অবশেষে...
বেশ অনেক দিন আগের কথা। ওহাইওর ছোট একটি শহরের একটি পরিবার। সেখানে ছিল দোতলা সুন্দর একটি বাড়ি। তার চারদিকে সবুজ ঘাস, লেকভিউ ছবির মতো সাজানো পরিবেশ। পাশেই ছিল একটি মদের দোকান। সেখানে কিছু মানুষের আনাগোনা থাকত সব সময়। রাত হলে দুরে টিপ টিপ আলো দেখা যায়। পরিবেশটা আরও মায়াময় সুন্দর লাগে। এত সুন্দরের মধ্যে প্রতিদিন একজন গৃহহীন লোক এসে দোকানের সামনেই ফুটপাতে শুয়ে থাকে। সোফিয়া বিরক্ত হয়ে ভাবে।
কেন মানুষ গৃহহীন হয়। ১০ বছর ধরে রাত কাটানো গৃহহীন লোকটি এভাবে দোকানের সামনে ফুটপাতে শুয়ে রাত কাটায়। পরিবেশ বড় অদ্ভুত বিশ্রী লাগে। শীত এলে লোকটিকে দেখা যায় না।
এখানে মানুষের মুখে জানা যায়, শীতের সময় গির্জার ভেতর কিছু কাজের বিনিময়ে সেখানে থাকে। সারা দিন কাজ শেষে সোফিয়া বাড়িতে ফিরে জানালা দিয়ে রাতে বাইরে তাকিয়ে দৃশ্য দেখতে ভালোবাসে। এত সুন্দর মনোরম পরিবেশ চারদিকে!
অথচ গৃহহীন লোকটিকে একদম বেমানান লাগে। সোফিয়ার ইচ্ছা হয়, সে গিয়ে নিষেধ করবে লোকটিকে রাস্তায় থাকতে। সোফিয়া জানালার পর্দা টেনে দেয়, বিরক্ত হয়। অবহেলার মনোভাব লোকটির দিকে। সারা দিন পরিশ্রম করে বাইরের দিকে তাকাতেও রাগ হচ্ছে ওই গৃহহীন মানুষটির কারণে। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। গভীর রাত, সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। সোফিয়াও গভীর ঘুমে।
আজ অনেক খাটাখাটুনি পড়েছে। সোফিয়া তার দুই সন্তান নিয়ে বাড়িতে থাকে। স্বামী আরেকটি বিয়ে করে চলে গেছে অন্য জায়গায়। দুজন ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। সংসার জীবনে এক ছেলে, এক মেয়ে। এই সুখের সংসার এক সময় ভেঙে যায়।
সোফিয়ার স্বামী অন্য মেয়ের প্রেমে পড়ে সোফিয়াকে ডিভোর্স দেয়। এদের ছাড়াছাড়ির কারণ, স্বামীর কাছে সোফিয়া মোটা ও অসুন্দর। তাই ধীরে ধীরে তার প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলে। সারা দিন সোফিয়া সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। নিজের কোনো যত্ন নিতে পারে না। ঘরের সব কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সংসার চালাতে সোফিয়া একটি বৃদ্ধাশ্রমে কাজ নেয়।
ছেলে–মেয়ে নিয়ে ভালোভাবেই চলে যাচ্ছে। সোফিয়ার মন ভেঙে যায়। আর বিয়ে করে না। স্বামী চলে গেলেও সোফিয়া অনেক শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরে দোতলা বাড়িটি কিনেছে। ভেবেছে, জীবনের একটা দিক তার হাতের মুঠোয় থাকলে সে চলতে পারবে। ছেলেমেয়ে নিয়ে একটি বাড়ি। মাথার ওপর ছাদ থাকলে তাদের সময় দিতে পারবে।
এলাকাটি একটু গ্রামের দিকে নিরিবিলি। রাতে মানুষের খুব একটা আনাগোনা নেই। গৃহহীন লোকটিও শুয়ে আছে দোকানের সামনে। হঠাৎ মাঝরাতে একটি আলো এসে হোমলেস মানুষটির চোখে এসে পড়ে। চোখ কচলে দেখতে পায়, সামনেই দোতলা বাড়ির নিচতলার জানালা দিয়ে আগুনের লেলিহান শিখার তাপ তার চোখে এসে পড়ছে। তাই, আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। কোনদিকে না ভেবেই দৌড়ে বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে।
ঘুমন্ত অবস্থায় সোফিয়াকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে জাগিয়ে তোলে। পাশের রুমে সোফিয়ার ছেলে আর মেয়েকে ঘুমন্ত অবস্থায় উদ্ধার করে তাদেরসহ তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। আগুন ছড়িয়ে পড়ে বাড়ির এক রুম থেকে আরেক রুমে। বিকট শব্দে সব যেন পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আসার আগেই গৃহহীন মানুষটি দৌড়ে গিয়ে তাদের পুরো পরিবারের প্রাণ বাঁচায়।
ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন নিভিয়ে গৃহহীন মানুষটিকে খুঁজতে থাকে। দূরে সোফিয়া গৃহহীন মানুষটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। বলতে থাকে, আমাকে ক্ষমা করে দাও। কেন তুমি ক্ষমার কথা বলছ। তোমার ঘর ছিল না বলে আমি অনেক খারাপ চিন্তা করতাম তোমাকে নিয়ে। আজ তাই আমার ঘর আমার হাত থেকে চলে গেছে। যা মানুষ ভাবে, তাই তার কাছে ফিরে আসে। তুমি নিজে গৃহহীন হয়েও আজ আমাকে আর আমার পরিবারকে রক্ষা করেছ। একজন গৃহহীন, সে তার জীবনকে বাজি রেখে এতগুলো জীবন রক্ষা করেছে।
ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা অবাক হয়ে গৃহহীন মানুষটির দিকে এগিয়ে এসে বলে, তুমি হিরো। যাওয়ার আগে সোফিয়াকে বলে যায়, কাল যাতে তাকে নিয়ে অফিসে যায়। এতগুলো প্রাণ রক্ষার জন্য সরকার থেকে তাকে হিরো সম্মাননা দেওয়া হবে। সোফিয়া লজ্জা আর অপমানে কাঁদতে থাকে।
গৃহহীন মানুষটি কাছে এসে বলল, তুমি কেঁদো না। আমি অনেক খুশি আজ তোমাদের বাঁচাতে পেরেছি। সোফিয়া কাঁদছে আর বলছে, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। রাস্তায় শুয়ে থাকতে দেখে তোমাকে কত ছোট ভেবেছি। নোংরা কাপড় আর রাস্তায় শুয়ে থাকতে দেখে তোমাকে মনে মনে কত ঘৃণা করেছি। ভাবিনি, তুমি ফেরেশতা হিসেবে এসেছিল আমার বাড়ির সামনে। যার কারণে আমি আমার পরিবারকে রক্ষা করতে পেরেছি। অথচ এতটি বছর আমি তোমাকে কোনো দিন জিজ্ঞেস করিনি, তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি। তোমাকে সাহায্যের বদলে তোমার অক্ষমতা দেখে ঘৃণা করেছি। তুমি আমাকে আজ শিখিয়ে দিলে, মানুষের কর্মই আসল।
সোফিয়া গৃহহীন মানুষটির হাত চেপে ধরে বলল, কথা দাও আজ থেকে তুমি আমাদের কাছে থাকবে। গৃহহীন লোকটি কথা দেয়, একসঙ্গে তারা থাকবে। বেশ কিছুদিন পর সোফিয়া গৃহহীন মানুষটিকে নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের অফিসে যায়। সেখানে জিজ্ঞেস করা হলো, কেন তুমি গৃহহীন? তোমার এত সুন্দর একটি মন। যে নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে অন্যের জীবন রক্ষা করে, সে তো হিরো। সে তো গৃহহীন হতে পারে না। তোমাকে আজ বলতে হবে, কেন তুমি গৃহহীন?
অতঃপর মানুষটি বলতে শুরু করল। নাইজেরিয়া থেকে সে এসেছে। এ দেশে অবৈধভাবে বসবাসের জন্য তাকে সব সময় কর্তৃপক্ষের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে হয়েছে। প্রমাণ করার কোনো উপযুক্ত কাগজপত্র তার কাছে ছিল না। যে দেশ থেকে এসে আজ গৃহহীন জীবনযাপন করছে, সে দেশের সবার কাছে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ, সে ছিল ফাঁসির আসামি। রাজনৈতিক একটি মিথ্যা মামলায় তাঁকে ফাঁসানো হয়। ফাঁসির দণ্ড হয়। নাইজেরিয়ার কারাগার থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে নিজের জীবন বাঁচাতে। এখানে এসে জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠে।
সে বলতে থাকে, প্রথম প্রথম আশ্রমের সহায়তায় গৃহহীনদের সাহায্যের কাজ হাতে নেয়। একসময় যুক্তরাষ্ট্র সব অবৈধ অভিবাসীকে ধরতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। তখন ভয়ে আর আশ্রমে ফিরে যাওয়া হয়নি। এভাবে গৃহহীনদের সাহায্য করতে করতে নিজেই একসময় গৃহহীন হয়ে পড়ে। এ দেশে স্থায়ী কাগজের চেষ্টা করেও হয়নি। এভাবেই শুরু হয় বছরের পর বছর যাযাবর জীবন। কিছুদিন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার পর সেখান থেকে বের হয়ে পড়ে। সেখানে চেঁচামেচি, গাদাগাদি করে ঘুমানো, সিগারেট, মদ ও মানুষের শরীরের গন্ধ তার ভালো লাগত না। নাইজেরিয়ায় তার জন্য অপেক্ষা করছে ফাঁসির দড়ি। আর এখানে আত্মগোপন করে থাকতে হয়। এভাবেই শুরু হয়েছিল তার ২১ বছরের যাযাবর জীবন।
গৃহহীন মানুষটি বলতে থাকে, ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে মানুষের কাছে হাত পেতেছি। কেউ খাবার দেয়নি। কাগজ নেই বলে কাজ নেই। শেষ পর্যন্ত সবকিছু অর্থহীন মনে হলো।
মানুষটি বলে, ‘আমি হিরো নয় স্যার। আজ হিরো সোফিয়া। সে তার জীবনে আমাকে আপন করে যে সুন্দর জীবন দিয়েছে, তা তো একমাত্র সুপার হিরোই পারে।’
সোফিয়া গৃহহীন মানুষটিকে বিয়ে করে। বিয়ের পর তাকে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার বৈধতা দেওয়া হয়। সেখানে কাজ করার অধিকার পায়। অবশেষে একটি সুখের গৃহে সুখেই কাটতে থাকে তাদের দুজনের জীবন।