অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি যেমন
![অলংকরণ: তুলি](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2020%2F02%2F17%2Fb11d106027e6917234b251c565072b72-5e4ac1f20cc75.jpg?auto=format%2Ccompress)
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মুঞ্জরি কমিশনের (ইউজিসি) এক প্রতিনিধিদল এসেছিল অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে। দলটি কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে (কিউইউটি) আসায় তাদের সঙ্গে আমার কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছিল।
ওই দলে ইউজিসির চেয়ারম্যান ও সদস্য ছাড়াও কয়েকজন সিনিয়র ও জুনিয়র লেভেলের সরকারি আমলা ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বুঝতে কিউইউটির অধ্যাপক ও প্রশাসনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাদের মতবিনিময় হয়েছিল। মতবিনিময়ে একই সঙ্গে কিউইউটির বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বেশ কয়েকটি প্রেজেন্টেশনও ছিল।
এমনই এক প্রেজেন্টেশনের পর ইউজিসির প্রতিনিধিদলের একজন আমলা সদস্য হঠাৎই ‘উপস্থাপককে’ একটি প্রশ্ন করেন কিউইউটির ছাত্ররাজনীতি নিয়ে। প্রশ্নটি ছিল এমন, ‘আপনাদের শিক্ষার্থীরা অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে কি ডিস্টার্ব দেয় না? বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয় না?’
এই প্রশ্নটি বোঝাতে অবশ্য প্রশ্নকারীকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। উপস্থাপক এই খাপছাড়া প্রশ্নটা প্রথমে বুঝতে পারেননি। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, ভাষাগত কারণে হয়তো তিনি প্রশ্নটি বুঝছেন না। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, শিক্ষার্থীরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত করতে পারে এমন কোনো অ্যাটিচিউড সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নয়। তাই বিষয়টি বুঝতে তার সমস্যা হচ্ছিল।
![ইপিআইসির নির্বাচনী প্রচারণাপত্র। ছবি: লেখক](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2020%2F02%2F17%2F3b7b3f0a35a28e0245d6dcad1f016670-5e4ac1d541cb9.jpg?auto=format%2Ccompress)
যাহোক, এই প্রশ্নের উত্তরে কিউইউটির প্রশাসনের উপস্থাপক বলেছিলেন, কিউইউটিতে স্টুডেন্ট প্রতিনিধিত্ব একটি স্টুডেন্ট গিল্ডের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। তাই তাদের কোনো বিষয় থাকলে তা তারা প্রকাশ করতে পারে কাউন্সিলে।
এরপর সম্পূরক প্রশ্নে প্রশ্নকারী আবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, দেশের রাজনৈতিক কোনো কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বন্ধ করে দেন না?
কিছুটা অবাক হয়ে উত্তরদাতা পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, কেন? বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করবেন কেন? রাজনৈতিক কারণ থাকলে পার্লামেন্ট হাউসে যাবেন তাঁরা।
তাঁর এহেন উত্তরে এ বিষয়ে আর কথা পরবর্তী সময়ে এগোয়নি।
আসলে বাংলাদেশের প্রচলিত ছাত্ররাজনীতি চর্চার পরিপ্রেক্ষিতে এমন কৌতূহল হয়তো স্বাভাবিকই।
![ভোট গ্রহণ চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এক্সিকিউটিভ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নেই কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। লাইনে দাঁড়িয়ে সবাই ভোট দিয়ে চলে আসছেন। প্রায় এক সপ্তাহজুড়ে এই ভোট গ্রহণ কার্যক্রম চলে। ছবি: লেখক](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2020%2F02%2F17%2F2846a7508d528733c112cc3cec439895-5e4ac1d5c2c45.jpg?auto=format%2Ccompress)
কেননা, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্ররাজনীতি সরাসরি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংযুক্ত। তাই সেসব রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপের অনুরূপ কর্মকাণ্ড ছাত্রসংগঠনগুলোও চর্চা করে থাকে। যার ফল হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড প্রভাবিতসহ তারা কখনো কখনো জোরপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিয়েও থাকে।
কয়েক দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সরকার কর্তৃক অলিখিতভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। যেখানে কখনো কখনো এই ছাত্রসংগঠনগুলোর পছন্দের ভূমিকাও থাকে।
সে যা–ই হোক, কিউইউটিতে পড়াশোনার সুবাদে খুব কাছ থেকে এখানকার ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম আমার পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে এদের কার্যক্রম তাদের নির্বাচনী প্রচারপত্র থেকেই অনেকটা বোধগম্য করা সম্ভব।
কিউইউটির প্রধান দুটি স্টুডেন্ট দলের একটির নাম ইপিআইসি। তারা অনেকবার নির্বাচিত হয়েছে।
এদের ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারপত্রে প্রথমেই দেখা যাচ্ছে, তাদের কার্যক্রমের আওতায় বিভিন্ন ধরনের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা তারা ফ্রিতে করে থাকে। যেমন কুকিজ, এনার্জি ড্রিংক, কফি ইত্যাদি।
তারা দাবি করছে কিউইউটিতে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় ‘ইউনিভার্সিটি বার’ তারা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুসারে তারা পরবর্তী সময়ে বিচ পার্টি, ডিসকো পার্টি ও ফ্ল্যাশব্যাক পার্টির আয়োজনও করবে। পরবর্তী পয়েন্টে তারা লিখেছে, তাদের দল কিউইউটিতে সর্ব বৃহৎ সার্ভে পরিচালনার মাধ্যমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিছু এক্সিজটিং পলিসি বাতিল করেছে।
যেমন ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রিতে শিক্ষার্থীদের ওপরে অ্যাডমিন একটা ওভার চার্জ করেছিল, সেটা তারা রিফান্ডের ব্যবস্থা করছে।
চতুর্থ পয়েন্টটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইপিআইসি বলছে, তাদের কাছে শিক্ষার্থী হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রায়োরিটি। তাই শিক্ষার্থী নিয়ে যত পলিটিকস আছে, তা তারা কিউইউটি কাউন্সিলের মাধ্যমেই শেষ করে। তারা কখনোই কোনো পলিটিক্যাল পারপাজে (অর্থাৎ দেশের রাজনীতিতে) স্টুডেন্ট পলিটিকসকে ব্যবহার করে না। এই পয়েন্টটাকে তারা নাম দিয়েছে ‘Zero Politics’.
![ভোটদানের পর ভোটারকে দেওয়া হচ্ছে ফুড অ্যান্ড ড্রিংক ভাউচার। ছবি: লেখক](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2020%2F02%2F17%2F7bc1ead253ce3055dcf6b4c5a5df45c7-5e4ac1d58fa37.jpg?auto=format%2Ccompress)
এ ছাড়া কিউইউটি guild-এ তারা ক্লাব সংখ্যা ১৩০-এ উন্নীত করেছে এবং এই ক্লাবগুলোর মাধ্যমে তারা শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। যেমন বিভিন্ন সোশ্যাল ইভেন্ট পরিচালনা বা স্পোর্টস অ্যাকটিভিটিজ পরিচালনা করছে।
এই হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট পলিটিকস। আমি বুঝতে পারছি, প্রথম পয়েন্টটা দেখে বাংলাদেশি পাঠকেরা অনেকেই হয়তো আঁতকে উঠবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে মদের বার। তাদের জন্য বলা, মদ একটা স্বাভাবিক পানিয় এই দেশে। অস্ট্রেলিয়ার অ্যালকোহল আইন অনুসারে ১৮ বছরের ওপরে এটা বৈধ।
যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে সেই তারুণ্য ছাড়িয়ে যৌবনে পদার্পণের সময়কাল, এখানেই তাই অ্যালকোহলের সমাদরটা দেখা যায়। তবে মদ খেয়ে নিজেকে কীভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে সংবরণ করতে হয়, সেটাতেও তারা সিদ্ধহস্ত। তাই কখনোই মাতলামি বা অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায় এদের ভেতরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তো নয়ই।
মানুষমাত্রই আমরা সাফল্য দ্বারা প্রভাবিত হই এবং যেকোনো সিস্টেমের সাফল্য তার ফলাফলে দৃশ্যত হয়। খুব সন্তর্পণে এখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাষ্ট্রীয় রাজনীতি থেকে ছাত্রছাত্রীদের দূরে সরিয়ে রেখেছে। এদের দেশে রাজনীতি আমাদের দেশের মতো ধ্বংসাত্মক নয়। তারপরও রাজনীতিকে উচ্চশিক্ষার আঙিনা থেকে দূরে রেখে তারা মেধা আর প্রতিভা বিকশিত করার সুযোগ করে দিয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণায় তাদের ঈর্ষণীয় উন্নতি তাই পরিলক্ষিতও হচ্ছে।
পক্ষান্তরে ধ্বংসাত্মক ও বিপথগামী রাজনীতির চর্চায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা অঘটন নিয়তি হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। একই সঙ্গে প্রায়ই অকালে মূল্যবান প্রাণ ঝড়ে পড়ছে। ফলাফলে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। আমার কেন যেন মনে হয় দেশের এই রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি এখন সময়ের দাবি।
ফিদা হাসান: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক