অভিভাবকত্বের শাসনে মোড়া শিশু নির্যাতন

লেখিকা
লেখিকা

ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল একটি ভিডিও দেখে। সিরিয়াসলি? ছোটবেলা এমন হয় কারও? এমন জঘন্য শাসনে মাখা আমাদের ছোটবেলা? নাহ, আমি জানি আমার মতো কিছু কিছু মানুষের ছোটবেলা এমন ছিল না।

কিন্তু জানতে ভুল হলো না (যদিও এই ভিডিওচিত্র আমাদের বাংলাদেশের নয়), যখন দেখতে পেলাম বাংলাদেশের কেউ কেউ এই অমানবিক শাসনের মাঝে নাকি নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। কেউ বলছে খুব হাসি পাচ্ছে। কেউবা বলছে মাকে মেনশন করতে পারতাম যদি! এমন ছোটবেলা নাকি অনেকের ছিল।
শিশুরা যে এই সব ভুলেও ভোলে না, ভিডিওচিত্রটি দেখে নিজের অতীত মনে করা মন্তব্যকারীরাই তো তার প্রমাণ। এই শিশুটির আতঙ্কিত অবয়ব, ভুলে যাওয়া শব্দমালা, কি বলে? সে কি কোনো বন্য প্রাণীর খাঁচাতে আটকা পড়েছে নাকি সে আটকা পড়েছে শিক্ষার নামে অশিক্ষার মোড়কে বাঁধা স্বজনের কাছে?
ভিডিওচিত্রে প্রথমে শিশুটি কিন্তু বিনয়ী ছিল। ভয়জনিত কারণে ‘দুই’ শনাক্ত করতে যে ভুল হচ্ছিল তার জন্য মা কিংবা সামনের মানুষটির কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাচ্ছিল। এত করুণ করে বলছিল—‘কুচ বি নেহি হে।’ এর মূল্যায়ন তার মা করেনি বরং চড় দিয়েছে এবং সবশেষে শিশুটির এগ্রেসিভ অভিব্যক্তি। প্রতিশোধপরায়ণতা। দাঁতে দাঁত চেপে কথা বলা কি এই বলে না, বুকের গভীরে গেঁথে যাওয়া এই টর্চার। হ্যাঁ, আমি টর্চারই বলব। এই টর্চার ভবিষ্যতে তার হাত ধরে আসা ভবিষ্যতের শিশুর জন্যও প্রোথিত করছে সে? খুব কমসংখ্যক শিশুই বড় হয়ে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া খারাপ ঘটনার থেকে শিক্ষা নিয়ে বিপরীতমুখী ভালো আচরণ করে। অন্যথায় শাসনের এই ধরন দিনশেষে তারও হয় বাজেয়াপ্ত।
এটা কেমনতর শাসন? এটা শাসন নয়, চাইল্ড অ্যাবিউজ। চাইল্ড অ্যাবিউজ ফিজিক্যাল, ইমোশনাল ও Sexual হয়। বাচ্চা Neglect–এর শিকারও হয়। আশপাশের মানুষরূপী অমানুষ তো বটেই স্বয়ং মা–বাবার কাছেও চাইল্ড অ্যাবিউজ হওয়া শিশু রিস্ক ফ্যাক্টরের পাঁচ নম্বরেই। Parents were abused. বাকি চার—First born, single parent, stepchild, disabled child. আমি সাধারণত মুখ পঞ্জির স্রোতে ভাসা বিষয়বস্তু নিয়ে কথা বলি না। কিন্তু এই ভিডিওটি দেখে সেই বাঁধ ভাঙল।
ভাবনাতে আপন ছোটবেলারও জোয়ার এল। এমন নির্মম শাসন আমার আম্মু–আব্বু আমাদের কক্ষনো করেননি। এই জীবনে কক্ষনো মারেননি। পড়াশোনার জন্য অমন জোরপূর্বক শাসন করেননি। করেননি বলেই হয়তো পড়ালেখা বিষয়টা আমার কাছে আজও আনন্দের। আজও স্বস্তির। আজও আত্মবিশ্বাসের। আজও উঠোনখোলা স্নিগ্ধ হাওয়ার। হ্যাঁ, হয়তো কথিত অনেক কিছুই হইনি, কিন্তু মিষ্টি একটা শৈশবের মালিক তো হয়েছি!
কোন বিশ্বাসে জানি না, আব্বু–আম্মু নামের এই দুজন মানুষ কখনোই আমাদের ওপর শর্ত আরোপ করেননি। বলেননি তোমাদের এই হতে হবে, সেই হতে হবে—নইলে আমাদের মান–সম্মান–ইজ্জত সব যাবে। হ্যাঁ, অন্যায় করলে, খারাপ করলে কিছুটা নীরব থেকেছেন, সেই নীরবতায় ছিল শাস্তি। আর শাস্তিকালে নীরবতার অন্য অর্থ সেলফ রিয়ালাইজেশন। আত্ম–উপলব্ধি। অপরদিকে যখন তাদের অপ্রকাশিত প্রত্যাশার কাছাকাছি গিয়েছি, তখন তুমুল উৎসাহ দিয়েছেন। কাছে টেনে কপালে চুমু দিয়েছেন। সেই চুমুই ছিল আমাদের পরবর্তীতে কিছু একটা করবার অনুপ্রেরণা। শক্তি।
কিন্তু জানেন, এমন ভয়ানক শাসনের একটা টুকরো আমার কাছেও জমা আছে। যার মাশুল আমি আজও দিচ্ছি। বাংলাদেশে স্কুল–কলেজে শিক্ষকেরা মুখস্থ পড়া বলতে বলেন। মুখস্থ মানে ঠোঁটস্থ-কণ্ঠস্থ। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সিস্টেমটাই এমন। পড়ার বিষয়বস্তু ধারণ না করলেও চলবে কিন্তু ঠোঁটস্থ তোমার হতেই হবে। অতএব স্কুলঘরে দাঁড়িয়ে তা আগাগোড়া দরদর করে ঘামলেও দরদর করে বলে যেতে হবে। ওতে একবিন্দু ভুল হলে সম্মুখে রক্তচক্ষু। সেই যে ভয়, সেই যে আতঙ্ক আমার আজও কাটেনি। যুক্তরাষ্ট্রে মুখস্থ বিদ্যা নেই, আতঙ্ক নেই, তবু শিক্ষকদের অত্যন্ত বন্ধুবৎসল জিজ্ঞাসাতেও আমি হিম হয়ে যায়। সব ভুলে যাই। সব। কেন? আমার এই ভয়ের পেছনে আছে সেই সব রক্তচক্ষু।
জানেন, ছোটবেলার এই সব স্মৃতি মানুষ কখনোই ভোলে না। কখনোই না। কবে মানুষের এই ভুল ভাঙবে, শাসনের ধরন এমন হয় না। এমন অমানবিক না।

*জাহান রিমা: ভ্যালেন্সিয়া কলেজ, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র।