেলায় জেলায় দেওয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মানুষ মনে করে, আমরা যা দিই, এটা প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দেন। অথচ প্রশাসনিক যাঁরা কর্মকর্তা, তাঁরা কিন্তু মাঠে যাননি।...এটা কিন্তু ঠিক নয়। রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিকদের যে কর্তৃত্ব, কাজ, সেটা কিন্তু ম্লান হয়ে যায়।’ আমার মনে হয়, তোফায়েল আহমেদের এ বক্তব্যের বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন নেই। গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে হলে, তাঁর দেওয়া উপদেশ কিংবা পরামর্শ আমাদের মেনে চলা উচিত।

এবার আমাদের ফিরতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতির দিকে তাকাতে হবে। আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দল যার শেকড় জনগণের মনের গহিনে প্রোথিত, তাদের সাময়িক ক্ষমতায় থাকার কথা চিন্তা না করে, দীর্ঘস্থায়ীভাবে জনগণের প্রিয় দল হিসেবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি ভাবতে হবে। ঔপনিবেশিক শাসন আমলের মতো আমলা নির্ভরতা নয়, কারণ আমলা নির্ভরতা জনগণ থেকে রাজনৈতিক দলকে দূরে সরিয়ে দেয়। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে, মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে গণতন্ত্রের সার্বিক বিকাশের কথা ভাবতে হবে। আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা কখনো সুষম ও মানবিক উন্নয়নের পথকে মসৃণ করে না। গণশক্তির ওপর ভিত্তি করে আমরা চাই ন্যায়ভিত্তিক সুষম উন্নয়নমুখী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে।