আগে দর্শনদারি পরে গুণবিচারি

প্রতীকী ছবি
মডেল: মারিয়া নূর। ছবি: সংগৃহীত

এ উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে আকার ও বর্ণের এত বৈচিত্র্য, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও মনে হয় দেখা যায় না। এর জন্য অবশ্য এর উর্বর মাটিই দায়ী। সময়ের স্রোতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে তার টানে টেনে এনেছে। যে কারণে মানুষে মানুষে এত বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে, সেই সঙ্গে ভেদাভেদও দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করেছে। যেহেতু ইউরোপিয়ানরা প্রভুর জাত ছিল এবং তাদের ছিল সাদা চামড়া। তাই যাদের সাদা চামড়া, তাদের কদর অবধারিতভাবেই বেড়ে গেল। আর অন্য রঙের মানুষ তখন অবজ্ঞার পাত্র হতে শুরু করল। কাজেই মানুষের মধ্যে প্রভুর জাতে ওঠার একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা তৈরি হলো এবং বিভিন্ন উপায়ও তৈরি হলো। যার সর্বশেষ সংস্করণ বিভিন্ন ফেয়ারনেস ক্রিমের রমরমা ব্যবসা। ইউনিলিভার শুধু ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী’ বেচে যে পরিমাণ লাভ করে, অন্য সব প্রোডাক্ট বেচেও তত লাভ হয় কি না সন্দেহ। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ? সে যা-ই হোক, আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু মোটেও কিন্তু মানুষের গায়ের রং নয়। রং বিচারের এই অদ্ভুত অস্বাভাবিক মানসিক বিকার নিয়ে আজকের এই লেখা।

ঢাকা শহরের প্রায় সব লোকই মফস্বলের বিভিন্ন জেলা থেকে এসে এখানে খুঁটি গেড়ে বসবাস শুরু করেছে। কারণ, এখানে পেটের পুঁজি সহজে জোটানো যায় এবং প্রত্যেকেরই পূর্বপুরুষ অবশ্যই কোনো না কোনো জন্মে কৃষক ছিল। তাই ধান-চাল, গম-আটা, শাক-সবজি, ফলমূল নিয়ে প্রত্যেকেরই বেসিক ধারণা আছে অবশ্যই।

কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, তারা যখনই বাজারে কোনো কিছু কিনতে যায়, তখনই তারা বইয়ে দেখা রঙের জিনিস খোঁজা শুরু করে। যদিও বইয়ের লেখাটা পড়ার ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। সে যা-ই হোক, প্রাকৃতিক রং আর বইয়ের কৃত্রিম রং তো কখনোই এক হবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষ যেহেতু বেশি টাকা খরচ করে কৃত্রিম রঙের জিনিসই কিনছে, তাই শুরু হয়ে গেল সেগুলোতে কৃত্রিম রং আর তরতাজা রাখার জন্য বিভিন্ন কেমিক্যালের ব্যবহার। বিশেষ করে আম-কলা-লিচু-তরমুজের ক্ষেত্রে রঙের ব্যবহার এমন এক শৈল্পিক মাত্রা পেয়েছে যে তাদের প্রকৃত রঙের কথা মানুষ বেমালুম ভুলে বসে আছে। প্রথমে আসি আমের কথায়। আম পাকলে কখনোই সোনালি আকার ধারণ করে না। আমের রং সবুজই থেকে যায় তাতে লাগে একটু সোনালি আভা। পুরো আমের গায়ের রং কখনোই হলুদ হয় না; কিন্তু যেহেতু মানুষ বেশি টাকা খরচ করে ওই কার্বাইড দেওয়া ক্ষতিকর সোনালি, হলুদ আমটাই কিনছে, তাই রং মেশালে বরং বেশি লাভ। টিভিতে একটি অনুষ্ঠানে এক ফল ব্যবসায়ীকে আনা হয়েছিল। ভদ্রলোক পর্দার আড়াল থেকে যে কথাগুলো বলেছিলেন সেগুলো আজও আমার মনে বাজে, ‘ছেলের বিয়ে দিতে গেলে আপনারা যেমন উজ্জ্বল বর্ণের মেয়ে খোঁজেন, তেমনি দোকানে এসে মানুষ ওই হলুদ আমটাই বেশি টাকা দিয়ে কেনে, তাহলে কেন আমি আমে রং মেশাব না?’

কলার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কলা অবশ্য পাকলে বেশির ভাগ সময়ই সোনালি রং ধারণ করে, কিন্তু সেই রংটা অতটা ইউনিফরম না, যেটা আমরা বাজার থেকে কিনি। কিছুদিন আগে আমি এক ছড়ি কলা কিনলাম পাকা রং দেখে। বাসায় এসে দেখি একটাও পাকা না; বরং সবই কাঁচা। রং কলার বাইরেটা পাকাতে পেরেছে; কিন্তু ভেতরটা পাকাবে কে? লিচুর ক্ষেত্রেও রঙের ব্যবহার প্রকট আকার ধারণ করেছে। লিচু পাকলে কিছুটা লালচে রং ধারণ করে; কিন্তু কখনোই ওই রকম লাল হয় না, যে রকমটা আমরা বাজার থেকে কিনি। চাকরির সুবাদে উত্তরবঙ্গে যাতায়াত ছিল, তাই আমি এই ব্যাপারে জানি। মিরপুর-১০-এ লিচু কিনতে গিয়ে দেখি সবাই লাল লিচু খুঁজছে এবং বেশি দাম দিয়ে কিনছে। কিন্তু লিচুগুলোর গায়ের কাঁটা বলে দিচ্ছে সেগুলো পরিপক্ব হয়নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দেখি দুই তরুণ ও নবীন বিক্রেতা বিমর্ষ মুখে এক ঝুড়ি লিচু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যাওয়ামাত্র বলল, নেন স্যার নেন, এক দাম ৩৫০ (কিন্তু অন্য সবাই বেচছে ৪০০ করে)। ওদের লিচুগুলো সাইজেও বড়। আরও একটু কমাতে চাইলে ওরা বলল, স্যার যদি শুধু একটু রং কইরা আনতাম, তাইলে আপনি এই লিচুই ৪০০ টাকা দিয়া নিতেন? বাসার সবাই লিচুগুলো খেয়ে বলল, গায়ের রং সবুজ হলে কী হবে, মিষ্টি!

তরমুজের ব্যাপারটা এবারই প্রথম ভালোভাবে বুঝলাম। মানুষ দোকানে গিয়ে মিষ্টি তরমুজ খোঁজার চেয়ে লাল তরমুজ খোঁজে, গাঢ় লাল সেটা আবার কেটে দেখাতে হবে। তো বেশ কয়েকবার দোকানে যাওয়ার পর দেখি সব তরমুজই টকটকে লাল? কাহিনিটা পরে পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলাম এবং এরপর আর তরমুজ কিনিনি। একবার মেঘনা সেতুর সিগন্যাল থেকে শসা কিনলাম। খেতে গিয়ে দেখি তিতা। তো শসা ভালোমতো না কাটলে এবং কিছু টেকনিক অবলম্বন না করলে শসা কাটার পরও তিতাই থেকে যায়, তাই খেয়ে ফেললাম। খাওয়া শেষ হওয়ার পর খেয়াল করলাম, যে পলিথিনে শসা ছিল, সেটা পুরোপুরি সবুজ হয়ে আছে। তখন বুঝলাম আসল ঘটনা। পুরোপুরি সবুজ না হলে শসা বিক্রি হয় না, তাই এই ব্যবস্থা।

আরও কিছু প্রশ্ন আমাকে খুবই আনন্দ দেয়—আঙুর, মাল্টা, কমলালেবু মিষ্টি হবে তো? আহারে যেন এ ফলগুলো পাকলেই মধুর মতো মিষ্টি হয়। কিন্তু আসলেই কি তাই? এসব ফলের বেশির ভাগই বিদেশি ফল এবং যখন এগুলো আমাদের মাটিতে জন্মায় তখন আর তার সেদেশীয় বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে না। একবার আমার সঙ্গে কাজ করা এক ড্রাইভার সিলেটে এক হালি কমলা কিনে খেয়ে দেখে টক। ব্যাটা তখনই বিক্রেতাকে গেল মারতে। আমি পরিস্থিতি দেখে নিজেই গেলাম থামাতে। বিক্রেতা বলল, ‘বলেন স্যার, আমি কি কমলার ভেতরে গিয়ে দেখছি নাকি যে এইডা মিষ্টি না টক?’ এই প্রশ্নের আমি কি উত্তর দেব। ওটা ছিল অরিজিনালি আমাদের দেশি সিলেটি কমলা। এমনকি মিষ্টিকুমড়া পর্যন্ত মানুষ জিজ্ঞাসা করে, মিষ্টি হবে তো? আরে ভাই, এটা তো সবজি, ফল না?

শহরের সবকিছুই কেন জানি বড্ড মেকি, বড্ড লোকদেখানো। শহরের কাজকর্মের বেশির ভাগই করা হয় স্ট্যাটাস রক্ষা করতে বা ‘পাছে লোকে কিছু বলবে’র ভয়ে। এ ছাড়া তৈরি হয়েছে একটা মেকি সভ্যতার। শহুরে মানুষের ধারণা এই ধরাধামে শুধুই তাদের রাজত্ব আছে, অন্যদের কোনো অস্তিত্বই নেই। শহরের মানুষ বাজারে গিয়ে বইয়ের পাতার রঙের ফল খোঁজে। তাই আম, লিচু, কলা বিক্রেতা তার ফলে কার্বাইড মেশায়; যদিও প্রকৃতিগতভাবে তখনো সেই আম বা কলার পাকার বয়স হয়নি। তরমুজ বিক্রেতা সিরিঞ্জের মাধ্যমে লাল রং পুশ করে, যাতে তরমুজ হয় টকটকে লাল আর খুচরা শসা বিক্রেতা শসাটা কেটে সবুজ রঙের মধ্যে ডুবিয়ে নেয়। এ ছাড়া মাছ বিক্রেতা মাছের কানকো লাল করেন রং দিয়ে আর পশু বিক্রেতা পশু মোটাতাজা করে ক্ষতিকর ইনজেকশন দিয়ে। এই অভ্যাস এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে এখন আর এর থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। এসবের জন্য আবার দোষ দেওয়া হচ্ছে বিক্রেতা বা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কৃষকদের। আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, একজন কৃষক তার খেতের সবচেয়ে ভালো সবজি বা ফলটাই বাজারে পাঠায় বিক্রি করতে আর খারাপগুলো রেখে দেয় নিজের সংসারে খাওয়ার জন্য। যা হোক, এখন মানুষ কিছুটা হলেও সচেতন হচ্ছে, এইটাই আশার কথা। এসব কৃত্রিম রং মেশানো জিনিসের বাজার চাহিদা না থাকলে সেগুলো এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।

  • লেখক: মো. ইয়াকুব আলী, মিন্টো, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

  • দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন [email protected]-এ