অশরীরিণী
ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ল ২০ মিনিট লেটে। ঢাকা থেকে বাসে করে ময়মনসিংহে সেই দুপুরবেলা এসে পৌঁছেছে। তারপর ট্রেনের জন্য এই লম্বা সময়ের অপেক্ষা। তবে ব্রহ্মপুত্র রেলসেতু পার হওয়ার পর অন্য রকম একটা ভালো লাগা ছেয়ে গেল। ট্রেনের জানালা দিয়ে যত দূর চোখ যায় হলদে শর্ষে ফুলে ছেয়ে গিয়েছে সব। মুহূর্তের ভেতর সব ক্লান্তি সরে গেল মন থেকে। আজকের এই ট্রেন জার্নির কারণ হলো প্রথম চাকরির কর্মস্থলে যোগ দান। শফিকের অচিন্তপুর কলেজে প্রভাষক হিসেবে চাকরি হয়েছে। কয়েক দিন আগে যখন জয়েনিং লেটার হাতে পায় প্রথমে খুব খুশি হলেও খানিক পর তা রূপ নিয়েছিল বিষাদে।
একবারেই নতুন একটি কলেজ। চালু হয়েছে মাত্র বছরখানেক হলো। প্রথম দিকে চিন্তাই করতে পারেনি সত্যিই ঢাকা থেকে এ রকম অজোপাড়ার কলেজে শিক্ষকতা করতে যাবে। প্রথম কিছুদিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলেও পরে ঠিক করেছে জয়েন করবে। ছোটবেলায় মামাবাড়ি ছাড়া কোনো দিন গ্রামে যাওয়া হয়নি। সেটাও প্রায় ২০ বছর আগের কথা। সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপাতত গিয়ে দেখবে, আর খারাপ লাগলে ফিরে আসবে ঢাকায়। ইতিমধ্যে নতুন কলেজের প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা হয়েছে কয়েকবার। মনে হয়েছে, খুবই আন্তরিক একজন মানুষ। শফিককে বারবার আশ্বস্ত করেছে সব রকম সহযোগিতা করবেন তারা। শুধু ব্যাগ গুছিয়ে চলে এলেই হবে। এটাও জানালেন, শফিকের জন্য থাকার জায়গা ঠিক করা হয়েছে স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে। খারাপ লাগবে না ওখানে থাকতে। বিশাল বাংলো। এটাও কয়েক মাসের জন্য।
শিগগিরই কলেজের নিজস্ব আবাসনের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তখন গ্রামের ভেতর শহরের মতো সব সুযোগ–সুবিধা পাওয়া যাবে। তবে কলেজ প্রিন্সিপালের এই শিগগিরই শব্দের ভেতর তেমন কোনো ভরসা খুঁজে পেল না। বরং কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত হলো। সম্ভবত তিনি লজিং মাস্টার টাইপ কিছু ঠিক করে ফেলেছেন। অবশ্য এ চিন্তা ভুলও হতে পারে।
প্রিন্সিপাল সাহেবকে যথেষ্ট যত্নবান মানুষ বলেই মনে হয়েছে। তিনি ঢাকা থেকে অচিন্তপুর কলেজে যাওয়ার সবকিছু খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিয়েছেন। ঢাকা থেকে সোজা ময়মনসিংহে। তারপর বিকেল পাঁচটায় ঈশা খাঁ ট্রেনে করে সোহাগী রেলস্টেশনে। এখানে পৌঁছাতে রাত ১০টা হয়ে যাবে। তবে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কলেজের পিয়ন রতন স্টেশনে রিসিভ করার জন্য অপেক্ষা করবে। সম্ভব হলে অন্য একজন শিক্ষকও স্টেশনে রতনের সঙ্গে থাকবে। কীভাবে আসতে হবে, তা ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়ার পর আবার জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হয়ে নিলেন। তবে বারবার বলে দিয়েছেন কোনো কারণে রতন পৌঁছাতে দেরি করলে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে যেন অপেক্ষা করেন। কারণ, রাতের বেলায় স্টেশনের আশপাশের এলাকায় শিয়ালের আনাগোনা আছে। শফিক অবশ্য এই শিয়াল নিয়ে ভয় পাচ্ছে না; বরং বেশ নির্ভার মনেই অচিন্তপুর যাচ্ছে। সত্যি বলতে কি, ট্রেনের জানালা দিয়ে গ্রামের চিরাচরিত রূপ দেখতে ওর খুবই ভালো লাগছে। ইট–কাঠের শহরে সন্ধ্যার আগমুহূর্তের এই রূপ দেখতে পাওয়া যায় না। ডিসেম্বর মাসের শেষ দিক হওয়াতে শীতের কুয়াশা পড়া শুরু হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দূরের সব বাড়িঘর ধীরে ধীরে সাদা চাদরে ঢেকে যাওয়ার দৃশ্য শেষ কবে দেখেছে, মনে করতে পারল না। ওর সামনের সিটের দুটি ছোট বাচ্চা ট্রেনের জানালা ধরে বাইরে থাকিয়ে আছে মুগ্ধ চোখে। ওদের উচ্ছ্বাস চোখে পড়ার মতো।
শফিকের নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। প্রতিবছর ডিসেম্বর এলেই ওরা ভাইবোন সবাই মিলে মামাবাড়ি বেড়াতে যেত। সবার স্কুলের পরীক্ষা শেষ হতো, বিধায় অন্য খালারাও সপরিবার চলে আসত। মোটামুটি দু-তিন সপ্তাহের জন্য মামার বাড়িতে জম্পেশ ক্যাম্পেইন। ফিরে আসার সময় একটা প্রিয় কাজ ছিল ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা। মনে হতো ট্রেনের সঙ্গে করে মামাদের গ্রামের সব বাড়ি ছুটে আসছে। ট্রেনের হুইসেলে শফিকের ভাবনায় ছেদ পড়ল। ট্রেন গৌরীপুর রেল জংশনে এসে থেমেছে। হইহুল্লোড় করে বেশির ভাগ যাত্রী এখানে এসে নেমে গেল। এখান থেকে আর কয়েক স্টেশন পর সোহাগী। গৌরীপুর স্টেশন থেকে যখন ট্রেন ছাড়ল, তখন সন্ধ্যা ছাড়িয়ে চারপাশ অন্ধকার হতে শুরু করেছে। সোহাগী স্টেশনে আসতে আসতে তখন বেশ রাত। গ্রামে এমনিতেই একটু তাড়াতাড়ি রাত নামে। এখন শীতকাল হওয়াতে মনে হচ্ছে রাত আরও গভীর হয়ে গিয়েছে। শফিক একটু হাতঘড়িটায় চোখ বুলাল।
ঘড়ির কাঁটায় ঠিক ১০টা ৪০। স্টেশনে তেমন কোনো মানুষের আনাগোনা নেই। ট্রেন চলে যাওয়া কিছুক্ষণ পর দেখা গেল স্টেশনে যাত্রী বলতে ও একা। ওকে রিসিভ করার জন্য রতন নামে যার আসার কথা, তারও কোনো খোঁজ নেই। বাধ্য হয়ে এর ভেতর কয়েকবার ফোন করল প্রিন্সিপালকে। কল হওয়ার আগেই তা কেটে যাচ্ছে। নয়তো একই কথা ঘুরেফিরে আসছে—এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য প্রিন্সিপাল সাহেবকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তিনি আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন অচিন্তপুরে মোবাইলের নেটওয়ার্ক খুব দুর্বল। তবে ফোনে না পেলেও যেন চিন্তা না করে। পিয়ন রতন সময়মতো চলে আসবে। অনেকক্ষণ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থেকেও রতনের খোঁজ না পেয়ে স্টেশনের ওয়েটিং রুমটা খুঁজে বের করল। তবে মনে মনে নতুন একটা ভয় ঢুকে গেল এরই মধ্যে। সেটা হলো সাপের আতঙ্ক। এই রকম পুরোনো স্টেশনে আবার সাপের আস্তানা হয়েছে কি না, কে জানে। হাতে আর কোনো ভালো কোনো উপায় নেই দেখে ভয়ে ভয়ে অন্ধকার রুমে প্রবেশ করল। মোবাইলের হালকা আলোতে লাইটের সুইচ খুঁজে পেতে তেমন বেগ পেতে হলো না। তবে লাইট জ্বালানোর পর রুমের বসার ব্যবস্থা দেখে বেশ ভালো লাগল। পুরোনো কয়েকটি লাল রঙের স্টিলের ফিক্সড চেয়ারের পাশে লম্বা একটা সোফা। ট্রলি আর কাঁধের ব্যাগ রুমের ভেতর রেখে আবার বাইরে এসে কয়েকবার স্টেশনের সামনে হাঁটাহাঁটি করল। অনেক পুরোনো দিনের স্টেশন। খুব সম্ভবত পাকিস্তান সময়ের তৈরি, এমনকি ব্রিটিশ কলোনিয়াল শাসনের সময়কারও হতে পারে। দেয়ালের লাল রঙের প্লাস্টার ছাড়িয়ে ইট বের হয়ে এসেছে। ইট বের হয়ে যাওয়া স্থানে বেশ বড়সড় শিকড় গজিয়ে বটগাছ শ্রেণির কিছু একটা তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সহজেই বোঝা যাচ্ছে চারদিকের স্পষ্ট অযত্নের ছাপ। শফিক চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখল। বেশ গাঢ় কুয়াশা পড়েছে।
তবে এই অনিশ্চিত বিরক্তিকর অপেক্ষার সময়টাতেও একটা ভালো লাগার মতো জিনিস দেখতে পেল। আকাশে ফিনকি দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। ভরা চাঁদের আলোয় চারপাশের এই অন্ধকার পরিবেশ কেমন জানি একটা ভৌতিক রূপ ধারণ করেছে। এই পরিবেশকে আরও ভয়ার্ত করে তুলেছে থেমে থেমে দূর থেকে ভেসে আসা শিয়ালের চিৎকার। শিয়ালের চিৎকার শুনে প্রিন্সিপাল সাহেবের সতর্কবাণীর কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু অপেক্ষা করা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছুই করার নেই। এই ঠাণ্ডা পরিবেশের কারণে শফিকের চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে খুব। তবে চা পাওয়ার আশা কম।
আজকের শেষ ট্রেন চলে যাওয়াতে ইতিমধ্যে দোকানপাট বন্ধ। তবে রেললাইনের অপর পাশের চায়ের টংদোকানটি বন্ধ হলেও টিনের ছিদ্র দিয়ে হালকা আলো বেরিয়ে আসছে। কয়েকবার উঁকিঝুঁকি দিয়েও লাভ হলো না। মনে হয় দোকানি ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। কোনো উপায় না দেখে ওয়েটিং রুমে এসে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ বইটি নিয়ে বসল। এই অনিশ্চিত সময় কাটানোর জন্য এই রুশ শ্রমিক বিপ্লবের বিকল্প হয় না।
স্যার, আপনার চা। চিনি কম দিয়া আনছি। শহরের লোকেরা দেখছি চিনি কম খায়।
শফিক অবাক হয়ে বই থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাল। গায়ে চাদর, গলায় মাফলার জড়িয়ে মধ্যবয়স্ক একজন সামনে চা নিয়ে দাঁড়িয়ে। এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লোকটির মুখ থেকে আসা সস্তা সিগারেটজাতীয় গন্ধে রুমের পরিবেশটাই ভারী হয়ে গেল। একে তো চা খেতে খুব ইচ্ছা করছে, কিন্তু অপরিচিত লোকের চা খাওয়া ঠিক হবে কি না, তা বুঝতে পারছে না। তার ওপর নিজে থেকে লোকটি নিয়ে এসেছে। তাই সন্দেহ আরও প্রকট হলো।
আমি চা খাব, আপনি জানলেন কী করে?
আমি দোকানের ডালা বন্ধ কইরা রাস্তার ওই কোনাত বিড়ি খাইতেছিলাম। দেখলাম আমার দোকানের আশপাশে ঘুর ঘুর করতেছেন। উশের কারণে আমারে আপনি দেখেন নাই। আমি ঠিকই আপনেরে খেয়াল করছি। আর চা নিয়া ডরায়েন না, স্যার। খালি বাড়তি চিনি লাগলে আওয়াজ দেন।
শফিক উশ মানে বুঝতে পারল। এটা হলো কুয়াশা। আর তার যুক্তিও ঠিক আছে।
ভয়ে ভয়ে চায়ে চুমুক দিয়েই বেশ শান্তি শান্তি একটা ভাব চলে এল। বেশ কড়া লিকারের দুধ চা। তবে একটা বিষয়ে অবাক না হয়ে পারল না। যাত্রীবিহীন স্টেশনে এখনো কেন চা বিক্রির আশায় বসে আছে লোকটা।
সবাই দোকান বন্ধ করে চলে গিয়েছে। আপনি যাননি?
জে না, স্যার। আমার অন্য একটা দায়িত্ব আছে এইখানে। ওইডা শেষ কইরা দোকান বন্ধ করি।
শফিক বেশ অবাক হলো কথাটা শুনে।
স্টেশনের কোনো দায়িত্ব?
অনেকটা ওই রকমই। এইটা অনেক পুরানা দিনের স্টেশন। সেই ব্রিটিশ আমলের। আমাদের এই সোহাগী স্টেশন উদ্বোধনে বড় লাটসাহেব নিজে আইছিলেন। এরপর কত মানুষ এই রাস্তা দিয়া গেছে, তার হিসাব নাই। যারাই বিপদে পড়ছে, আমিই উদ্ধার করার চেষ্টা করছি। তখন অবশ্য এই সোহাগী স্টেশনের অনেক নামডাক আছিল। দেশ-বিদেশ থাইক্যা মহাজনেরা আসত পাট কিনতে। এখান থেকে ট্রেনে কইরা পাট নিয়া ময়মনসিংহের গুদামে সব জমা করতেন। এখন অবশ্য আগের দিন নাই। সারা দিনে তিনডা ট্রেন আয় মাত্র। এর মধ্য এগার সিন্দুর এক্সপ্রেস আবার এখন এইখানে থামে না। থামে সামনের বরুঙ্গা নদীর ওই পারের নতুন স্টেশনে। আমরা এই পারের মানুষ, তবু এইডা লইয়া পইড়া আছি।
লোকটি এমনভাবে কথা বলছে যেন পুরোনো দিনের সব জৌলুশ তার চোখেমুখে ভেসে আসছে। শফিকের বেশ ভালো লাগল কথা বলে। এতক্ষণে বুঝতে পারল, কেন নিজ দায়িত্বে লোকটা চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে। গ্রামের সহজ–সরল বেশ পরোপকারী লোক।
তাহলে এখন স্টেশনের কী দায়িত্বে আছেন?
এবার লোকটি একটু হাসল। বেশ রহস্যজনক। শফিক অবাক হলো না। গ্রামের মানুষ একটু রহস্য পছন্দ করে।
স্যার, আমি এখন যাই। আপনি রাতটা এখানে কাটায়ে দেন। ফজরের আজানের সময় এগার সিন্দু ট্রেন আইলে ওটা ধইরা আবার ফেরত চইলা যাইয়েন। ওই ট্রেন ধরার জন্য ব্রিজ পার অইতে অইব।
চলে যাব কেন, আমি তো এখানকার কলেজে জয়েন করতে এসেছি। আমাকে নিতে একজন লোক আসার কথা ছিল স্টেশনে।
সে আর আইব না, স্যার।
কথাটা মনে হলো বেশ জোর দিয়েই বলল। যেন চা–ওয়ালা আগে থেকেই সব জানে। শফিক একটু চিন্তায় পড়ে গেল। তবে এর কোনো প্রকার প্রকাশ চোখেমুখে পড়তে দিল না।
হুম ঠিকই বলেছেন। আজকে হয়তো না আসারই সম্ভাবনা। যার নিতে আসার কথা ছিল, হয়তো কোনো ঝামেলায় পড়ে গিয়েছে। যা–ই হোক, আপনি এখন যান। সকাল হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আচ্ছা, তাইলে কমপক্ষে আমি যাওয়ার পর রুমের দরজাটা বন্ধ কইরা দিয়েন।
দরজা বন্ধ করে দেব কেন? অন্য কোনো যাত্রীও আসতে পারে।
না, এখন এই রাইত–বিরাইতে আর কোনো যাত্রী এই স্টেশনে আইত না। ম্যালা বছর থাইকা দ্যাখতেছি। প্রতিবছরের এই দিনে আপনিই হইলেন এই স্টেশনের শেষ যাত্রী।
মানে বুঝলাম না। এই স্টেশনে আমি এবারই প্রথম এলাম। শুধু এই সোহাগী কেন, ময়মনসিংহে আমার জীবনে এই প্রথম আসা।
শফিকের কথা শুনে লোকটি একটু হাসল।
স্যার, বুঝার দরকার নাই। বুঝলেই বিপদ। যে রকম কইলাম, ওইটাই কইরেন।
আপনি কি আমাকে ভয় দেখাতে চাচ্ছেন?
কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বের হয়ে গেল। একটু পরই আবার ফেরত এল।
বলতে ভুইলা গেছিলাম। আমার নাম মন্তু শেখ। এই এলাকার সবাই আমারে চিনে। দরকার লাগলে এই নাম ধরে ডাক দিয়েন। আমি সজাগই থাকি সারা রাইত।
রহস্যমাখা কথাবার্তা শুনে শফিকের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। গ্রামের মানুষ এমনিতে খুব সহজ–সরল। কিন্তু নিজেকে একবার চালাক মনে করলে চারপাশের মানুষকে সস্তা জ্ঞান দিতে ছাড়ে না।
আচ্ছা, আপনি যান। এটা নিয়ে আপনাকে আর ভাবতে হবে না। আর ওয়েটিং রুমের দরজা খোলাই থাকবে। পারলে আর এক কাপ চা দিয়ে আপনি ঘুমাতে যেতে পারেন।
মন্তু শেখ মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল। তবে এই চলে যাওয়ার মধ্যে বিরক্তির ভাব স্পষ্ট। মন্তু শেখ চলে যাওয়ার পর শিয়ালের ডাক মনে হচ্ছে খুব কাছ থেকেই আসছে। এবার শফিক সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। খাবারের খোঁজে শেয়াল স্টেশনে চলে আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরেকবার স্টেশনের চারপাশ দেখে নিল।
সারা স্টেশন ঘুমিয়ে পড়েছে। মন্তু শেখের দোকানের ভেতর থেকেও আর আলো আসছে না। মনের ভেতর এই প্রথম একটা ভয়ের রেখা কেটে গেল। কেন জানি সারা গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেছে। শফিক নিজেই অবাক হয়ে গেল। সে আসলেই ভয় পেতে শুরু করেছে। এখন মনে হচ্ছে, ভয়ে ওর চুল দাঁড়িয়ে গেছে। ব্যাপারটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য মাথায় হাত দিল। আসলেই তা–ই। ওর চুল পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেছে। যেন হঠাৎ করেই মাঝরাতে নিজেকে কোনো অজোপাড়ার রেলস্টেশনে আবিষ্কার করল। তাড়াতাড়ি ওয়েটিং রুমে ফিরে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর কাঁধব্যাগে মাথা রেখে সোফায় লম্বা করে শরীর ছড়িয়ে দিল। সারা দিনের ক্লান্তিতে কখন যে চোখ বুজে এসেছিল বুঝতে পারেনি। দরজায় বারবার কড়া নাড়ার শব্দে ওর ঘুম ভাঙল। শফিক হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী এখন রাত ৪টা ১০ মিনিট। এই ভোররাতে কে আসতে পারে। মন্তু শেখের ভাষ্যমতে এখন কোনো যাত্রী আসার কথা নয়। ফজরের আজান হতে এখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। শফিকের চিন্তায় দ্রুতই ছেদ পড়ল।
স্যার, তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেড়িয়ে আসেন। খুব দ্রুত আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে। ট্রেন ধরতে চাইলে আমাদের এখনি বেরোতে হবে।
মেয়ে কণ্ঠের এই কান্নামাখা ভয়ার্ত কণ্ঠ শুনে ওর শিরদাড়ায় একটা ঠান্ডা ভয়ের স্রোত বেয়ে গেল। মেয়েটির কণ্ঠ কোথায় যেন শুনেছে। তবে ঠিক মনে করতে পারছে না। এখন কী করবে, কী সিদ্ধান্ত নেবে বুঝতে পারছে না। এর ভেতর আবার দরজায় টানা কড়া নাড়ার শব্দ।
প্লিজ স্যার, তাড়াতাড়ি করেন। ওরা আবার আমাদের ধরে ফেলবে।
শফিক মনের সব ভয় সরিয়ে দরজা খুলে দেখল পরির মতো একটি সুন্দর মেয়ে নতুন বউয়ের পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে। তবে মুখটি খুব পরিচিত একজনের। বিয়ের সাজের কারণে বয়সটা বোঝা যাচ্ছে না। সতেরো কি আটারো হবে। তবে এত সুন্দর মেয়ে আর কোনো দিন ওর চোখে পড়েনি।
শফিকের উদ্ভ্রান্ত ভাব দেখে মেয়েটি আবার কান্নামাখা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল।
স্যার, আপনার কী হয়েছে? মনে হচ্ছে আমাকেই চিনতে পারছেন না?
মুহূর্তেই শফিকের সব মনে পড়ে গেল। ওর নাম নিশি। চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ে।
কী বলো, তোমাকে চিনব না কেন? তুমি নিশি। আজকে তোমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
হ্যাঁ। কিন্তু আমি তো আপনাকে দেওয়া কথামতো বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে পালিয়ে এসেছি।
আমাদের তো আর কিছুক্ষণের ভেতর ট্রেন ধরার কথা ওই পারের নতুন স্টেশন থেকে।
নিশি হ্যাঁ–সূচক মাথা ঝাঁকাল।
এই কথা বলার পর শফিকের মাথাটা একটু ঘুরে গেল। ও তো এখনো চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতেই যায়নি। আজকেই প্রথম ওদের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। তাহলে নিশির সঙ্গে কোনোভাবে পরিচয় থাকা তো দূরের ব্যাপার, ওকে চেনারই কথা নয়। শফিক ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ওর মনে পড়ে গেল মন্তু শেখের কথা। কয়েকবার চীৎকার করে ডাকল মন্তু শেখ, মন্তু শেখ।
মন্তুকে কেন ডাকছেন? ও আমাকে আবার ওদের হাতে ধরিয়ে দেবে।
শফিক চোখ খুলতে চাচ্ছে না। মনে হচ্ছে নিশি নামের এই অশরীরিণীর চোখে তাকালেই প্রেমে পড়ে যাবে। ও কোনো অশরীরিণীর মায়ায় জড়াতে চায় না।
কোনোভাবেই না। মন্তু শেখের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ধপ ধপ শব্দ করে খুব দ্রুতগতিতে ছুটে আসছে সে। মন্তু শেখ এসে শফিকের হাতটি ধরল।
স্যার, এখন দৌড় লাগান আমার সাথে। আমরার এক দৌড়ে বরুঙ্গা নদীর ব্রিজটা পার অইতে অইব। তাইলে আপনি নিরাপদ। না পারলে আগের বারের মতো ধরা পইড়া যাবেন। একবার ধরা পড়লে আর বের অইতে পারবেন না।
শফিক অন্ধের মতো উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় মন্তু শেখের সঙ্গে রেললাইন ধরে দৌড়াতে লাগল। রেললাইনের পাথরে এলোমেলো পা চালিয়ে পিছলে পড়ে গেল কয়েকবার। মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছে বুঝতে পারল। কিন্তু এসবে আর মনোযোগ নেই। আর একটু যেতে পারলেই বরুঙ্গা নদীর ব্রিজ। পেছনে নিশির নূপুরের শব্দ শোনা গেলেও ব্রিজ পার হওয়ার আগপর্যন্ত পেছনে ফিরে তাকায়নি। এপারে পৌঁছে শফিক পেছনে ফিরে তাকাল। মন্তু শেখকে দেখা যাচ্ছে না। সে হারিয়ে গিয়েছে ভোজবাজির মতো। তবে দূর থেকে নিশির অবয়ব দেখা যাচ্ছে। ওর পেছন থেকে একটা তীব্র আলো এগিয়ে আসছে।
আলো আরও নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছে। শফিক বুঝতে পারল নিশির পেছন থেকে ট্রেন আসছে। এক মুহূর্ত ভেবে শফিক উল্টা পথে নিশির দিকে ছুটতে লাগল। ওকে বাঁচাতেই হবে। এতক্ষণে অবশ্য দেরি হয়ে গিয়েছে। ট্রেন নিশিকে চাপা দিয়ে এখন ওর দিকে ছুটে আসছে। শফিক মন্ত্রমুগ্ধের মতো রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ট্রেনের। ট্রেনের তীব্র আলোয় হারিয়ে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে একটা চিৎকার দিয়ে শফিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। চোখ খোলার পর প্রথমে বুঝতে পারল না এই মুহূর্তে কোথায় আছে। তবে ওর মায়ের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে। ভালো করে থাকিয়ে দেখল নিজের রুমেই শুয়ে আছে সে। ওর মা এসে কপালে হাত দিল।
যাক বাবা, তোর জ্বর সেরেছে তাহলে। এখন কেমন আছিস। এই কয়েকটা দিন জ্বরের ঘোরে কী আবোলতাবোল বকেছিস। আগে সুস্থ হয়ে নে। তারপর তোর জন্য একটা খুশির খবর আছে।
শফিক শুকনা গলায় জিজ্ঞাসা করল, কী খুশির খবর মা?
তোর জন্য অচিন্তপুর কলেজ থেকে অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার এসেছে।
অচিন্তপুরের কথা শুনে শফিক আনমনে মাথায় হাত দিয়ে চমকে গেল। তাড়াতাড়ি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। ভয়ে ভয়ে চুলগুলো সরিয়ে কয়েকবার দেখল ভালো করে। দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না।
এখনো মাথায় ফুলে যাওয়া স্থান থেকে অল্প অল্প করে রক্ত ঝরছে। (চলবে)
*লেখক: পিএইচডি রিসার্চার ইন মলিকুলার মেডিসিন, ন্যাশনাল হেলথ রিসার্চ ইনস্টিটিউট, তাইওয়ান। [email protected]