অস্ট্রেলিয়ায় বাংলা মঞ্চনাটক ‘ভদ্দরনোক’
১৮ জুন সন্ধ্যায় পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশিদের সংগঠন বাওয়া আয়োজিত ড্রামা অ্যান্ড শর্টফিল্ম উৎসবে ‘ভদ্দরনোক’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয় পার্থের কালামুন্ডা পারফরমিং আর্ট সেন্টারে। ভদ্দরনোক নাটকটি ফরাসি নাট্যকার মলিয়েরের Le Bourgeois Gentilhomme–এর বাংলা রূপান্তর।
ফরাসি ভাষায় নাটকটি প্রথম মঞ্চায়িত হয় ১৬৭০ সালে ফ্রান্সে। ১৮৮৪ সালে নাটকটি ফরাসি ভাষা থেকে ‘হঠাৎ নবাব’ নামে বাংলায় অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯৯০ দশকে নাটকটির ইংলিশ আনুবাদ ‘দ্য বুর্জোয়া জেন্টেলম্যান’ থেকে ‘ভদ্দরনোক’ নামে বাংলা ভাষায় রূপান্তর করেন নাট্যকার গোলাম সারোয়ার। নাটকটি প্রবাসে মঞ্চায়নের লক্ষ্যে যন্ত্রের কাজ করেন বিশ্বজিৎ বসু এবং নির্দেশনা দিয়েছেন শর্মিষ্ঠা সাহা।
সমাজে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা এক শ্রেণির বিত্তবান মানুষ আকস্মিক অর্থপ্রাপ্তিতে বেসামাল হয়ে জোর করে নিজেদের সম্ভ্রান্ত প্রমাণের জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তারা নগরজীবনের ফাঁপা সভ্যতা ও সংস্কৃতির গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে নিজের অতীতকে অস্বীকার করতে চায়। চিন্তা এবং কর্মে পরিচ্ছন্নতা ও সুস্থ রুচি অর্জনের পরিবর্তে বাহ্যিক চাকচিক্য অনুকরণ ও তা প্রদর্শনে বেশি ব্যস্ত হয়ে ওঠে। জোর করে সম্ভ্রান্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তারা উদ্ভট আচরণ শুরু করে এবং নিজেদের একধরনের হাস্যাস্পদ বেওকুফে পরিণত করে।
নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফজর আলী এ রকম একজন হঠাৎ বিত্তবান। স্ত্রী ফুলজান, ছেলে ফাহিম, মেয়ে ফারিয়াকে নিয়ে তার সংসার। পূর্বপুরুষের ভিটে বিক্রি করে গিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতে। কয়েক বছর চাকরি করে দেশে ফিরে আসেন ফজর আলী। শুরু করেন ঢাকা শহরে বসবাস। ফজর আলীর একমাত্র বোন শেফালী এবং শ্যালিকা কুলসুমও থাকে পরিবারে সঙ্গে। হঠাৎ অক্ষরজ্ঞানহীন ফজর আলীর মাথায় ঢোকে তাকে খানদানি এবং ভদ্রলোক হতে হবে।
শুরু হয় তার জবরদস্তিমূলক সম্ভ্রান্ত হওয়ার চেষ্টা। সে জন্য বাড়িতে নাচের মাস্টার, গানের মাস্টার, শরীরচর্চার জন্য মাস্টার এবং দর্শনশাস্ত্র শেখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক নিয়োগ দেয়। ফজর আলীর এই সম্ভ্রান্ত হওয়ার চেষ্টার সুযোগ নিয়ে নবাব বংশের পরিচয়ধারী শফি আলম এক সুন্দরী নারী কুমকুমের সঙ্গে বিয়ের লোভ দেখিয়ে টাকাপয়সা হাতিয়ে নিতে থাকে।
এদিকে শেফালীর ভালোবাসার পাত্র করিম আর কুলসুমের ভালোবাসার পাত্র শাহাবুদ্দিন। ফুলজান চায় শেফালী এবং কুলসুমের বিয়ে হোক তাদের পছন্দের পাত্রের সঙ্গে। একদিন ফুলজানের পরামর্শে করিম নিজেই ফজর আলীর কাছে শেফালীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু করিম কোনো খানদানি বংশের ছেলে না হওয়ায় ফজর আলী বিয়েতে রাজি হয় না।
করিমের বন্ধু শাহাবুদ্দিন ফজর আলীর চরিত্র বুঝতে পেরে তাকে বিয়েতে রাজি করানোর একটি উপায় বের করে। সে নিজে একজন ইমাম এবং করিমকে বাদশা কুয়েতের ছোট ভাই সাজিয়ে শেফালীর সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তারা দুজনে যুক্তি করে ফজর আলীকে আল কুদরাহ নামক একটি পদবি দেয়। আল কুদরাহ উপাধি এবং আমিরে কুয়েতের সঙ্গে আত্মীয়তার লোভে ফজর আলী বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় শীত এবং ঝড়বৃষ্টি কাল। যথারীতি নাটকের আগের রাত থেকেই শুরু হয় প্রচণ্ড বৃষ্টি। নাটকের দিন সন্ধ্যায় সেটা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। সংস্কৃতিপ্রিয় পার্থবাসী বাঙালি ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে সন্ধ্যা ছয়টার আগেই উপস্থিত হয় হল প্রাঙ্গণে। উৎসবে প্রথমে প্রদর্শিত হয় এখানে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের কিশোরদের তৈরি স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র। বিরতির পর শুরু হয় মঞ্চনাটক ভদ্দরনোক। এটি একটি কমেডি নাটক।
নাটকের রচয়িতা কমেডির মধ্য দিয়ে সমাজের একটি বিশেষ চিত্র তুলে ধরেছেন। আর অভিনেতারা অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সুচারুভাবে সেটা তুলে ধরেছেন দর্শকের সামনে। চারটি দৃশ্যের এ নাটকে শুরু থেকেই দর্শকেরা এর সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে ফেলে। তুমুল হাসি আর করতালিতে ভরে থাকে পুরো সময়।
ভদ্দরনোক পার্থের নাট্যদল বেঙ্গল আর্টসের দ্বিতীয় সফল প্রযোজনা। নাটক শেষে দর্শকদের ছিল উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। কয়েকজন দর্শকের মন্তব্যে সেই সফলতার চিত্র ফুটে ওঠে। পার্থের মাটিতে প্রথম মঞ্চনাটক দেখতে আসা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ঢাকায় শিল্পকলার নাট্যমঞ্চে অনেক নাটক দেখেছি। সেগুলোর তুলনায় এটা ১২০ ভাগ সফল। এরপর কোনো নাটক হলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নাটক দেখতে আসব, আমার বন্ধুদের উৎসাহিত করব নাটক দেখতে।’ নাট্যামোদী সৃজিব চক্রবর্তী মন্তব্য করেন, ‘আবার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স।
আমরা প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেছি, সত্যিই খুব বিনোদনমূলক।’ আরেক নাট্যমোদী নাজমুস সাদাত মন্তব্য করেন, ‘প্রবাসের মাটিতে এ রকম একটি মঞ্চনাটক দেখা আমাদের সৌভাগ্যের ব্যাপার।’
নাটকটিতে ফজর আলীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিশ্বজিৎ বসু। এ ছাড়া অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন গানের শিক্ষক-আরীব ইসলাম, শেফালী-অনিন্দিতা দে ত্রয়ী, ফাহিম-পৃথুল বিস্ময় বোস, ফারিয়া-অরুনিমা সরকার, সালামত-সাদিকুর রহমান, নাচের শিক্ষক-অয়ন ভট্টাচার্য, কুংফু মাস্টার-শৌভিক লাহিড়ী, অধ্যাপক-বাবলু হীরা মণ্ডল, দরজি-অমিত দত্ত, কুলসুম- প্রজ্ঞা রায়, ফুলজান- শর্মিষ্ঠা সাহা, শফি আলম-প্রিয়ঙ্কর ঘোষ, করিম- আসিফ ইকবাল, শাহাবুদ্দিন-দেবদত্ত বণিক (রবিন), কুমকুম-নুপূর তুলশান।
গানের দল: অর্জুন সরকার, কুহেলী সরকার, গার্গী সরকার, অনু শর্মা, সুবর্ণা চৌধুরী, পলাশ বড়ুয়া । নাচের দল: জয়তী, আপ্তি, ত্রয়ী, সিয়েনা, রাজশ্রী, আয়াত, সুহাইরা, বিস্ময়, অরুনিমা, অ্যামেলিয়া, নিধি, ঋদ্ধি। কোরিওগ্রাফার: মিথিলা রায় ও অনন্যা শর্মা। নেপথ্য কণ্ঠ: তাসনীমুল গালিব অমিত। মঞ্চ ব্যবস্থাপনায় ছিলেন: রূপম বড়ুয়া, আলোক প্রক্ষেপণ: তাসনীমুল গালিব অমিত, শব্দ সঞ্চালনায়: ঝুটন কুরী। বিজ্ঞপ্তি