অপরাজিতা মা আমার

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আকাশে মেঘ দেখলেই আমার মায়ের মনটা কেমন যেন বিষাদে ছেয়ে যেতেন। বর্ষার আগে আগে বিষণ্ন মনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মাকে অনেকবার বলতে শুনেছি, সামনে ঝড়-বাদলার দিন। কী যে করি...।
মায়ের চোখটা কেমন যেন ছলছল করে উঠত।
কাগজেকলমে দুই মাসের ঋতু হলেও বর্ষার রাজত্ব যেন ছয় মাসেও শেষ হতে চায় না। বর্ষার আগে মায়ের নিরীহ মুখটাতে বিষাদের যে রেখা ফুটে উঠত, তা আমি সহজেই পড়তে পারতাম। কারণ ফি বছরই আমরা মায়ের প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়া অব্যক্ত, অদৃশ্য উদ্বিগ্নতার সঙ্গে কঠিনভাবেই মুখোমুখি হতাম।
আমাদের মাটির ঘরে খড়ের চালা। কখনোই দেখিনি খড়ের ছাউনিকে বৃষ্টির ধারা ঠিক মতন সহ্য করতে। বর্ষার রাতগুলোতে নিশ্চিন্তে ঘুমানো ছিল স্বপ্নের মতো। মাটির দেয়াল চুঁইয়ে চুঁইয়ে সারা মেঝে পানিতে ভরে যেত। ঘরের কোণে কিঞ্চিৎ শুকনো জায়গা অবশিষ্ট থাকলে সেখানে গুটিসুটি মেরে আমরা ভাই-বোনেরা রাত পার করে দিতাম। মায়ের রাত পার হতো পানি সেচে আর কাঁথা বালিশ-বিছানাপত্র গোছাতে গোছাতে। তবুও মায়ের চোখেমুখে ক্লান্তি দেখিনি কখনো। দেখতাম একরাশ শঙ্কা।
ঘোড়ায় চড়িল আছাড় খাইল/আবার চড়িল উড়াইয়া ধরিল...কাপড় খসিল আসন নড়িল/সাহস বাড়িল চড়িতে শিখিল।
সময়ে সময়ে পড়ালেখার কথা উঠলে মা এই ছড়াটি গড়গড় করে মুখস্থ আবৃত্তি করে সহাস্যে বলতেন, বাবা, আমার বিদ্যা এতটুক। পয়সাওয়ালা নানার অনেক আদুরে মেয়ে ছিল আমার মা। মার ছোটবেলার গল্পগুলো তার কাছ থেকেই অনেকবারই শোনা হয়েছে। পড়ালেখার প্রতি প্রচণ্ড ঝোঁক থাকা সত্ত্বেও বিদ্যা ঘোড়ায় চড়িল আছাড় খাইল ছড়ার মতো শুরুতেই আছাড় খেয়েছিল।
চাচা, জেঠারা পড়তে দেননি। বলেছিলেন, মেয়েদের আবার কী স্কুল! কিন্তু মক্তবের কোরআন শিক্ষায় সর্দারনী ছিলেন আমার মা। মাত্র ছয় বছর বয়সে আমপারা শেষ করে গড়গড় করে কোরআন পড়তে পারতেন মা। মক্তবে তখনো বারো-চৌদ্দ বছরের মায়ের সতীর্থরা আমপারা সামনে নিয়ে সামনে পেছনে মাথা দুলিয়ে সুর মেলাতেন বেশির ভাগই। তারা সবাই মার সঙ্গে সদ্ভাব রাখতেন, সমীহ করতেন, যাতে একটু সাহায্য পেয়ে হুজুরের বেত্রাঘাত থেকে বেঁচে যান।

মার বাংলা ও ইংরেজি বিদ্যার জোর কম হলেও শেখার আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রচণ্ড। আমাদের সঙ্গে শিখতে শিখতে বাংলা-ইংরেজি দৈনিকের শিরোনামগুলো পড়তেন মা গড়গড় করে। দেখে দেখে লিখে ফেলতেন কয়েক পৃষ্ঠা। ইংরেজি কিছু প্রোভার্বও শিখে নিয়েছিলেন মা। অনেক প্রোভার্ব মা যথাযথ জায়গায় বলতেন। এর অর্থ জানে এ রকম অপরিচিত কেউ শুনে আশ্চর্য হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতেন-কোথায় শিখেছেন। মা সহাস্যে বলতেন, আমার ছেলেরা শিখিয়েছে।
রঙিন জামা, জুতো, মোজা, চুড়ি, ফিতা, ঘড়ি—ছোটবেলায় কোনো কিছুরই আবদার অপূর্ণ রাখেননি আমার নানা। নানা জাহাজে করে ঘুরতেন দেশে দেশে। দেশি বিদেশি নানান খাবারদাবার নিয়ে আসতেন আসার সময়। আমার মা ছিলেন ভীষণ বাপ পেয়ারা। ঘরের সবাই ছুটোছুটি করতেন বিদেশিওয়ালার জিনিসপত্র নিয়ে। আমার মা তার বাপটাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে চোখের জল ফেলতেন। বুড়ো বয়স পর্যন্ত আমার মাকে কাঁদতে দেখেছি তার বাপের জন্য।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

নানার পণ ছিল মেয়েকে বিয়ে দেবেন শিক্ষিত ছেলের সঙ্গে। অবশেষে আমার বাবাকেই এই কাতারে পেয়েছিলেন নানা। আমার বাবার হাতে তুলে দেওয়ার সময় কেঁদে কেঁদে নানা বলেছিলেন, যদি আমাকে ভালোবাসিস তাহলে এই বিয়ের সাজটা যেন তোর জীবনের প্রথম ও শেষ হয়। মা সব সময় সেটা মেনে চলেছিলেন। বাবার সংসারের সারা জীবনের অনটনের সাথি হয়েও কখনো মুখ ফুটে কোনো কথা বলেননি মা। নিজের ব্যক্তিগত কোনো কিছু চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে, এ যেন মা ভুলেই গিয়েছিলেন চিরতরে। ভালো মন্দ যে কোনো খাবার সামনে নিলে সবটুকুই ভাগ করে দিতেন আমাদের। নিজের জন্য অবশিষ্ট কিছুই রাখতেন না। আমরা জোরাজুরি করলে মা বলতেন, ছোটবেলায় আমার বাবা আমাকে সবকিছুই খাইয়েছে।
আমার মা তার মা-বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। বাবার শোক শেষ জীবনেও কেটে উঠতে পারেনি আমার মা। একা একা কোথাও বসলে আমার নানার কথা বলে বলে কাঁদতেন মা। মা-বাবা হারানো কী যে কষ্টের তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। সেদিক দিয়ে আমার মা ভাগ্যবতী। মা হারানোর কষ্ট অনুভব থেকে আমার মা বেঁচে গেলেন। কিন্তু আমার নানির বুড়ো বয়সের হৃদপিন্ডটাতে কী পরিমাণ শোকের পাথর চেপে দিয়েছেন তা কেবলমাত্র সন্তান হারানো মা-ই অবগত।
পশু-পাখির প্রতি আমার মায়ের মমতা ছিল অন্য রকমই। মাঝে মাঝে পড়ার ঘর থেকে শুনতাম, গোয়াল ঘরে বসে বসে মা যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে চুপিসারে দেখতাম, মা বাদামি গাইটার গলায়, মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে তার সঙ্গে কত কথাই না বলে যাচ্ছেন। শীতের রাতে নিজের গায়ে কাঁথা জড়ানোর খেয়াল থাকুক না থাকুক, গাই আর বাছুরকে ছালা জড়িয়ে মেঝেতে শুকনো খড়ের বিছানা পেতে দিতেন। গোয়ালের সব ছিদ্রগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বন্ধ করে দিতেন, যাতে ঠান্ডা না ঢুকতে পারে। রাতে হাঁস-মুরগি, গাই-বাছুরের একটু নড়া চড়া শুনলেই ঘুম থেকে আতিপাতি দৌড়ে গিয়ে দেখতেন মা। তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা।
ঘুম ভেঙে গেলে আমিও মার সঙ্গে সঙ্গে যেতাম। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলতাম, রাত নাই, দিন নাই এগুলো কী। এরা কী মানুষ। এত সেবা না করলেও হয়?
মা বলতেন, এরা মানুষ নয় বলেই তো বেশি সেবা করতে হয়। এরা বলতে পারে না। মানুষ তো সুবিধা অসুবিধা বলতে পারে।
মার এই কথা শোনার পর আমার সকল যুক্তির পথ বন্ধ হয়ে যায়। চুপ করে মার পশু সেবা দেখতে থাকি।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

কী শীত, কী বর্ষা, কী ব্যস্ততা, কী ফুরসত কোনো অবস্থাতেই মাকে নামাজ খেলাপ করতে দেখিনি। বিপদ, মহাবিপদ কিংবা ক্ষুধার জ্বালার মতো অসহ্য যন্ত্রণাও মাকে ইবাদত থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ছোটবেলা থেকেই মায়ের বুকের তলায় ঘুমানোর অভ্যাস আমার। বিছানায় শুয়েই মা শুরু করতেন কোরআন তিলাওয়াত। আমি খুব মন দিয়ে শুনতাম মার তিলাওয়াত। অন্ধকার ঘরের মধ্যে মুখস্থ, একের পর এক বিরামহীনভাবে মা পড়তেন ইয়াসিন, আর রাহমান, সুরা মূলক, গঞ্জল আরশ, আহাদনামা, ওয়াক্বীয়াহ, আসমাউল হুসনা, দরুদে তাজ আরও কত-কী!
পড়তে পড়তে গলাটা শুকিয়ে যেত মার। আমি শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে যেতাম জানি না। এক দিন দুই দিন নয়, প্রায়ই প্রতি দিন এইভাবেই মার ঘুমানো। মাঝে মাঝে মধ্যরাতে অস্পষ্ট কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেলে দেখতাম মা তাহাজ্জুদের নামাজ শেষে মোনাজাত ধরে অঝোরে কাঁদছেন।
আমার আর ঘুম আসত না। নীরবে মার কান্নাসমেত ফরিয়াদ শুনতাম। আখিরাতের আজাব থেকে পানাহ চেয়ে মা কাঁদতেন। তার সন্তানদের সম্মানিত জীবন, জীবিকা চেয়ে কাঁদতেন। মার কান্না শুনে আমিও নীরবে কাঁদতাম।
এত অনটনের মধ্যেও কখনো মা আমাদের উপোস রাখেননি। আমাদের যে কালটুকু দৈন্যদশার মধ্যে কাটিয়েছিলাম, তখন মা কোত্থেকে কীভাবে যে দানা পানি জোগাড় করে ফেলতেন! নইলে আমাদের উদর শূন্যতার ব্যাপ্তিকাল আরও কয় বেলা যে গড়িয়ে যেত তা আমার জানা নাই।
২১ ডিসেম্বর ১০১৪ থেকে মার একটি কথাও শোনা হয় না। হঠাৎ মার অসুস্থতার খবর শুনে দুবাই থেকে আছাড় খেয়ে পড়লাম চট্টগ্রাম। মা তখন ঢাকার ইউনাইটেড হসপিটালের সিসিইউতে। চট্টগ্রাম থেকে আবার ঢাকায় যাচ্ছি রাতে। আমার ছোট আপা মাকে আমার আসার কথা শোনালেন। মৃত্যুর বিছানায় মা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, তাকে আসতে বারণ কর, রাতে আসতে তার কষ্ট হবে। এর কিছুক্ষণ পরেই মা তার সোনালি আখিরাতের পথে পা বাড়ালেন।
মাগো,
আমি জানি না মৃত্যুর কষ্ট কী রকম।
তুমি সেটা জানো।
কিন্তু তুমি জীবনের শেষ দিনেও মৃত্যুর কষ্টটা বুকে চেপে ছেলের কষ্টটাই প্রাধান্য দিয়ে গেলে...
তুমি কেমন মা?
জানি না আল্লাহর কাছে তোমার সম্মান, মর্যাদা ঠিক কতটুকু কিন্তু আমার কাছে তার চেয়ে তুমি মোটেও কম নও মা।
মা তুমি সুখে থাকবে।
তুমি সুখে থাকবেই।