অপার্থিব অনুভূতি ও ভালোবাসার অপর নাম সেন্ট যোসেফ স্কুল

আজকের থেকে আট বছর আগের ঘটনা। সবে ষোলোতে পা রেখেছি। সার্টিফিকেট অনুযায়ী অবশ্য আমার বয়স খানিকটা নিচে। জীবনযুদ্ধের ধাক্কাটা প্রথম সে সময় ভালোভাবে অনুধাবন করি। যদিও ২০১০ সালে জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল এবং আমার জীবনে সেটি ছিল প্রথম কোনো পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা, তারপরও জেএসসি পরীক্ষার সে অভিজ্ঞতা এখন অবধি তেমন একটা কাজে আসেনি।

এখানে বলে রাখা ভালো, আমরা ছিলাম প্রথম ব্যাচ, যাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম জেএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। জেএসসি পরীক্ষায় সব বিষয় মিলিয়ে গড়ে এ প্লাস পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করি, কিন্তু কেন জানি এ রেজাল্ট আমার জীবনে অদ্যবধি তেমন একটা কাজে আসেনি। এসএসসিতেও একই ফল। তা সত্ত্বেও এসএসসি পরীক্ষা–পরবর্তী সময়টা আমার জন্য তেমন একটা আশানুরূপ হয়ে ধরা দেয়নি। প্রতিষ্ঠিত কোনো কলেজে ভর্তির সুযোগ না পাওয়া আমার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ব্যক্তিগতভাবে স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমমানের শিক্ষার সুযোগ ও অবকাঠামো থাকবে, যেমনটি আমি স্লোভেনিয়া, অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্কসহ ইউরোপের অনেক দেশে দেখেছি। যদিও বিষয়টি শুনতে খারাপ লাগে, তবে নির্মম সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখনো সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে একই ধাঁচের শিক্ষার সুযোগ এবং একই ধরনের অবকাঠামোগত পরিষেবা বিকশিত হয়নি। এ কারণে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বৈষম্য প্রবল। আমাদের কাছে কখনো কোয়ালিটি বিষয়টি মুখ্যভাবে ধরা দেয় না, এ কারণে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে নিজের মননশীলতার বিকাশের জন্য এবং নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কখনো সেভাবে কাজ করি না। কোনো কিছু জানার আগ্রহ আমাদের মধ্যে প্রবলভাবে অনুপস্থিত।

যা-ই হোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। এসএসসি পরীক্ষার পর সঠিকভাবে কলেজ নির্বাচন করাটা একটা মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যার ওপর ভিত্তি করে আমার জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলো দাঁড়িয়েছিল। পছন্দের তালিকায় বেশ কয়েকটি কলেজের নাম সবার ওপরের স্থানে বারবার ঘুরেফিরে আসছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রথমবারের মতো যখন সেন্ট যোসেফ পরিদর্শনে যাই, সেখানকার ব্যবস্থাপনা ভীষণভাবে মুগ্ধ করে। বিশেষ করে চাকচিক্যময় শ্রেণিকক্ষগুলো হৃদয়ে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে, এমনকি কলেজের ভেতরে প্রবেশের পর যেসব স্টাফের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়, তাঁরাও ছিলেন যথেষ্ট আন্তরিক। সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিই, যদি সিলেকশন পাই, তবে চোখ বন্ধ করে সেন্ট যোসেফে ভর্তি হব। আমাদের সময় বেশির ভাগ কলেজ ভর্তি নিয়েছিল একটু ভিন্নভাবে, প্রথমত পছন্দের কলেজ নির্বাচন করে টেলিটক নম্বরের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ফি প্রদান করে আমাদের পছন্দ অনুযায়ী কলেজ নির্বাচন করতে হতো। কয়েক সপ্তাহ পর বোর্ড থেকে আমাদের রেজাল্ট অনুযায়ী সিরিয়ালের ভিত্তিতে একটি লিস্ট কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাত। প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল এবং আমার কাছে কখনো এ প্রক্রিয়াকে জুতসই মনে হয়নি। এ ছাড়া আমরা যে বছর এসএসসি পরীক্ষা দিই, অর্থাৎ ২০১৩ সাল থেকে শুরু করে আশপাশের বছরগুলোতে দেখতাম, পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে পাসের হার বৃদ্ধি কিংবা জিপিএ ফাইভ বৃদ্ধির নতুন রেকর্ড হতো। তাই পছন্দের কলেজে ভর্তি হতে পারব কি না, সেটা ছিল সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ। ভাগ্যবিধাতা আমার দিকে তাঁর সুনজর দিলেন। সেই থেকে যোসেফাইট হিসেবে যাত্রা শুরু।

২০১৩ সালের ৫ জুলাই। দিনটি ছিল আমার জীবনে বিশেষ দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম। কেননা, সেদিন প্রথম সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা। অনেকে হয়তোবা জানেন, সেন্ট যোসেফ বাংলাদেশের খ্রিষ্টান মিশনারি দ্বারা পরিচালিত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ব্রাদার রবি ছিলেন সে সময় আমাদের কলেজের প্রিন্সিপাল। অন্যদিকে ব্রাদার ভিক্টর বিকাশ ডি রোজারিও ছিলেন আমাদের ভাইস প্রিন্সিপাল।

সত্যি কথা বলতে, স্কুলজীবনের ১০ বছরের চেয়ে কলেজের দেড় বছর ছিল বেশি চাকচিক্যময়। অনেকে বলে থাকেন, স্কুলজীবনের বন্ধুরা নাকি শেষ জীবন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয় এবং মানুষ সহজে তার স্কুলের বন্ধুদের ভুলতে পারে না। আমার বেলায় তেমনটি হয়নি, স্কুলের বন্ধুদের চেয়ে কলেজের বন্ধুরা অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে। এসএসসি পরীক্ষার পর স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে সেভাবে যোগাযোগ নেই। কিন্তু কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে এখনো নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার চেষ্টা করি। বাংলাদেশে এলে তাদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করি।

যদিও অফিশিয়ালি আমাদের সব শিক্ষার্থীর কলেজ লাইফ দুই বছর স্থায়ী হয়, বাস্তবিকভাবে আমাদের ব্যাচের সবার কলেজ লাইফ দেড় বছর স্থায়ী হয়েছে কি না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। প্রথম কলেজে ক্লাস শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক দিনের মাথায় রমজান এবং ঈদুল ফিতর সামনে রেখে বাংলাদেশের অন্যান্য স্কুল ও কলেজের মতো আমাদের কলেজ এক মাসের ছুটি ঘোষণা করে। ঈদুল আজহা, দুর্গাপূজা ও কালীপূজা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পূজা-পার্বন, খ্রিষ্টমাস, বৌদ্ধপূর্ণিমাসহ বিভিন্ন ধর্মীয়, জাতীয় দিবস; একই সঙ্গে গ্রীষ্ম–শীতকালীন ছুটি মিলিয়ে এমনিতে বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুই থেকে আড়াই মাস বন্ধ থাকে। তবে আমাদের সময় সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিরোধী দলের হরতাল ও অবরোধ, যে কারণে অনির্দিষ্টকাল সে সময় আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছিল। তাই আমাদের কলেজ লাইফ ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। তারপরও জীবনে সেন্ট যোসেফে অধ্যয়নকালীন সে সংক্ষিপ্ত সময়টুকু সবচেয়ে বেশি গুরুত্ববহ এবং একই সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ একটি কারণ আর সেটি হলো আমার জীবনের দর্শন মোটাদাগে কলেজ লাইফে অর্জিত শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার ওপর প্রতিষ্ঠিত।

প্রথম প্রথম কলেজজীবন আমার কাছে বেশ যন্ত্রণাদায়ক মনে হতো। ক্লাস টেস্ট ও নিয়মিত ল্যাব ক্লাসের চাপ আমার কাছে একে ফোর্টি সেভেন রাইফেলের বুলেটের মতো মনে হতো। সেই সঙ্গে ডিসিপ্লিনের ব্যাপারে আমাদের কলেজ ছিল অত্যন্ত কড়া। যেমন একদিন কোনো কারণে কলেজে উপস্থিত হতে না পারলে পরের দিন অভিভাবকসহ কলেজের ডিসিপ্লিন কমিটির সঙ্গে দেখা করতে হতো। চুল ছোট রাখার জন্য এবং নিয়মিত দাড়ি শেভ করার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রায় চাপ দিত। ড্রেস কোডের বিষয়ে আমাদের কলেজ কর্তৃপক্ষ ছিল একেবারে জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী।

ঢাকার মানুষ দুই বছর নষ্ট করে শুধু যানজটে

ঢাকা শহরের যানজট যে কতটা অস্বস্তিদায়ক, সেটা আমরা জানি। যানজটের কারণে ঢাকা শহরের মানুষ প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা কোনো কারণ ছাড়াই যানবাহনের ভেতর নষ্ট করে। গড়ে আমাদের কর্মদিবস সপ্তাহে পাঁচ দিন। মনে করি, যানজটের কারণে আমাদের সবার জীবন থেকে গড়ে প্রতি কর্মদিবসে দুই ঘণ্টার অপচয় হয়। এ হিসাবে সপ্তাহে পাঁচ দিন শুধু যানজটের কারণে আমাদের সবার জীবন থেকে ১০ ঘণ্টার অপচয় ঘটে। এক বছরে মোট সপ্তাহের সংখ্যা গড়ে ৫২টি। সাকল্যে সব ছুটি মিলিয়ে আমরা যদি এক বছরে গড়ে ২০০ কর্মদিবসও পাই, তাহলে আমাদের এ অপচয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪০০ ঘণ্টা। আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু ৬০ থেকে ৬৫ বছর। অন্তত আমি যদি সব মিলিয়ে ধরে নিই এ দেশে একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় ৪৫ বছর সুস্থ ও স্বাভাবিক কর্মক্ষম জীবন অতিবাহিত করতে পারে, তাহলে এ ৪৫ বছরে তার মোট অপচয়ের পরিমাণ ১৮ হাজার ঘণ্টা। অতি সাধারণভাবে হিসাব করলেও বলতে পারি, ঢাকা শহরের একজন মানুষ সর্বনিম্ন দুই বছর নষ্ট করে শুধু যানজটের সময় গাড়ির ভেতরে বসে।

২০১৩ সাল থেকে আমরা শান্তিবাগে স্থায়ীভাবে বসবাস করছি। শান্তিবাগ থেকে সেন্ট যোসেফে যাতায়াতের বিষয়টি সে সময় খুব একটা সহজ ছিল না। বাসা থেকে বের হয়ে হেঁটে প্রথমে মালিবাগ মোড়ে যেতাম এবং সেখান থেকে বাসে করে পল্টন কিংবা ফার্মগেট যেতাম। পল্টন থেকে অথবা ফার্মগেট থেকে সরাসরি আসাদ গেটের বাস আছে। আসাদ গেট থেকে কয়েক গজ হাঁটলে আমাদের কলেজ। লাব্বাইক ছাড়া মালিবাগ মোড় থেকে আসাদ গেট যাওয়ার কোনো বাস ছিল না। লাব্বাইক ছিল তখনকার সময়ে একেবারে সোনার হরিণের মতো। মালিবাগ, মৌচাক কিংবা মগবাজারের যারা বাসিন্দা, তাদের কাছে ৬ নম্বর বাস আজও এক দুঃসহ স্মৃতির নাম। শিক্ষার্থী হিসেবে অবশ্য তিন টাকা ভাড়া দিয়ে ৬ নম্বর বাসে মালিবাগ মোড় থেকে ফার্মগেট যাওয়া যেত তবে ৬ নম্বর আর ৮ নম্বর বাসে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা ঢাকাবাসীর কাছে সব সময় তিক্তদায়ক। সামান্য বৃষ্টি হলে শান্তিনগরের মোড় থেকে মগবাজার বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত হাঁটুপানিতে ডুবে যেত। সেই সঙ্গে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের কাজ বাড়তি বিড়াম্বনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমনিতে মালিবাগ ও মৌচাক এলাকা একসময় ঢাকা শহরে জ্যামের জন্য আলাদাভাবে পরিচিতি পেয়েছিল। সকাল সাড়ে আটটায় আমাদের কলেজ শুরু হতো, বেশির ভাগ সময় চেষ্টা করতাম সকাল ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য। সাড়ে আটটার আগে কলেজের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারলে কপাল পুড়ত। গেটম্যান গেট লক করে দিতেন। ভাগ্য সহায় না হলে সেদিন আর কলেজে উপস্থিত থাকার সুযোগ মিলত না। পরের দিন তাই বাধ্য হয়ে অভিভাবক নিয়ে আসতে হতো।

প্রথম প্রথম এ নিয়মগুলোর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে বেশ প্রতিবন্ধকতা পোহাতে হচ্ছিল। অনেকে এসব নিয়মের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পেরে সেন্ট যোসেফ থেকে অন্য কলেজে তার অ্যাডমিশনকে ট্রান্সফার করে। সে সময় এ নিয়মগুলো গলার কাঁটার মতো মনে হলেও জীবনের এ পর্যায়ে এসে আজ উপলব্ধি হয়, সেইন্ট যোসেফের সময়টাকে যদি আরেকটু দীঘস্থায়ীভাবে পেতাম, তাহলে জীবনটাকে আরও সুন্দরভাবে সাজাতে পারতাম। কথায় বলে না, দাঁত থাকতে মানুষ দাঁতের মর্ম বোঝে না।
আমার মা আমাকে প্রতিদিন বাসভাড়া ও দুপুরের টিফিনের খরচ বাবদ ১০০ টাকা দিতেন। সে সময় ১০০ টাকা অনেক কিছু মনে হতো। ১০০ টাকায় বাসভাড়া থেকে শুরু করে দুপুরে পেট পুরে টিফিন পর্যন্ত সবই হতো। এমনকি কলেজ শেষে রাস্তার মোড়ের টংয়ের দোকানগুলোর বিলও মেটাতে পারতাম এ ১০০ টাকা থেকে। শেষমেশ কিছু টাকা বেঁচেও যেত। এখন ৫০০ টাকা খরচ করেও সে সময়ের মতো প্রশান্তি আসে না।

সেন্ট যোসেফে আমার সবচেয়ে বড় পাওনা ছিল সেখানকার বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকেরা। বিশেষ করে সেখানকার শিক্ষকেরা আমাদের যেভাবে যত্ন করেবিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করতেন, আমি মনে করি সেটি আমার জ্ঞানের ভিত্তিকে পরিপূর্ণভাবে গড়ে দিয়েছে। যেহেতু আমি বর্তমানে ফিজিকস এবং অ্যাস্ট্রোফিজিকসে ব্যাচেলর সম্পন্ন করছি, তাই এ মুহূর্তে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সাবজেক্ট হচ্ছে ফিজিকস অ্যান্ড ম্যাথমেটিক্স। আমার সৌভাগ্য যে আমি সুদেব স্যার নিয়াজ আহমেদ পাভেল স্যার ও দেবব্রত স্যারের মতো তিনজন শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। কলেজ লাইফের বেশির ভাগ সময় আমি তাঁদেরকে পেয়েছি পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে এবং আমি হলফ করে বলতে পারি, তাঁদের পড়ানোর স্টাইল এতটা আকর্ষণীয় ছিল যে ইউরোপে আসার পরও আমার কাছে মনে হয়, এ তিনজন মানুষের বিকল্প আমি এখনো সে অর্থে খুঁজে পাইনি। সাত থেকে আট বছর আগে তাঁদের কাছ থেকে অর্জিত শিক্ষার ওপর ভর করে আমি আজ ব্যাচেলর সম্পন্ন করছি। সত্যি কথা বলতে, এ তিন শিক্ষকের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমি ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকসে উচ্চশিক্ষার সিদ্ধান্ত নিই ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা মেডিকেল সায়েন্সের মতো বিষয়কে বাদ দিয়ে। পদার্থবিজ্ঞানের সত্যিকার স্বাদ তাঁদের মাধ্যমে পেয়েছিলাম। সেই সঙ্গে উচ্চতর গণিতের দীপক স্যার, প্রিন্স স্যার, অসীম হালদার স্যার ও স্বপন বিশ্বাস স্যারকেও বিশেষভাবে স্মরণ করতে চাই। সায়েন্সের সঙ্গে সম্পর্কিত যেকোনো বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে হলে যে কাউকে ক্যালকুলাসে পারদর্শী হতে হয়, ক্যালকুলাসকে অনেকে সায়েন্সের প্রাণ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার পরও অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে ক্যালকুলাস নিয়ে ভীতি কাজ করে, কিন্তু আমার মধ্যে কোনো দিন ক্যালকুলাস নিয়ে কোনো ধরনের ভীতি কাজ করেনি। আমি বলতে পারি যে গণিতে আমি অত্যন্ত পারদর্শী এবং আজকে গণিতে আমার এ দক্ষতার মূলে সেন্ট যোসেফের এ চারজন শিক্ষকের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। স্বপন স্যারের গল্পের কথা আজও মনে পড়ে। তিনি এমনভাবে গল্প উপস্থাপন করতেন, কেউ না হেসে পারত না।
আজকের পৃথিবীতে নিঃসন্দেহে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব সবার ওপরে, বর্তমানে ইংরেজি হচ্ছে এ পৃথিবীর সর্বপ্রধান ল্যাঙ্গুয়া ডি ফ্রাঙ্কা। আজ যদি ইংরেজি ভাষার ওপর আমার দক্ষতা না থাকত, তাহলে আমি স্লোভেনিয়াতে পড়াশোনা তো দূরের কথা, এখানে ঠিকমতো টিকে থাকতে পারতাম কি না সন্দেহ! আমি বিশেষভাবে স্মরণ করতে চাই স্বপন হালদার স্যারকে, কেননা তিনি না থাকলে ইংরেজিতে আমার জ্ঞানের পরিধি সেভাবে বিকশিত হতো না। একাডেমিক সিলেবাসের বাইরেও বিভিন্ন বিষয়ে তিনি আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন, যার ফলে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে আমি ব্রিটিশ কাউন্সিলের অধীনে আইএলটিএস পরীক্ষায় সন্তোষজনক স্কোর তুলতে সক্ষম হই।

আমাদের সেন্ট যোসেফে কাউন্সিলিং নামের এক বিশেষ ব্যবস্থা ছিল, অর্থাৎ কতিপয় শিক্ষার্থীকে একজন শিক্ষকের অধীনে দেওয়া হতো এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে কিংবা তাদের অভিবাবকের সঙ্গে আলোচনা করতেন। আমি ছিলাম বিদ্যুৎ স্যারের অধীনে, বিদ্যুৎ স্যার আমাদের বাংলা পড়াতেন। বাংলা ক্লাসের লেকচারগুলো এখনো মিস করি। বিদ্যুৎ স্যারের পাশাপাশি বাংলার শিক্ষক হিসেবে যাঁদেরকে পাশে পেয়েছি, তাঁরা হলেন নির্মল স্যার, হুমায়ূন স্যার, উজ্জ্বল স্যার ও ফারজানা ম্যাডাম। প্রত্যেকের ক্লাস ছিল স্মরণ রাখার মতো। সাহিত্যকে সমাজের দর্পণ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ইউরোপে আসার পর একটা কথা প্রায়ই শুনি। সাহিত্য ছাড়া মানুষের মধ্যকার মনুষ্যত্ববোধের বিকাশ সাধন কখনো সম্ভব নয়। আমি মনে করি, আমার মধ্যাকার যে সত্তা রয়েছে, সেটার বিকাশে বিরাট ভূমিকা রেখেছে সেন্ট যোসেফের বাংলা ক্লাসের লেকচারগুলো। ব্যবহারিক জীবনে এসব লেকচার থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা কেন জানি বারবার ফিরে আসে।

সে সময় বয়সে অনেকটা কচি ছিলাম, অনেক বিষয় তাই সহজে বোধগম্য হতো না। আমাদের বায়োলজি শিক্ষক ছিলেন মিজান স্যার। যতটুকু মনে পড়ে, আমাদের ব্যাচে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সিনিয়র শিক্ষক। কৈশোরের তাড়নায় সে সময় তাঁর কথাগুলো সেভাবে মূল্যায়ন করিনি, কিন্তু আজ অনেক আফসোস লাগে। সামনে যত বয়স বাড়বে, তত বোধ হয় আফসোসের মাত্রা বাড়বে। একই সঙ্গে স্মরণ করতে চাই অনিমেষ স্যারকে। আমার মধ্যে ধৈর্য জিনিসটি একেবারে অনুপস্থিত। বায়োলোজিকে আমার কাছে মুখস্থের বিষয় মনে হতো এবং কোনো কিছু মুখস্থ করার মতো ধৈর্য আমার মধ্যে একেবারে অনুপস্থিত। এসএসসি পর্যন্ত তাই বায়োলজি ছিল আমার কাছে বিরক্তির এক নাম। তবে বায়োলোজির প্রতি আমার সে বিরক্তি দূর করতে অনিমেষ স্যার প্রভাবকের ভূমিকা নিয়ে আমার জীবনে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর একটা কথা আজও বারবার কানে ভাসে, বায়োলজি কখনো মুখস্থ করার বিষয় নয়। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত রসিক।

আমাদের ব্যাচ থেকে এইচএসসির পাঠ্যসূচিতে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নামের নতুন একটি সাবজেক্ট চালু হয়। নতুন সাবজেক্টকে ঘিরে আমাদের সবার মধ্যে বাড়তি উৎসাহ কাজ করছিল। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ে আমাদের শিক্ষক ছিলেন রাশিদা ম্যাডাম, পলাশ চন্দ্র সূত্রধর স্যার ও আসাদ স্যার। রাশিদা ম্যাডামের থেকে সি প্রোগ্রামিং শিখেছিলাম, ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকসের শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সি কিংবা ফোরট্রানের মধ্যে যেকোনো একটি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ শেখার পরামর্শ দেওয়া হয়। এমনকি আমাদের ফার্স্ট ইয়ারে বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে সি শিখতে হয়েছিল, ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনালে সি প্রোগ্রামিংয়ে আমার গ্রেড ছিল ১০–এর মধ্যে ৮। কোনো রকম পাস করতে গিয়ে অনেক স্টুডেন্টের হাঁসফাঁস উঠে যাচ্ছিল, কিন্তু আমাকে খুব একটুও বেগ পেতে হয়নি। রাশিদা ম্যাডাম আমার বেসিক গড়ে দিয়েছিলেন এবং এ কারণে আমাকে সি প্রোগ্রামিংয়ের ওপর ভালো গ্রেড পেতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। পলাশ স্যার ও আসাদ স্যারের ক্লাসও ছিল স্মরণ রাখার মতো।

আমাদের রসায়ন পড়াতেন স্বপন মিস্ত্রি স্যার ও শ্যামল স্যার। পার্টটাইম শিক্ষক হিসেবে উত্তম স্যারকেও পেয়েছিলাম। এ ছাড়া নিত্যদিনের ল্যাবক্লাসগুলোতে শিক্ষক হিসেবে পাশে ছিলেন সুবীর স্যার, সুজন স্যার ও জাকারিয়া স্যার। রসায়নের ল্যাব ক্লাস নিতেন সুবীর স্যার ও পদার্থবিজ্ঞানের ল্যাব ক্লাস নিতেন সুজন স্যার। অন্যদিকে জীববিজ্ঞানের ল্যাব ক্লাস নিতেন জাকারিয়া স্যার। প্রতিটি ল্যাব ক্লাস এতটা সুনিপুণভাবে পরিচালিত হতো যে ইউনিভার্সিটি লাইফে আমাকে ল্যাব নিয়ে তেমন একটা ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। সেন্ট যোসেফের সব শিক্ষক ছিলেন স্ব–স্ব বিষয়ে পরিপূর্ণ প্যাকেজের মতো। মাঝেমধ্যে ইউনিভার্সিটির চেয়েও কলেজ লাইফকে আমার কাছে তাই বেশি প্রাণবন্ত মনে হয়।

অন্যদিকে যদি আমার কলেজ লাইফের বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে লিখতে চাই, তাহলে অবস্থা এমন হবে যে রাতের পর রাত পার হলেও আমার কলম কোনো দিনও থামবে না। ডজনখানেকের মতো উপন্যাসও হয়তোবা লিখে ফেলতে পারব। তবে আমার দুই প্রাক্তন সহপাঠীকে বিশেষভাবে স্মরণ করতে চাই, একজন হচ্ছে ফয়সাল ও অন্যজন হচ্ছে সুস্মিত। রেল ও সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অকালে তাদের দুজন পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। তাদেরকে আর কোনো দিনও ফিরে পাব না।

প্রবাসজীবনে পা রাখার পর আমার কাছে সবচেয়ে স্মৃতিময় মুহূর্ত মনে হয়েছে কলেজ লাইফকে। ২০১৪ সালটি ছিল আমার জন্য তাই সবচেয়ে স্মরণীয় একটি বছর। একদিকে বর্ণিল কলেজ লাইফ, অন্যদিকে বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রিয় দল জার্মানির চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ঘটনাটি সম্মিলিতভাবে আমার মনে নিখাদ এক অনুভূতির সৃষ্টি করেছে। বিদেশে আসার পর তাই কলেজ লাইফের স্মৃতিকে স্মরণ করে অনেকবার কেঁদেছি, এখনো চোখের সামনে কলেজ লাইফের স্বর্ণালি সেদিন ভেসে বেড়ায়। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেভাবে সুদূর ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে বসে কপোতাক্ষ নদকে দেখতে পেতেন, কিংবা কপোতাক্ষ নদের জলরাশির ছন্দ শুনতে পেতেন, আমিও ঠিক একইভাবে স্লোভেনিয়াতে বসে সেন্ট যোসেফে অধ্যয়নকালীন সে দিনগুলোকে দেখতে পাই। সে সময়কার শিক্ষকদের লেকচারগুলো আজও আমার কানে ভেসে আসে।

ওরিয়েন্টেশনের রঙিন মুহূর্তটিকে বারবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। ব্রাদার রবি কিংবা ব্রাদার বিকাশের কথাগুলো আজও যেন মোটিভেশনাল স্পিস হিসেবে মনের দুয়ারে কড়া নাড়ে। আমি গর্বিত যে আমি একজন যোসেফাইট। আমার কলেজ আমাকে দুই হাত ভরে সব অনুগ্রহ দান করেছে। আমার বর্তমান দাঁড়িয়ে আছে আমার কলেজ লাইফের ওপর। সেন্ট যোসেফ তাই আমার কাছে এক অপার্থিব অনুভূতি ও ভালোবাসার নাম। হারিয়ে যাওয়া সে অধ্যায়টিকে আর কোনো দিনও ফিরে পাব না। তবু জীবনানন্দ দাশের সে বিখ্যাত কবিতা, ‘আবার আসিবো ফিরে’–এর মতো অবচেতন মনে আমি বারবার ফিরে যেতে চাই আমার প্রিয় সেন্ট যোসেফকে।

*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।