
পেছন থেকে কে যেন আমাকে ঠেলে দিল। সবল ধাক্কায় আমি সামনে ঝুঁকে গেলাম। যে ধাক্কা দিয়েছে সে কিন্তু মানুষ নয়। ধাতব বেল্ট। ঝুঁকতেই দেখি কাচের ভেতর ফুটে আছে আজব এক চেহারা। এটাই কি আমি? ওরাতো তাই বলছে! আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করলাম।
এই রুমটা বেশ ছোট। চারদিকে ধাতব দেয়াল। মাঝখানে বসে আছি আমরা আটজন মানুষ। মানুষ বলাটা আসলে ঠিক হবে না। কারণ, আটটি প্রাণীর কেউই এখন আর পুরোপুরি মানুষ নেই। যদিও মানসিকভাবে ঠিক আগের মতোই আছি আমরা। কিন্তু বদলে গেছে শরীর। সামনের এই ছবিটি তারই প্রমাণ। একটু আগেই অন্য একটি কক্ষে ঢুকিয়ে আমাদের স্ক্যানিং, ম্যাচিং ইত্যাদির পর সবাইকে যার যার ম্যাচিং ‘অ্যাভাটার’-এর সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এরপর পাশের রুমে এসে আটটি যন্ত্রযানে বসতে বলা হয়েছে।
তা শিরোধার্য করে আমরা বসে আছি। এই এলাকাটা সংরক্ষিত।
এখান পর্যন্ত এসে পৌঁছাতে সময় লেগেছে দীর্ঘ। অনেক দূর হেঁটে এদের সীমানায় ঢুকতে হয়। তবে হাঁটা পর্ব এত সহজে শেষ হওয়ার নয়। সীমানায় ঢোকার পরেও আরও দুই ঘণ্টা উঁচু-নিচু পথে হাঁটতে হয়েছে। পাহাড়, জঙ্গল, পেরিয়ে আঁকাবাঁকা গুহার ভেতর দিয়ে, নাভি এলিয়েনদের ব্যবহারের জিনিসপত্র পেছনে ফেলে, অ্যাভাটার ল্যাব ঘুরে, বিশাল কাচের ট্যাংকের তরল পদার্থে ভাসমান এভাটারের দোলায়িত শরীর দেখতে দেখতে তবে আসা।
আর আসা মাত্রই বুঝে গেছি, এসেছিলাম যদিও নিজের ইচ্ছেয় কিন্তু এবার থেকে চলতে হবে ওদের ইচ্ছেয়। নইলে ফল হবে ভয়ানক!
কে চায় জীবনের ওপর ঝুঁকি নিতে! অতএব সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে যার যার যন্ত্রযানে এসে বসেছি। জিনিসটা দেখতে অনেকটা মোটরসাইকেলের মতো। এই জিনিস কি করে আমাদের এত দূর নিয়ে যাবে বুঝতে পারছি না।
এতক্ষণ দেয়ালের বড় স্ক্রিনে কালো কোট পরা এক ভদ্রলোক আমাদের উদ্দেশে কিছু কথা বলেছেন।
কথা বলার সময় তার মুখটা হাসি হাসিই ছিল। কিন্তু শোনামাত্র আমাদের মুখের হাসি দপ করে নিভে গেছে। নিজের নাম ও পরিচয়ও তিনি শুরুতেই দিয়েছেন। তবে এতসব মনে রাখার মতো মনের অবস্থা কারও নেই। তাঁর বক্তব্য শোনার পর থেকেই আত্মারাম খাঁচা ছাড়া।
কিন্তু কী আশ্চর্য! আমার অবস্থার দিকে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। যন্ত্রযান তার কাজ করে যাচ্ছে। বসা মাত্রই সে খপ করে পেছন থেকে ঠেলে আমাকে একটু ঝুঁকিয়ে দিল সামনে। আঁটসাঁট করে পরিয়ে দিল পাকাপোক্ত বেড়ি। বেড়ি খুলে বেরিয়ে যাওয়ার সাধ্য কারও নেই।
এই রুমে আঁটটি যন্ত্রযানে বসে আছি আমরা আটজন যাত্রী। সামনের পথ গেছে অজানার দিকে বেঁকে। সেই পথটুকু পাড়ি দিতে হবে একা একা। যে যার মতো করে। আমার সাহস খুব কম। কিন্তু কৌতূহল অপার। সেই কৌতূহলেই এত দূর আসা। একটা কথা আড়ালে বলে রাখি, বেড়ি যে শুধু আমাকে পরানো হয়েছে তা কিন্তু নয়। এখানে আমার পরিবারের সদস্যরাও আছে। তারাও পরেছে বেড়ি। রুমটা অন্ধকার। তাদের কাউকেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।। আশপাশে আরও রুম আছে। সেখানে বসে আছে অসংখ্য অচেনাজন। এই মুহূর্তে বিশাল এই বিল্ডিঙের চারদিকে অজস্র খোপে খোপে এইভাবে কত মানুষকে যে আটকে ফেলা হয়েছে কে জানে! ওদের অবস্থাও কি আমারই মতো!
দুরু দুরু হাতে আমি ফ্লাইট গগলসটা চোখে পরে নিলাম। পরতে না পরতেই প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল ধরণি। চোখের পলকে বদলে গেছে দৃশ্যপট! কী ভয়ংকর! কী ভয়ংকর! কী ভয়ংকর!
সামনের দেয়ালটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
খোলা আসমানে ছিটকে বেরিয়ে গেছি আমি।
বদলে গেছে আমার বাহন। আমি এখন বসে আছি অতিকায় এক পাখি অর্থাৎ মাউন্টেন ব্যানশির পীঠে। নাভি এলিয়েনদের ভাষায় এর নাম ইকরা।
ইকরা নামের পাখিটা আমাকে নিয়ে উড়াল দিয়েছে আকাশে। এ এক ভয় ধরানো অচেনা আকাশ। উঁচু পর্বতের চূড়া থেকে উড়তে উড়তে সোজা নিম্নমুখী হয়ে নামছে ইকরা। অকল্পনীয় দ্রুত তার গতি। কী ভয়ংকর অবিশ্বাস্য পাতাল যাত্রা! চারদিকে আকাশ ফাটানো শব্দ, ঝড় ঝঞ্ঝা ও পাগল বাতাস।
আমি ভয়ে নিথর! গলা শুকিয়ে কাঠ।
ব্যানশির পিঠে বসে টালমাটাল দুলছি। কাঁপছি। পড়ি-পড়ি করেও কোনোমতে সামলে নিচ্ছি। অথবা ব্যানশিই আমাকে সামলে রাখছে। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই বুঝি পাতালপুরীতে ঢুকে গেলাম। এই বুঝি মরে গেলাম। একি ভয়ানক বিপদ। আমি প্রাণপণে চেপে ধরে রাখি ব্যানশির পালক। ব্যানশি কী তাতে আরও ক্ষেপে গেল। তীব্র থেকে তীব্রতর হলো তার গতি।
আমি আর পারছি না। হৃৎপিণ্ডটা বুঝি ঠিকরে বেরিয়ে যাবে বাইরে।
চলতে চলতে চকিতে কখনো আমার সহযাত্রীদের দু-একজনকে এক পলকের জন্য দেখেছি। বাকিরা কোথায় কে জানে। কিন্তু চারদিকে শোনা যাচ্ছে তাদের গগনভেদী চিৎকার। ভয়ংকর এই যাত্রার সমস্ত যাত্রীরা ভয়ে আর বিস্ময়ে আর্তনাদ করছে। আমিতো শুধু মূর্ছা যাওয়ার অপেক্ষায়।
ব্যানশি ছুটছে বহু নিচের এক উপত্যকা লক্ষ্য করে। পাড়ি দিচ্ছে অবিশ্বাস্য বিপৎসংকুল পথ। চারদিকে ভয়াল অরণ্য। প্রকাণ্ড সব দানবাকৃতি গাছপালা। পর্বতের ভয়ংকর বিপজ্জনক খাদ।
এরই মাঝ দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে মোড় নিচ্ছে ব্যানশি। এক বিপদ না পেরোতেই ঝাঁপ দিচ্ছে আরেক মহাবিপদে। আমার মতো ভিতুকে নিয়ে একি মরণ খেলা খেলছে সে।
আগে জানলে কী আর আসতাম!
হঠাৎ অরণ্য পেরিয়ে ঢুকে গেল সে পঙ্গপালের মতো তেড়েফুঁড়ে ছুটন্ত একদল অতিকায় বন্য পশুর মাঝখানে।

আমি ভয়ে বিস্ফোরিত চোখ মেলে দেখছি আমাদের মাত্র এক ইঞ্চি নিচ দিয়ে ক্ষিপ্র বেগে ধাবমান বিদঘুটে ভয়ানক বন্য পশুর দল। একবার আমাদের ধরে ফেললে মুহূর্তে ছিন্নভিন্ন করে দেবে।
আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করলাম।
পর মুহূর্তে চোখ খুলেই অবাক!
সামনে দিগন্ত জোড়া রহস্যময় এক নিশিকালীন জগৎ! যেন পটে আঁকা ছবি। শান্ত সুন্দর! এত শান্ত যে আমার বাহন পাখিটির নিশ্বাসের শব্দটুকুও শুনতে পাচ্ছি। মাঝ আকাশে থমকে থেমে আছে মাউন্টেন ব্যানশি। পায়ের নিচে, কোমল মসৃণ তৃণলতা! ঠিকরে আলো বেরোচ্ছে তাদের গা থেকে। বায়োলুমিনিসেন্ট এলিয়েন ওয়ার্ল্ড! লাস্যময় ফুল আর ফল! বাতাসে ভেসে আসা পুষ্প সৌরভ। এদিকে-ওদিকে উড়ন্ত পর্বতমালা। ভাসমান নদী। নয়নাভিরাম জলপ্রপাত। সারি সারি বৃক্ষমালা। একেবারেই অন্যরকম এবং ভয়ংকর সুন্দর! ভয়ংকর এবং সুন্দর!
এ রকমই হওয়ার কথা।
আমরাতো এখন আর পৃথিবীতে নেই। সে কথা কি বলেছি আগে! বলিনি। এইবার বলি।
আমরা এসে গেছি সাড়ে চার আলোকবর্ষ দূরের ভিন্ন এক জগতে—দ্য ফ্লোটিং আইল্যান্ড অব প্যান্ডোরা। দ্য ওয়ার্ল্ড অব অ্যাভাটার!
যেখানে ছুটে চলে ভাসমান পর্বতমালা। দিনের আলোয় সবুজ দেখালেও রাতের বেলায় ঝলমল করে জ্বলে বায়োল্যুমিনেসেন্ট অরণ্য।
এ এমন এক জগৎ, যা পৃথিবীরই মতো তবু প্রায় সব দিক দিয়েই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আজগুবি অথচ কী অবিশ্বাস্য সুন্দর!
এখানে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে না। তাই শূন্যে ভেসে বেড়ায় পর্বতমালা, জল টলমল নদী-নালা-হ্রদ। অবাক করা এক চন্দ্র।
সেই চাঁদের দেশের আকাশে আমাকে নিয়ে উড়ছে মাউন্টেন ব্যানশি। ডানা মেলা অতিকায় এক পক্ষী। কী অসাধারণ শক্তি এই পাখির। ছড়ানো ডানায় সূর্যের তেজ। আলোর চেয়েও ক্ষিপ্র তার গতি। আমি তাজ্জব হয়ে দেখি। আর দেখি।
মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত! অথবা তারও কম।
আচমকা ঝড়ের গতিতে আবারও ছুটল ব্যানশি। উড়ে গেল পান্না সবুজ ভয়ংকর সুন্দর এক সাগরের বুকে। কী বিশাল তার ঢেউ! পাহাড় সমান। ঢেউয়ের ওপর দিয়ে বাতাসের বেগে ছুটছে ইকরা। উত্তাল হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছি আমি। আমার দুই পায়ে ধাক্কা দিচ্ছে বাতাসের চাবুক। হাতে-মুখে-গায়ে ছিটকে এসে লাগছে জলের ছিটা।
এই বুঝি ডুবে গেলাম অথই সাগরে! বাঁচবার আশা নেই। নেই কোনো ভরসা।
আমাকে ডানায় নিয়ে ভয়ংকর সেই সবুজ সাগরে নাগরদোলার মতো দুলছে ব্যানশি। বনবন করে ঘুরছে আমার মাথা। ব্যানশির যেন কোনো ভাবনাই নাই। সে চট করে আকাশ ছোঁয়া প্রকাণ্ড এক পান্না সবুজ ঢেউয়ের মোড়কে ঢুকে গেল। শরীরে প্রচণ্ড ঝাপটা তুলে ঢেউয়ের মোড়ক ভেঙে শূন্যে ঘূর্ণির মতো ওপরে উঠছে ইকরা। একই মরণ খেলায় মেতেছে ও!
আমাকে কি আর বাঁচতে দেবে না!
সর্বগ্রাসী ভয়ের কবলে দিশেহারা আমি। চোখ বন্ধ করলাম ভয়ে।

আমার আধমরা অবস্থা দেখেই কিনা জানি না, মাউন্টেন ব্যানশি এসে ল্যান্ড করল ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো শহরের ডিজনি অ্যানিমাল কিংডমে। বারো একর জোড়া প্যাণ্ডোরা ল্যান্ডে।
ঝলমলিয়ে জলে উঠল রুমের আলো।
যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল সবাই।
প্রাণভরে নিশ্বাস নিলাম আমরা। যাক! কোনোক্রমে ভয়াল সুন্দর জগৎটা পেরিয়ে আসতে পেরেছি!
আমরা আটজন বিস্ময় বিমোহিত যাত্রী একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলাম।
মাথাটা এখনো ঘুরছে সবার।
পা দুটো টলমল।
তবু আনন্দে বিহ্বল।
ডিজনির সর্বশেষ সংযোজন—সদ্য আসা রাইড ‘অ্যাভাটার ফ্লাইট প্যাসেজ’-এর কথা বলছিলাম আমি এতক্ষণ। এটি একটি flying augmented reality e-ticket simulator attraction—যেখানে অতিথিরা মাউন্টেন ব্যানশির পিঠে চেপে অচেনা এক আকাশে উড়ে বেড়ান।
সংক্ষিপ্ত এই রাইডে সশরীরে ঘুরে এলাম অবিশ্বাস্য সেই ভিন্ন এক চাঁদের দেশে। যেখানে বাতাসে হিল্লোল তুলে লীলাময় প্রকৃতির ম্যাজিক। ডিজনির এ যাবৎকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাইড।
একরাশ মুগ্ধতা আর ঘোরলাগা বিস্ময়! এ বিস্ময় খুব সহসাই শেষ হওয়ার নয়।
*নাজমা রহমান: মেরিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র।