অমল ধবল চাকরি

আমি তখন টরন্টোর রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। বছর খানিক হয় এসেছি। মনমতো কোনো কাজ পাই না। ভালো কাজের জন্য যে এত কিছুর দরকার লাগে আমার আগে জানা ছিল না। দেশে আমার বেশ ভালো একটা চাকরি ছিল। ভালো বেতন। কিন্তু একদিন ভাবলাম যাই। কানাডা যাই। অনেকেই যাচ্ছে। শুনেছি কানাডা নাকি হ্যাভেন। এর আগে আমি অফিস থেকে দেশ–বিদেশ গিয়েছি। আমেরিকা গিয়েছি। লন্ডন গিয়েছি। প্যারিস গিয়েছি।
অ্যাপ্লাই করলাম। ধরলাম ইমিগ্রেশন ল এজেন্সি। কানাডা আসতে গিয়ে প্রায় ফতুর দশা। লম্বা প্রসেস। তারা আমার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে নিল ফি বাবদ। আসার সময় সঙ্গে নিয়ে আসলাম প্রায় বিশ হাজার ডলার। সেই টাকা বসে বসে খাই। পরে জেনেছি ল্যান্ডিংপেপার জাল করেও অনেক লোকজন এ দেশে ঢুকেছে একসময়। অনেক অপরাধীও বাংলাদেশে থেকে এ দেশে এসেছে। তারা বহাল তবিয়তে আছে। জাতির পিতার খুনিও আছে কানাডায়।
আমেরিকা থেকেও হাজার হাজার অবৈধ ইমিগ্রান্ট কানাডায় এসেছে। অনেকে আবার ও দেশে নানা ধরনের ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত ছিল। ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, বাড়ি কেনাবেচায় জালিয়াতি। নানা কিছু ঘটে আমেরিকায়। অনেকে স্টুডেন্ট হিসেবে আমেরিকায় এসে আর পড়াশোনা করেনি। ডলারের মোহে পড়ে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে দিয়েছে। এরা কেউ ট্যাক্সি চালায়, কেউ পিৎজা ডেলিভারি করে প্রচুর পয়সা রোজগার করেছে।
আমি কানাডায় এসে দেখি আমার জন্য এখানে কিছু করার নাই। কঠিন অবস্থা। যাকেই বলি ভাই একটা কাজ দেন সেই বলে কাজ পাওয়া এত সোজা না। যাকেই বলি, ভাইসাব পড়াশোনা করতে চাই, সেই বলে পড়ে কি হবে? পড়ে কারও কিছু হয় নাই। কেউ একটা ভালো বুদ্ধি দেয় না। উত্তর আমেরিকায় অড জবকে সবাই বলে, ‘কাজ’। আমি যখন প্রথমবার আমেরিকায় আসি তখন দেখি সবাই বলে কাজে যাচ্ছি। আমি একটু ফাঁপরে পড়ে যাই। এখন বুঝি কাজ জিনিসটা কী।
আমার বন্ধু জালাল আহমেদ তাদের একজন। নিউইয়র্কে ট্যাক্সি চালাত। নিউইয়র্কে একটা এক রুমের বাসায় ভাড়া থাকত। জালালের স্ত্রী সারা দিন আর জালাল সারা রাত কাজ করে। কারও সঙ্গে কারও দেখা হয় না। জালালের স্ত্রী তার চার বছরের মেয়ে নিয়ে লিভিং রুমে ঘুমায় আর বেডরুম ভাড়া দেয়। সেখানে ছয়জন ব্যাচেলর যুবক থাকে। তারা সারা দিন কাজ করে। রাতে শুধু ফিরে আসে ঘুমাতে।
সেই জালাল কানাডায় এসে স্বর্গ হাতে পায়। এখানেও ট্যাক্সি চালানো শুরু করে। সে একদিন আমাকে বলল, ঢাকার সোনালি ব্যাংকে আমার দুই কোটি টাকার বন্ড আছে। সে আমাকে বন্ড দেখায়। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ট্যাক্সি চালিয়ে তুমি এত টাকা জমাল কীভাবে। সে বলল, ওই যে কষ্ট করে চলেছি। আমেরিকায় কাগজ হবে কিনা তার কেনো নিশ্চয়তা আছে। যত পেরেছি টাকা কামাই করেছি। আমার বন্ধু জালাল এখন বাংলাদেশে রিয়েল স্টেটের ব্যবসা করছে। পুরোনো বউ ছেড়ে দিয়ে আবার বিয়ে করেছে। যে বউ আমিরিকায় তার জন্য এত কষ্ট করেছে, তার এখন কানাডায় নিঃসঙ্গ জীবন।
মাঝে মাঝে মনে হয় কানাডায় আসা আমার জীবনের বড় ভুলের একটি। কিন্তু এসেই যখন পড়েছি তখন আর ফেরার পথ নেই। এ হচ্ছে ওয়ান ওয়ে জার্নির মতো। ফেরার পথ খোলা থাকে না। এখানে এসে দেখি আমার মতো লোকদের কোনো দাম নেই। সবাই নিজেকে বিরাট বড় কিছু ভাবে। দেশে সবাই প্রায় জমিদার গোত্রীয় ছিল, এ রকম একটা ভাব। বড় বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লেখক, সাংবাদিক মন মতো পেশা না পেয়ে হতাশায় ভুগছে। কেউ কেউ নিজেই নিজেকে বড় মনে করে সান্ত্বনা খোঁজে। আমি কিছুতেই এই দলে ভিড়তে পারলাম না। আমি মন মরা হয়ে ঘরে বসে থাকি। চাকরির জন্য রেজ্যুমি তৈরি করি। কানাডীয় ইংরেজি শিখতে লিংক স্কুলে যাই। রেজ্যুমি পাঠাই। কেউ উত্তর দেয় না। বন্ধুরা বলে এভাবে হবে না। কীভাবে হবে তাও বলে না।
২.
কানাডায় পা রেখে এখানকার ভাব সাব দেখে মনে করলাম এত তাড়াহুড়োর কী আছে। আস্তে ধীরে কাজে নামি। হাতেতো টাকা আছেই। ইউএস ডলার ভাঙিয়ে বাজার করি, ফার্নিচার কিনি আর বাড়ি বাড়া দিই। এভাবে তাইরে-নাইরে করে সময় পার হয়। দেশের টাকা দিয়ে আর কতকাল চলে। আমার স্ত্রী কিন্তু বসে থাকেনি। সে স্মার্ট মেয়ে। আমার চেয়ে বুদ্ধিমান। এ দেশে পা রেখেই বাতাস বুঝতে পারল। আমিই বুঝিনি। দুই মাসের মাথায় সে একটা কাজ জুটিয়ে ফেলল। কারও কোনো হেল্প ছাড়াই। এ দেশে মেয়েদের কাজের যত সুযোগ ছেলেদের তত নয়।
আমার স্ত্রী কাজে লেগে গেল। আমারই কাজ হয় না। এ দেশে কত জনইতো দামি গাড়ি চালাচ্ছে, বাড়ি আছে। স্কুলের গণ্ডিও পেরোয়নি কিন্তু ঠাস ঠাস ইংরেজি বলছে। কেউ কেউ আছে যারা কখনো ঢাকা শহরই দেখেনি তারাও বলে গুলশানে বাড়ি ছিল। এখানে যার যা খুশি তাই বলে চালিয়ে নেয়। কেউ বাধা দেওয়ার নাই। এ রকম পরিস্থিতিতে আমার স্ত্রী দ্রুত খাপ খাইয়ে নিল। আমিই পারিনি।
প্রথম বছর যে কিছুই করিনি সেটা বললে ভুল হবে। প্রথম তিন মাসের মাথায় ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে নিলাম। অটো ট্রেডে গাড়ির দাম দেখি কিন্তু গাড়ি আর কেনা হয় না। প্রথম কিছুদিন মহা উৎসাহে জীবনবৃত্তান্ত, এখানকার মানুষেরা বলে রেজ্যুমি সেটি তৈরিতে লেগে গেলাম। নেবারহুড অফিসে যাই। সবকিছু ফ্রি। জব কর্মশালায় নেটওয়ার্কিংয়ের কথা বলে। রেজ্যুমি তৈরি করে দেয়। অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি হয়। ফ্রি ইএসএল ক্লাস করা যায়। সব ঠিকঠাক আছে। কিন্তু আসল যেটা দরকার চাকরি সেটা আর হয় না। পরে জানলাম কানাডায় চাকরি পেতে হলে তিনটা জিনিস লাগবে। এক অভিজ্ঞতা, দুই এখানকার ডিগ্রি ও তিন রেফারেন্স। আমার এর কোনোটাই নাই। সুতরাং আমি যে ধরনের চাকরি খুঁজি তা পাওয়ার কেনো সম্ভাবনা নেই।
একদিন করলাম কী, এক ব্রেড ফ্যাক্টরিতে গেলাম কাজে। আমার বাসা থেকে বাসে যেতে লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। কে যেন একজন আমাকে রেফার করেছিল। সুপারভাইজার তখনই কাজে লাগিয়ে দিল। সুপারভাইাজার ছিল পাকিস্তানি। পাকিদের আন্ডারে কাজ করতে হবে ভেবেই দমে গেলাম। নয় মাস যুদ্ধ করে যাদের খেদিয়ে বিদায় করেছি তাদের আন্ডারে কীভাবে কাজ করি! ঘণ্টাখানেক পরেই ওখান থেকে বিদায় হলাম। আর কোনোদিন ওই ফ্যাক্টরিতে কাজের জন্য যাইনি।
তবে সেদিনের একটা ঘটনার কথা মানে আছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি বাসস্ট্যান্ডে। আরও একটা লোক বাসের অপেক্ষায়। বোঝা যায় এশিয়ান। আমাকে জিজ্ঞেস করে হয়্যার আর ইউ ফ্রম?
আমি বলি বাংলাদেশ।
সে বলে আই অ্যাম ফ্রম পাকিস্তান। আমরা ভাই ভাই।
মনে মনে বলি ধুর আবারও পাকি!
এখানে কোথায় এসেছিলা।
আমি বললাম একটা ফ্যাক্টরিতে কাজে এসেছিলাম কিন্তু ভেরি হার্ড। তাই চলে এসেছি।
হাউ লং ইউ হ্যাভবিন ইন কানাডা?
তিন মাস।
ওকে।
আমি বললাম ইউ!
সে বলল, চৌদ্দ বছর।
দেশে তুমি কি করতা।
আমি বললাম।
সে বলল, তোমাকে একটা কথা বলি মনে রেখ। দিস ইজ কানাডা। এখানে কখনো গায়ে খেটে কাজ করতে যেও না। তোমার মাথা আছে সেটাকে কাজে লাগাও। সেদিন লোকটার কথাটা আমার পছন্দ হয়েছিল।
৩.
কানাডার জীবনের দ্বিতীয় বছর চলছে। একটা গাড়ি কিনে ফেললাম দুম করে। টয়োটা কেমরি। ফাটাফাটি গাড়িটা। ঝকঝকে। লো মাইলেজ। গাড়ি কেনায় খরচ হঠাৎ করে বেড়ে গেল। আমার পুরোনো অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও গাড়ির ইনস্যুরেন্স বাবদ মাসে গুনতে হচ্ছে প্রায় তিন শ ডলার। ফুল কভারেজ, জিরো ডিডাক্টেবল। ইনস্যুরেন্সের ব্যাপারস্যাপার ভালো বোঝা যায় না। বেশি স্মার্ট যারা তারা বোঝে। একই ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে আমেরিকার চেয়ে কানাডায় কয়েক গুন বেশি প্রিমিয়াম দিতে হয়। কোনো মানে হয়! ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে টরন্টোতে কিছুদিন আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে কিন্তু কোনো অ্যাফেক্ট চোখে পড়েনি। ইন্ডিয়ান কমিউনিটি এই আন্দোলন অর্গানাইজ করেছিল। পৃথিবী জুড়েই করপোরেট জায়ান্টদের হাতে ৯৯ ভাগ মানুষের ভাগ্য। অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট যে মুভমেন্ট শুরু করেছে তা ছড়িয়ে পড়ছে। দেখা যাক কোথায় গিয়ে পৌঁছায়।

আমি থাকি টরন্টো। কানাডার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর। বাণিজ্যিক রাজধানী এবং সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর। একটা চাকরির পেছনে যেখানে দশ–বিশ জন ছোটে। একটা চাকরি পাওয়া এখানে মিলিয়ন ডলারের লোটো পাওয়ার সমান। আমি একদিন ডেনফোর্থে একটা রেস্টুরেন্টে আমার এক বন্ধুকে ডাকলাম। চা খাওয়ার জন্য। বাঙালি রেস্টুরেন্ট। ডেনফোর্থ হচ্ছে বাঙালিদের জায়গা। বাংলা ভাষায় অসংখ্য সাইনবোর্ড দেখতে পাওয়া যায়। এটাকে বাংলা টাউন বলা হয়। যারা প্রথম কানাডায় আসে বা যারা ভিজিট করতে আসে এই শহর, ডেনফোর্থ তাদের ভালো লাগে। দূর প্রবাসে বাঙালিদের আনাগোনা হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো মনে হবে।
আমার বন্ধু আলাল। সুইস বেকারিতে বসে আমরা চা আর পিঁয়াজি খাচ্ছি। অনেকে অবশ্য ডেনফোর্থের নাম শুনলে আঁতকে ওঠে বা নাক সিটকায়। যেখানে বাঙালি সেখানেই নাকি দলাদলি। অনেকে দলাদলির শিকারও হয়েছে। আবার যারা একটু সৈয়দ বংশীয় তারা ডেনফোর্থ অ্যাভোয়েট করে। যারা দেশ থেকে টাকা পয়সা পাচার করেছে তারা থাকে আলাদা। লোকালয়ে আসে না তারা।
আলাল ভাই, এ ভাবেতো চলে না।
কেন কি হইছে!
এই দেখেন না তেমন কিছু কাজবাজ পাইতেছি না। ভাল্লাগে না ভাই। একটা ফ্রাস্টেশনের মধ্যে আছি।
হবে হবে। এত হতাশ হওয়ার কিছু নাই।
দেখেন না বছর পার হতে চলল। মনমতো কোনো কাজ পাই না।
সবারই সময় লাগে। কত ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার–এমবিএ–সাংবাদিক ঘুইরা বেড়াইতেছে। যে যা পারছে করতেছে। সারভাইভতো করতে হইবে।
আলাল ভাই দেশ ছেড়ে মানুষ কেন আসে!
আলাল ভাই হাসলেন। খুব ভালো মানুষ আলাল ভাই। খুব পজিটিভ। কাউকে হতাশ করেন না। সাহস দিতে পারেন।
এক কাজ করেন, গাড়িতো কিনেছেন। আপাতত পিৎজা ডেলিভারি করেন। পারবেন না! কাজ সোজা।
আমি হাসি। দুঃখে।
তবে সমস্যাও আছে।
কি সমস্যা!
ডেলিভারি করতে হলে গন্ডারের চামড়া হইতে হইবে। আর প্রচুর ট্রাফিক টিকিট খাইতে হইবে।
আমি চুপ করে শুনি।
পারব না আলাল ভাই।
তা না হলে স্কুলে যান। যে লোন পাবেন তা দিয়ে ভালোমতো চলতে পারবেন।
আমি আলাল ভাইয়ের কথা শুনে খুব ভরসা পেলাম না।
৪.
আমি দেখেছি বিদেশে আসলেই কিছু মানুষ কেমন বদলে যায়। আমার বন্ধুরাই বদলে গেছে। চেহারা পাল্টে ফেলে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, সত্যি কথা বলে না। একটা হাইড করার মানসিকতা। ফোন করলে ফোন ধরে না। ব্যস্ত না থাকলেও বলে ব্যস্ত আছি। আবার কাউকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করানোও যায় না। সেই স্বাধীনতা এখানে নিশ্চিত করা আছে। এসবের কারণও আছে। কেউই আসলে নিজের মতো করে জীবনটা সাজাতে পারে না। যে জীবন ফেলে এসেছে ঠিক সেই রকম একটা জীবন পাওয়া যায় না। তাই মানুষ যা পায় তাই আঁকড়ে ধরতে চায়। একদিন আমিও ওরকম হয়ে যাব।
সেদিন একজন বন্ধু আমাকে বলল, তুমি এসব কি লেখ!
আমি বললাম কেন কি হয়েছে।
একজন তোমার ওপর খুব খেপেছে।
কেন খ্যাপার কি হয়েছে!
তুমি এখানকার চাকরি বাকরি নিয়ে কি সব লিখছ!
আমি তার নাম জানতে চাইলাম। বন্ধু নাম বলল।
আমি দেশে থাকতে এই সাংবাদিকের নাম কস্মিনকালেও শুনিনি। এখানে এসে অনেক কিছুই শুনছি, দেখছি। বিদেশে না আসলে অনেক কিছু চেনা যায় না।
আসলে মানুষ খুব অনিরাপদ এই পৃথিবীতে। নিরাপত্তার জন্য সে সব করতে পারে। কিছু মানুষ কমপ্লেক্সে ভোগে। কিছুতেই সে সত্যিকে মেনে নিতে পারে না। আমাদের দেশটা এতই ছোট যে আমরা কে কী ছিলাম, কে কী হয়েছি সবাই সেটা জানে। সবাই যে তালগাছ হবে বা সবাই সব করতে পারবে এটা মনে করার কেনো কারণ নেই। এ জন্য কেউ তুচ্ছ হয়ে যায় না।
আজহার আমার এখন বন্ধু। আজাহারের মতো লোক বেশি একটা দেখা যায় না। আমার সমান বয়স হবে। আজাহারের বিদেশ জীবন প্রায় ১৭ বছরের। ১০ বছর কাটিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। দামি একটা হোটেলের শেফ ছিল। অথচ আজাহার এক লাইন ইংরেজি লিখতে পারে না। কিন্তু ইংরেজি বলতে পারে ভালো। ইংরেজি না লিখতে পারলেও যারা পারে তাদের ব্যবহার করে সে তার কাজ করিয়ে নিয়েছে। স্মার্ট লোক। সাহসী। রিস্ক টেকার।
কি করছেন এখন ভাই!
তেমন কিছু না। টুকটাক কাজ।
কেন!
ভালো কিছু পাচ্ছি কই!
কি বলেন ভাই!
সত্যি আজহার ভাই।
শোনেন দেশে আপনার যতই লেখাপড়া থাক আপনি এত সহজে ভালো জব পাবেন না। এটা আপনাকে মেনে নিতে হবে। গাধার খাটুনি খাটতে পারলে ঠিক আছে। নইলে না। আমাকে দেখেন না সাত দিন কাজ করি। নিজের কাজ নিজে করি। কোনো লজ্জা নাই। ভাইরে খামোখাই কানাডা সরকার শিক্ষিত লোকগুলোকে এনে কষ্ট দিচ্ছে। কানাডা দাবি করতে পারে তাদের দেশে সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত লেবার। আপনাদের মতো লোকেরা প্রথম কিছুই করতে চায় না। খালি নাক সিটকায়। পরে অবশ্য সবই করে। পেটে খিদে মুখে লাজ থাকলেতো হবে না।
আপনারতো নিজের ব্যবসা। চিন্তার কিছু নাই।
আরে ভাই সাত দিন কাজ করি।
তাও ভালো।
ব্যবসা কঠিন আছে এ দেশে।
সহজ কি।
ডেলিভারি করবেন। এটাই সহজ। কিছু বাড়তি আয় হলো।
কখনো করিনি যে।
ট্রাই করে দেখেন। না পারলে নাই।
আমি রাজি হলাম। দেখাই যাক না ব্যাপারটা কী।
প্রথম দিন চারটা ডেলিভারি করলাম। খুব ভয় হচ্ছিল। আমার সব সময় যেটা হয় রাস্তা হারানোর ভয় থাকে। প্রথম দিন তিনটা ডেলিভারি করতে গিয়ে তিনবারই রাস্তা ভুল। যদিও ডেলিভারিতে বের হওয়ার সময় পই পই করে ঠিকানা দেখে নিয়েছি কিন্তু তাও রাস্তা ভুল। সবগুলো ডেলিভারি পৌঁছতে দেরি হয়। চতুর্থ ও শেষ ডেলিভারিতে ঘটল ঘটনাটা। বাইরে তখন তুষার পড়ছিল। সেটা ডিসেম্বর মাস। কনকনে ঠান্ডাও পড়ে গেছে। আমি গাড়ি পার্ক করে গেলাম ডেলিভারিতে। বেশি দেরি হয়নি। এসে দেখি একটা হলুদ প্রিন্টেড কাগজ ড্যাশবোর্ডে আটকানো। মানে কি। কাগজটা খুলে দেখি টিকিট। ৬০ ডলারের পার্কিং টিকিট। ভুল জায়গায় পার্ক করেছি। কানাডায় প্রথম টিকিট!
৫.

দুনিয়ার আজব সব মানুষের সমাহার ঘটেছে এখানে। টরন্টোকে বলা হয় মাল্টিকালচারাল জায়গা। কিন্তু অন্য দেশের কথা বাদ দিলেও বাঙালিদের মধ্যেও বিচিত্র সব মানুষ দেখা যায়।
আমরা যাচ্ছিলাম গাড়ি দিয়ে। দীর্ঘ সামার ভ্যাকেশনের পর স্কুল খুলেছে গত সপ্তাহে। আজকে রোববার। আমরা যাচ্ছি এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে। এখানকার বাসাবাড়ির দাওয়াতগুলো খুব বোরিং। রাজ্যের খাওয়া দাওয়া ছাড়া আর তেমন কিছু নাই। কেউ কেউ কেটারিং করে এনে দাওয়াত খাওয়ায়। কিছু গালগপ্প চলার পর দশটা বাজলেই যে যার বাড়ির দিকে রওনা দেয়। পরের দিন বাচ্চা কাচ্চা থাকলে স্কুল। সকাল সকাল উঠতে হয়। কিছু দাওয়াতের আয়োজন করা হয় শুধু ফেসবুকে ছবি দেওয়ার জন্য।
আজকে যে বাসায় যাচ্ছি সে একজন সিঙ্গেল নারী। সরকারি বাসায় থাকে। এ দেশের সরকারি বাসা মানে হচ্ছে সাবসিডাইসড হাউস। যদি সে কাজ করে তাহলে আয়ের তিরিশ ভাগ ভাড়া দিতে হয়। সিঙ্গেল নারীদের সরকারি বাসা পাওয়া প্রায়োরিটি। একাকী জীবনে সে বেশ হ্যাপি। প্রচুর রাঁধে এবং আয়েশ করে খায়। শরীর স্বাস্থ্য দেখলেই বোঝা যায় খাওয়াটা সে বেশ এনজয় করে। মাঝে মাঝে দাওয়াত দেয়। নিজের নিঃসঙ্গতা ঘুচানোর সামান্য চেষ্টা। নাম তার নাসরিন।
নাসরিন কানাডায় এসেছিল স্বামী–সন্তানসহ। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বামীকে অপছন্দ হতে শুরু করল। কারণ স্বামী স্মার্ট না। তাই এক সুন্দর সকালে স্বামীকে বলল, গুডবাই। এখানে ডিভোর্স নেওয়া ডালভাত। মাত্র তিন শ ডলার খরচ করলেই ঝামেলা মিটে যায়। স্বামী তো বিদায় হলো। স্বামীর নামে বরাদ্দ সরকারি বাড়িটা পেয়ে গেল নাসরিন। মহাআনন্দ। এখন সন্তানের কী হবে! একটা আপদের মতো ব্যাপার। স্বাধীনতা নষ্ট হয় না! তাই ছোট্ট শিশু সন্তানকে দেশে বাপ–মায়ের কাছে পাচার করে দিল। এখন সুখের ওপর বারো আনা সুখ। সেই থেকে বহু বছর একা একাই চলছিল। কিন্তু সুখ বেশিদিন ভালো লাগল না। আবার দেশে গিয়ে আস্ত একটা পুরুষকে বিয়ে করল। তাও বছর তিনেক গড়িয়েছে। স্বামী বেচারা কানাডা আসার জন্য পথ চেয়ে আছে কিন্তু এখনো আসা হয়ে ওঠেনি। আজকাল অবশ্য যখন-তখন বিয়ে ভেঙে আর একটা বিয়ে করে এ দেশে নিয়ে আসার ব্যাপারে সরকার বেশ কঠোর।
তবে নাসরিন মেয়েটিকে আমি পছন্দ করি কারণ সে প্রায় প্রায় দাওয়াত দেয় ও প্রচুর ঝাল দিয়ে তরকারী রাঁধে। খেতে বসলে চোখের জলে নাকের জলে একাকার হতে হয়। তার রান্নার হাত ভালো। অবসরে সে গল্পের বই পড়ে, নাটক দেখে, দেশে কথা বলে স্বামীর সঙ্গে।
যাহোক, সেনেকা কলেজে দুই সেমিস্টারের একটা কোর্স করলাম। গত প্রায় আট মাস পড়াশোনা নিয়ে এমনই ব্যস্ত ছিলাম যে অন্য কিছু ভাবার সময় হয়নি। এখন আমার কাজ হচ্ছে নিরলস রেজ্যুমি পাঠানো। আমি জানি কানাডায় চাকরি পাওয়া এত সহজ হবে না। আমি যে বিষয়ে ডিপ্লোমা করেছি সেটা হচ্ছে করপোরেট কমিউনিকেশন অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস। এখন সবাই বলছে এই ফিল্ডে চাকরি নাই। সবাই বলে পড়ে কিছু হয় না।
আমি আমেরিকা, মিডলইস্ট এসব জায়গায় রেজ্যুমি পাঠিয়েছি। মিডলইস্ট থেকে ইতিমধ্যে কয়েকটা ইন্টারভিউয়ের জন্য চিঠি এসেছে। কিন্তু যাওয়া হবে না। ফ্যামিলি রেখে কোথাও যাওয়ার কেনো ইচ্ছা নাই। তারপরও পাঠিয়েছিলাম। আমেরিকায় হলে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেটাও এত সহজ হওয়ার কথা না। আমেরিকার চাকরির বাজার আগের মতো নাই। এদিকে কিছুদিনের মধ্যেই লোন শোধ করা শুরু করতে হবে। এখন আমার কিছু একটা করা দরকার।
আবার কাজের সন্ধানে বের হতে হচ্ছে। অনেক কিছু ভাবি এটা করব ওটা করব। কিন্তু কোনো কিছুই এত সহজ না। কেউ কোনো পরামর্শও দিতে পারে না। আমি যে বিষয়ে দেশে কাজ করেছি সে বিষয়ে এখানে কেনো কাজ নেই। তাই আমাকে চলার জন্য কিছু একটা বেছে নিতে হবে। যে কোনো কিছু। আমি ইচ্ছে করলেই একটা ফ্যাক্টরি জব করতে পারি। আমার সেই শক্তি আমার আছে। কিন্তু কেন যেন ইচ্ছে করে না। সেই পাকিস্তানি লোকটার কথা মনে পড়ে। সে বলেছিল মাথাটা কাজে লাগাতে। কিন্তু মাথাটা কাজে লাগাবটা কোথায় সেটাই মাথায় ঢুকছে না।
করপোরেট কমিউনিকেশন না পড়ে আমার উচিত ছিল ট্যাক্সি ড্রাইভিং বা রিয়েল স্টেটের ওপর কোনো কোর্স করা। অথবা টেকনিক্যাল কিছু। এসব কিছু না করে কি আমি ভুল করেছি। রিয়েল এস্টেট যারা করছে তারাও মাছি মারছে। একটা বড়ি বিক্রি করতে হালুয়া টাইট হয়ে যাচ্ছে। একসময় খুব ড্রাইভিং ইনস্ট্রাক্টর হওয়ারও খায়েশ হয়েছিল যখন আমি গাড়ি চালানোর দীক্ষা নিই। ঘণ্টায় ২৫ ডলার। বাড়ির কাছে। কেউ কেউ আছে প্রথম রোড টেস্ট দিতে গিয়ে পঁচিশ–তিরিশটা লেশন নেয়। তারপরও ফেল করে, আবার লেশন নেয়। ইনস্ট্রাক্টরদের পোয়াবারো। একবার রোড টেস্ট দিতে নিয়ে গেলেই দু শ ডলার অতিরিক্ত দিতে হয়।
আপাতত আমার সারভাইভ করার জন্য কাজ দরকার।
একদিন সকালের দিকে বের হলাম। কাজের সন্ধানে। এগলিংটন অ্যাভিনিউ দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা পিৎজার দোকান। এর আগেও আমি পিৎজার দোকানে কাজ করেছি। মনে করলাম যাই। দেখি কথা বলি গিয়ে। কাজটা আমি করতে পারব। যদি কাজ থাকে। আমেরিকান ফ্রানচাইজি। একটা সাধারণ রেজ্যুমি আমার সঙ্গেই থাকে। গিয়ে দেখি একজন কালো মতো লম্বাচোরা যুবক কাজ করছে।
হ্যালো।
সে বলল, হাই।
আমি কাজ খুঁজছি। তোমাদের কি লোক লাগবে!
ছেলেটি বলল, এখনতো ম্যানেজার বা মালিক নাই, তুমি পরে আস।
আমি বললাম, ওকে।
সে বলল, তুমি কি রেজ্যুমি নিয়ে এসেছ!
হু।
তাহলে রেখে যাও।
আমি রেজ্যুমি রেখে আসলাম।
এর দিন তিনেক পর আমাকে কল করল। আমি সেই শ্রীলঙ্কান যুবকটির প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ করলাম। কাজ হোক না হোক সে আমার রেজ্যুমি যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। অনেকেই রেজ্যুমি রাখে তারপর ফেলে দেয়। আমি গেলাম। দুপুরের দিকে।
যিনি মালিক তার সঙ্গে কথা হলো। তিনি পরদিনই আমাকে কাজ শুরু করতে বললেন। মালিক ভদ্রলোকটিকে আমার খুব পছন্দ হলো। শান্তশিষ্ট মানুষ। আস্তে আস্তে কথা বলেন। সন্ধ্যার শিফটের ম্যানেজার যিনি তিনিও উপস্থিত ছিলেন। তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। তাকেও ভালো লোক মনে হলো। রাশিয়ান।
৬.
কানাডা এসে শুনলাম সিকিউরিটি জব নাকি ফাটাফাটি আরামের। আমি তাহলে বসে আছি কেন। কি করতে হবে। ট্রেনিং নিতে হবে। পকেটে তখনো অনেক টাকা। ট্রেনিং করলাম। প্রায় এক মাসের ট্রেনিং। ফার্স্ট এইড থেকে শুরু করে সব শেখানো হলো। সতেরো শ ডলার নেমে গেল। যেদিন গ্র্যাজুয়েশন সেদিনই অন স্পট একটা সিকিউরিটি কোম্পানির লোকজন এসে আমাদের কয়েকজনকে হায়ার করল। আমি খুশিতে ডগমগ। পরের দিনই রিপোর্ট ও পোস্টিং। সেটা ২০০৩ সালের কথা।
আমাকে কাজ দিল রাতে। রাত এগারোটা থেকে ভোর সাতটা পর্যন্ত। কাজের জায়গাটার নাম হচ্ছে কানাটা। আমার এক বন্ধুকে বললাম। বন্ধু বলল, তোমাকে আমি ওখানে পৌঁছে দেব। চিন্তা করো না। রাতের ডিউটি বলে একটা ফ্লাশলাইট কিনতে হলো। কিছু খাবার দিয়ে দিল স্ত্রী যদি খিদে পায়! আমার রাত বাড়লেই খিদে বাড়তে থাকে। যদি ঘুম পায় তাহলে কী হবে! একটা ফ্লাস্ক কিনলাম। স্ত্রী চা দিয়ে দিল। আমি যাতে কাজটা করতে পারি তার সব আয়োজনই সম্পন্ন হলো।
কাজের জায়গাটা আমার বাসা থেকে গাড়িতেই এক ঘণ্টার ড্রাইভ। আমি শুরুতেই ভড়কে গেলাম। ঘটনাস্থলে পৌঁছে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। কেমন বিরান একটা জায়গা। চারদিকে তেমন কিছু স্থাপনা নাই। একটা গাড়ি ফ্যাক্টরির কাজ চলছে। কিয়া কোম্পানির গাড়ি। কোরিয়ান। সেখানে রাতভর ডিউটি। কোনো শেড নাই। শুধু একটা পুরোনো গাড়ি পড়ে আছে। রাতে প্রয়োজনে সেটার মধ্যে ঢুকে পড়া যাবে। সময়টা ছিল অক্টোবর মাস। রাতে যদি ঠান্ডা লাগে তাহলে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে হিটিং চলানো যাবে। আগের শিফটের যে লোকটি ছিল সেই সব বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় আমার চেহারার অবস্থা দেখে বলল, ডোন্টওরি ম্যান! টেক ইট ইজি। আমরা একসঙ্গেই ট্রেনিং করেছিলাম। ইয়েমেনি লোকটা।
আমি আমার বন্ধুকে বললাম, আমি এই কাজটা করতে চাই না।
সে বলল, এখন এসব বললে তো হবে না।
তোমার ফোন দিয়ে একটা ফোন কর সুপারভাইজারকে। আমার তখনো কোনো সেল ফোন নাই। চার মাস হয় এসেছি। এসব কাজে একটা সেল ফোন থাকা খুব জরুরি।
আরে পাগল কিছু হবে না। সবাই করছে না! আমাকে বুঝিয়ে টুঝিয়ে বন্ধু চলে গেল।
আমি সিকিউরিটির চাকরি শুরু করে দিলাম। নিয়মকানুন সব জানাই আছে। রাত যত গভীর হতে লাগল ততই বাড়ির কথা মনে পড়তে লাগল। আমি একটু একটু নিঃসঙ্গবোধ করতে লাগলাম। একটু কী ভয়ও পাচ্ছি। চারদিকে কেমন সুনসান নীরবতা। দূরের রাস্তায় হুসহাস একটা দুটো গাড়ি যাচ্ছে। কোনো জনমানুষ চোখে পড়ছে না। অনেক দুরে একটা টিম হর্টনস দেখা যাচ্ছে। কফি শপ। কানাডার সবচেয়ে জনপ্রিয় কফি। মনে হয় চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। এটা ভেবে একটু সাহস পাচ্ছি। যদিও এখানে আমাকে মেরে পুতে ফেললেও কেউ টের পাবে না, তা সত্ত্বেও দূরের আলো দেখে ভালো লাগছে। যদিও আমার হাতে একটা ওয়াকিটকি আছে। সেটা দিয়ে কন্ট্রোলরুমে কথা বলা যায়। বা আমি জেগে আছি কিনা এটা চেক করার জন্য মাঝে মাঝে কথা বলে ওঠে ও প্রান্ত থেকে।
আমি রাত জাগতে পারি না। একটা পুরো রাত জাগলে সেটা কভার করতে আমাকে তিন চার দিন ঘুমোতে হয়। আজকে আমাকে রাতভর ডিউটি করতে হবে। শুরু হলো ডিউটি। মাঝে মাঝে আবিষ্কার করি আমি ঘুমোচ্ছি। গাড়িটার মধ্যে জবু থবু হয়ে বসে। কিছু করার নেই। এভাবে সকাল হলো। প্রথম সকাল। সাতটায় একজন এল ডিউটিতে। তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে আমি বাসে করে সকাল নয়টায় ঘরে পৌঁছলাম।
চতুর্থ রাতে ঘটনাটা ঘটল। মধ্যরাতে আমি গাড়ির মধ্যে ঘুমিয়ে আছি। আমি গল্পের বই নিয়ে আসতাম। গাড়ির স্বল্প আলোয় বই পড়ি। বই পড়তে পড়তেই মরণ ঘুমটা এসেছিল। এদিকে আমার ওয়াকিটকি বেজে যাচ্ছে। আমি এমনই গভীর ঘুমে ডুবে গেছি যে কিছু শুনতে পাচ্ছি না। হঠাৎ আমি আবিষ্কার করলাম কে একজন আমার গাড়ির দরজায় টোকা মারছে। আমি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। সুপারভাইজার। সে আমাকে ওয়াকটকিতে না পেয়ে ছুটে এসেছে।
সে বলল, তুমি ঘুমোচ্ছিলে! আমিতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম কিনা কি।
আমি থতমত খেয়ে বললাম না মানে...। সে আর বেশি কিছু না চলে গেল।
পরের দিন সকালে আমার বাসায় যাওয়ার কেনো বাস নাই। কারণ এই এলাকায় রোববার কোনো বাস চলে না। কনস্ট্রাকশনের লোকজন এসে গেছে। তাদের একজনকে রিকোয়েস্ট করে একটা ফোন করালাম আমার সুপারভাইজারকে। তারা গাড়ি পাঠিয়ে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিল। মাত্র এক সপ্তাহ করলাম প্রথম চাকরিটা।
এ দেশে এসে শুনেছি হায়ার অ্যান্ড ফায়ার কোনো ঘটনা না। আবার অনেকে বলে এ দেশে থ্রি ডব্লিউর কোনো বিশ্বাস নেই। থ্রি ডব্লিউ হচ্ছে ওয়েদার, উইমেন ও ওয়ার্ক। তবুও আমি একটু নির্ভার হলাম।
৭.
আমাদের বিল্ডিংয়ে সিকিউরিটির চাকরি করে একজন বাঙালি। তার নাম হামিদ। এই কোম্পানির অনেক বিল্ডিং আছে। হামিদ রাতে সিকিউরিটি দিনে ট্যাক্সি চালায়। একজন মানুষ কীভাবে রাতদিন কাজ করে আমি বুঝে পাই না। হামিদের সঙ্গে আমার বেশ একটা ভাব হয়ে যায়।
আচ্ছা হামিদ ভাই আপনি রাতদিন কীভাবে কাজ করেন!
সে বলল, সিকিউরিটি কাজ এত হার্ড না।
আমি তাকে আমার পুরোনো সিকিউরিটি চাকরির কাহিনি শোনালাম।
সে শুনে হাসল। বলল, আমাদের এখানে লোক নেবে, আপনি করবেন! করলে আপনার কথা বলতে পারি। যেহেতু আপনার ট্রেনিং করা আছে, অসুবিধা হবে না।
মনে মনে ভাবলাম আবার সিকিউরিটি!
আমি বললাম, ঠিক আছে। আচ্ছা হামিদ ভাই আপনার রাতে ঘুম পায় না! আমিতো রাত জাগতে পারি না।
সে হেসে বলল, ঘুম পেলে ঘুমাবেন!
কীভাবে!
আমাকে দেখেন আমি ঘুমাই, কিন্তু কেউ বুঝতে পারে না।
কায়দাটা কি!
বসে বসে ঘুমাই। অভ্যাস করে নিয়েছি।

আমি দেখলাম হামিদ ভাইয়ের চোখ লাল। হয়তো আমি আসার আগে ঘুমোচ্ছিল বেচারা! কালকে সকালেই তাকে ট্যাক্সি নিয়ে বের হতে হবে। সারা দিন ট্যাক্সি চালিয়ে আবার আসবে সিকিউরিটি জবে।
হামিদ ভাই কথা রেখেছেন। বেশির ভাগ বাঙালিই কথা দিয়ে কথা রাখে না। বলে একটা করে আর একটা।
আমাকে সিকিউরিটি জবের জন্য আবার ডাকা হলো। কালকে পরীক্ষা। পরীক্ষা জিনিসটা আমি খুব ভয় পাই। আমি জানি পরীক্ষা হলেই আমি নিশ্চিত ফেল মারব।
একটায় গিয়ে পৌঁছলাম। আমরা দুজন। অন্যজনও বাঙালি। খ্রিষ্টান। মনে একটু বল ভরসা পেলাম। পরীক্ষায় অনেক মাল্টিপল প্রশ্ন থাকল। দুজনে ভাগাভাগি করে শেষ করলাম। চাকরি হয়ে গেল। আমার বাসা থেকে পনেরো মিনিটের ড্রাইভ। মাউন্টপেজেন্ট অ্যান্ড এরস্কিন। কনসিয়ারেজ বলে এটাকে। অর্থাৎ অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং বা কনডোমোনিয়ামের ফ্রন্ট ডেস্কে বসে থাকো। আগেরটার চেয়ে মাচ বেটার। কিন্তু এবারও রাতে। রাত আটটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত। মাঝখানে এক ঘণ্টার ব্রেক। ইয়ারলি স্যালারি। খারাপ না। শুধু ঘণ্টায় ঘণ্টায় পেট্রল দেওয়া। এত হার্ড না। কিন্তু এক সপ্তাহ করার পর এটাও ভালো লাগল না। কোনো কিছুতে লেগে থাকাটাই কঠিন আমার জন্য। কোনো কিছুতেই বেশিদিন কনসেনট্রেট করতে পারি না। আবার অনিশ্চয়তা।
(লেখকের ইমেইল: jasim.mallik@gmail.com)