আবছায়া
সন্ধ্যা মিলিয়ে যাচ্ছে। নামছে অন্ধকার। এ পাখি বাজ নয়, ইগল নয়। আবছা যতটুকু দেখেছি, শালিকের চেয়ে একটু বড় মনে হলো। অচেনা এ পাখির আক্রমণকে তুচ্ছ ভাবতে চেষ্টা করেও হেরে যাচ্ছি। খুব ভয় করছে। কিছুক্ষণ পরপর শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠছে। হঠাৎ করেই মনে হলো, হয়তোবা অন্য রকম এক জগতে ঢুকে পড়েছি।
আমাদের দূরসম্পর্কের এক খালাম্মার বাড়িতে বিয়ের একটি অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পাই। বেশ দুর্গম এলাকা। নিমন্ত্রণ গ্রহণ না করলেও হতো। পারিনি। কারণ, পাড়াগাঁয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান অনেক দিন হয় দেখি না। রাস্তা খুবই খারাপ। আমার সঙ্গে আছে ছোটবেলার বন্ধু অভি। সে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। কোন সাবজেক্টে পড়ে, তা বলতে ইচ্ছে করছে না। কারণ, ওর স্বভাবচরিত্রে ওই সাবজেক্টের আভাসটুকুও নেই। সেই ছোটবেলা থেকেই ওকে ডাকতাম গাধা বলে। কেন ডাকতাম, জানি না। এ পর্যন্ত কোনো কাজে সে গাধার পরিচয় না দিলেও আজ সে সত্যিই একটা গর্দভের কাজ করেছে। কারণ, রাস্তার এই দুর্দশা সে আগে থেকেই জানত। আমাকে নিয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে পারছে, এটাই যেন তার কাছে অনেক বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
ওই খালাম্মা ইহধাম ছেড়েছেন প্রায় আট বছর আগে। বীরগাঁও জমিদারবাড়ির জীর্ণ দালানকোঠা। পাশেই ছোট্ট একটি বাড়ি। ওই বাড়িতে বর্তমানে খালাম্মার বড় ছেলে নসু থাকেন। তার সংসারটা আমাদের চিরায়ত সংসার থেকে একটু ভিন্ন। নসুর বিয়ে হয়েছিল একটা নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে। শ্বশুরের মৃত্যুর পর তার একমাত্র শ্যালক নবু এক লাফে আকাশ ধরতে গিয়ে গোপনে বাড়িঘর, জমিজমা সব বিক্রি করে দেন। ইতালি যাওয়ার পথে আজ তিন বছর কোনো খোঁজ নেই।
নসুর শাশুড়ি ছোট মেয়ে জোবেদাকে নিয়ে উপায়ান্ত না দেখে বড় মেয়ের কাছেই আশ্রয় নেন।
নসুর স্ত্রী রেনু মা ও বোনের সুবন্দোবস্ত করতে গিয়ে খুব সহজেই স্বামীকে হাত করে ফেলেন। উন্নত মানের এক আইসক্রিম কোম্পানিতে নসু চাকরি করেন। প্রতি মাসের প্রথমে একবার বাড়িতে আসেন।
আজ নসুর শ্যালিকা জোবেদার বিয়ে।
আন্তজেলা মহাসড়কের পাশে বটতলা মোড়ে বাস থেকে নেমে জানতে পারি, বীরগাঁও যাওয়ার সরু মেঠো পথটি পাকা করে প্রশস্ত রাস্তা করা হচ্ছে। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হবে অনিশ্চিত পথে। আমাদের ইতস্তত করতে দেখে মোড়ের চায়ের দোকানদার ডেকে বললেন:
ভাই, আপনারা এই ধানখেতের আইল ধরে আস্তে আস্তে চলে যান। আশা করি সইন্দ্যার পরপরই পৌঁছানো যাবে। একটু জোর কদমে হাঁটলে অন্ধকার নামার আগেই পারবেন।
কী আর করা। এ ছাড়া আর গতি নেই। হাঁটতে শুরু করি।
কার্তিক মাস। কচি ধানখেত। সবুজ মাঠ। মাঝেমধ্যে নতুন পাতায় ছাওয়া হিজলগাছ। কখনো হিজলকে ঘিরে এক-আধটু ঝোপ। যদিও দুর্গম পথ, হাঁটতে ভালোই লাগছে। নদী নয় খাল, স্রোতহীন হাঁটুজল। কচুরি ফুল। শৈশবের খেলাঘরে বিস্মৃত কিছু স্মৃতির মতো। ঘাসছাওয়া পথে জীবনের বিস্তার। নিঃশব্দের ভেতর ঘুমিয়ে আছে শীত। দু-একটি ডাহুকের ডাক সন্ধ্যার বাতাসে ভেসে এসে ঝাপসা অদৃশ্যে মিশে যায়। ক্রমে অন্ধকার নেমে আসে। তখনো বেশ দূরে ক্রমে মিলিয়ে যাওয়া গোধূলি লালিমার প্রান্ত ছোঁয়া ওই কালো গ্রামটিই বীরগাঁও।
ঘন কালো এক হিজল ঝোপের কাছাকাছি আসতেই আমার কেমন যেন ভয় করতে লাগল। হিজলের হিম বুক থেকে ধড়মড় শব্দে বের হয়ে কী এক নিশাচর আমার মাথার পেছন দিকে আচমকা এক আঁচড় কেটে সাঁই করে অন্ধকারে মিশে গেল। এবার ভয়ে আমার শরীরটা কাঁটা দিয়ে ওঠে। এতক্ষণ দুজনে নানান গল্পে প্রাণবন্ত সময়টা বেশ উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ দুচোখে কিসের যেন আতঙ্ক। গাধাটাকে মনে হচ্ছে অচেনা কেউ। কে জানে, হয়তো এ তার অভিনয়। অভির ছায়ারূপে অন্য কেউ। হয়তো এখন এমন কিছু ঘটতে পারে, যা কল্পনাও করিনি।
এটা কী পাখি রে অভি? আমার মাথার পেছনে খামচি দিছে।
অভি কাঁপা গলায় বলল:
হ দোস্ত, আমিও ভয় পাচ্ছি। রাতের বেলায় মানুষ শিয়াল, বাঘডাশ, খাটাশ, জংলি কুকুর এসবের আক্রমণের শিকার হয়। তবে কোনো পাখি আক্রমণ করে শুনিনি কখনো। আচ্ছা দোস্ত, চল দ্রুত হেঁটে যাই।
অবশেষে আমরা বীরগাঁও পৌঁছে গেলাম।
বর পাশের আমতলী গ্রামের। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাতেই দেখি, অন্ধকারের নীরবতা ভেঙে ছোট ছোট আতশবাজির আওয়াজে এগিয়ে আসছে বর।
বাড়িতে এসে দেখি, বাড়ির মেয়েরা বরকে গেটে আটকে রেখেছে। চলছে দর-কষাকষি। আমাদের দেখে পুরো পরিবেশটাই শান্ত হয়ে আসে। উপযুক্ত নজরানা ছাড়াই মেয়েরা বরকে ছেড়ে দেয়। অনেকেই আমার কাছে এসে নিজের পরিচয় দিচ্ছে। আমিও চেষ্টা করছি সবার সঙ্গে মিশে যেতে। দেখলাম, বেচারা নসুকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। একসময় মনে হলো, এই নসু হয়তো নিজেই নিজেকে পাত্তা দেয় না। এ কারণেই কারও হিসাবের খাতায় তার নাম নেই।
আমাদের দুজনের প্রতি তাদের আদর-আপ্যায়নের শেষ নেই। এরই মধ্যে মাথার পেছনে ঘাড়ের ওপর হাত দিতেই দেখি রক্তে ভিজে আছে।
ওই বাড়ির চারটি ছেলেকে নিয়োগ করা হলো সার্বক্ষণিক আমাদের দেখভাল করার জন্য। শাওয়ার শেষে নতুন জামাকাপড় পরে নতুন রূপে অনুষ্ঠানে এসে যোগ দিই। ততক্ষণে বিয়ের কাজ শেষ। আপ্যায়নপর্ব শুরু হয়েছে। তবে ক্লান্তিতে একটু পর আমার দুচোখ বন্ধ হয়ে আসছে। বাড়ির পাশেই পানা আর কলমিতে ঠাসা এক মরা খাল। কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের জোছনা। অনুষ্ঠানের ভেতর থেকেই ঘন কালো খালটির দিকে চেয়ে হঠাৎ করে মনে হলো, এ যেন আমাদের চিরচেনা জগৎ নয়। সুরের মধ্যেই আন্তপ্রবাহে এক অচেনা সুর।
না, আর পারছি না। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। অভিকে আস্তে করে বলতেই পাশের বাড়িতে পরিত্যক্ত একটা ঘর পরিচ্ছন্নতার কাজে লেগে যায় কয়েকজন। প্রায় আধা ঘণ্টা পর একজন এসে বলে:
স্যার, সব রেডি। ঘুমায়ে পড়েন। এদিকে আমরা আছি। নিশ্চিন্তমনে ঘুমান।
ঘরে ঢুকতেই কেমন একটা পুরোনো জীর্ণ গন্ধ পেলাম। ভালো লাগছে না খারাপ লাগছে, বলতে পারছি না। কারণ, এটা ভালো-মন্দের সময় নয়। সময়টা ঘুমের। পুবের জানালাটা খুলে দিলাম। দেখি, কয়েক গজের দূরত্বে একটা প্রাচীন বাড়ি। জীর্ণ দালানকোঠা, আস্তরণ খসে পড়া দেয়াল। ভেতরে-বাইরে স্যাঁতসেঁতে দেয়ালের গায়ে নিশ্চিন্তে রাজত্ব করে চলেছে ভাট, শ্যাওড়া আর অশ্বত্থ সব।
ঘুমাতে যাব, ঠিক তখনই রেনু ভাবি কতগুলো ফুল, পিঠা, পাকা কলা আর এক জগ পানি এনে নড়বড়ে টুলটার ওপর রাখেন। মৃদু হাসিতে কী যেন বলতে যাবেন, ঠিক তখনই তার দৃষ্টি পড়ে খোলা জানালার দিকে। তিনি বলেন:
ভাই, জানালাটা বন্ধ করে দেন। কেন খুলেছেন এটি?
এ আবার কোন যন্ত্রণা! এই জানালা বন্ধ আর খোলার মধ্যে রহস্য কী? রেনু ভাবির এ আচরণ আমার মোটেও ভালো লাগছে না। এ প্রসঙ্গ আড়াল করে বললাম:
ভাবি, পাশের এই পরিত্যক্ত বাড়িটা কি রাজবাড়ী?
না, এটা জমিদারবাড়ি। তবে জানালাটা বন্ধ রাখবেন।
কেন, আমার তো ভালো লাগছে।
রেনু ভাবি একঝলক আমার দিকে দৃষ্টি দিয়েই চোখ ফিরিয়ে নেন। ঘর থেকে এক পা বাইরে দিয়ে বলেন:
ঠিক আছে। ভালো লাগলে তো আর কিছু বলার নেই। জানালা-দরজা সব খুলেই ঘুমান।
আরে ঘটনা কী! আপন ছোট বোনের বিয়ে। বাড়িময় আনন্দ। আমাদের দুজনকে দেখে রেনু ভাবির মুখ থেকে যেন হাসি সরছেই না। এই একটু জানালা খোলা আর বন্ধ নিয়ে তিনি এমন করলেন কেন?
যাক, কার মনে কী আছে, কে জানে? ওসব ভেবে কাজ নেই। বেশ বড় একটা খাটে আমরা শুয়ে পড়লাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, খেয়াল নেই। তখন খুব সম্ভব রাত সাড়ে তিনটা বাজে। হঠাৎ উত্তর দিক থেকে ছেলেকণ্ঠের কেমন এক করুণ কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। কান্নার আওয়াজটা যতই শুনছি, আমার শরীরটা কেবলই হিম হয়ে আসছে। এ হিমের ভেতর প্রচণ্ড ঘামে শরীরটা ভিজে যাচ্ছে। কী এক অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ টের পাচ্ছি। ক্রমেই কাতর হয়ে যাচ্ছি। নড়তে পারছি না। ধড়ফড় করে উঠে বসি। উত্তরের জানালাটা খুলে গ্রিল ধরে খাটের কার্নিশে মুখে চেপে বসে আছি যেন। না, আমি পর্বতের চূড়া থেকে খসে পড়া বরফখণ্ডের মতো শুয়েই আছি হয়তো।
১০-১১ বছরের একটি ছেলে। একটা অচেনা কালো পাখি কিছুক্ষণ পরপর ছেলেটার মাথার পেছনে ঠোকর দেয়, কখনো ঘাড়ের ওপর ধারালো নখে আঁচড় কাটে। জোছনায় ছেলেটা একবার এদিকে, আরেকবার ওদিকে দৌড়ায় কেবল। বেশ কিছুক্ষণ আত্মরক্ষার এই প্রাণান্ত চেষ্টা শেষে ছেলেটি ছায়ার রূপ ধরে এক দৌড়ে ওই পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে। বাড়িটির উত্তর প্রান্তে খালের পাড় ঘেঁষে একটি অশ্বত্থ ঝোপের ভেতর ঢুকে পড়লে আর কিছু দেখা যায় না।
শরীরটা কাঁপতে কাঁপতে ঘুম ভেঙে যায়। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও কোনো কথা বলতে পারছি না। জিবটা কাঠ হয়ে গেছে। অভিকে ধাক্কা দেব, হাত সরছে না। কতক্ষণ পর জানি না, হঠাৎ শুনি দূরে কোনো মসজিদ থেকে ভেসে আসছে ফজরের আজান।
মনে সাহস এল। অভিকে ধাক্কা দিয়ে জাগাতেই সে কেমন অদ্ভুত শব্দ করে ওঠে। একসময় সব স্বাভাবিক হয়ে আসে। ভোরের আলো দেখা গেলে অভিকে বললাম:
দোস্ত, এ বাড়িতে কি ১০-১১ বছরের কোনো ছেলে আছে?
ছিল একটা। প্রায় সাত বছর আগের কথা। বাবা তো অনেক আগেই মারা গেছে। এদিকে নসু ভাই চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। তখন পাঁচ ছয়-মাস পরপর বাড়ি আসত। খালাম্মা মারা যাওয়ার পর রেনু ভাবিই করত ওর দেখাশোনা।
ও আচ্ছা। ওর নাম কী ছিল?
মোজাম্মেল হক। ডাকনাম অপু।
হঠাৎ নিরুদ্দেশ? মানে বুঝলাম না।
এই যা হয় আরকি। মা মারা গেলে ওই জমিদারবাড়ির ঝোপের ভেতর বসে থাকত। নাওয়া-খাওয়ার খবর থাকত না। তখনই দূরে কোথায় যেন পড়াশোনা করতে পাঠায়। নসু ভাই অবশ্য গ্রামের স্কুলে পড়ানোর পক্ষেই ছিলেন। শেষে ভাবির ইচ্ছাটাই থেকে গেল।
কেউ কোনো নির্যাতন করত অপুকে?
তা জানি না। তবে শুনেছি ওখানে শিকল দিয়ে ওকে বেঁধে রাখত। কারণ, রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে আস্তে করে বের হয়ে গোরস্তানে চলে যেত। একবার সন্ধ্যার সময় কী করে যেন শিকল খুলে বাড়িতে চলে আসে। তারপর আর দেখা যায়নি।
ও আচ্ছা।
গতকালের পাখির আঁচড় আর মানসিক বিধ্বস্ততা সব মিলিয়ে আমার ভালো লাগছিল না। ইচ্ছা করছে যে করেই হোক এখান থেকে বের হই। কী এক অশান্তিতে আমার শরীরটা যেন পুড়ে যাচ্ছে।
অভি বাড়ির ভেতর যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই রেনু ভাবি ঘরে এসে বলেন:
কী বিদেশি ভাই, শরীরটা ভালো না বুঝি? এ দেশের নোংরা আবহাওয়া, আবার বিয়েবাড়ির হইচই। যত্নআত্তি কিছুই তো করতে পারলাম না। চলুন, নাশতা করতে চলুন।
রেনু ভাবির দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন:
ভাই, আমি কি কোনো অন্যায় করেছি? এভাবে চেয়ে আছেন কেন? কিছু বলবেন?
একটা বিষয় জানতে চাই। সত্য কথাটা আমাকে বলবেন কি?
অবশ্যই বলব। ভাই বলেন।
জানেন তো আমরা যা কিছুই করি, প্রকৃতিতে তার একটা প্রভাব থেকেই যায়।
রেনু ভাবি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলেন:
আমার লেখাপড়া কম। অত কঠিন কথা বুঝি না। সহজ করে বলেন।
হাত উঁচিয়ে অশ্বত্থ ঝোপটা দেখিয়ে বললাম:
ওই ঝোপের ভেতর মাটির নিচে কী আছে?
মুহূর্তের মধ্যেই অস্থির রেনু ভাবির চোখ দুটো আরও অস্থির হয়ে ওঠে। তার ঠোঁট দুটো কেঁপে কেঁপে চেহারায় দেখা দেয় রক্তিমতা।