
কৈশলার প্রায় সমবয়সী ফুফাতো ভাই থানুসানও ওদের বাড়িতে থাকে। ১০ বছর বয়সের সময় থানুসানের মা মারা যাওয়ার পর সে আশ্রয় নেয় নানি-মামাদের কাছে। থানুসানের মার মৃত্যুর পর ওর বাবা আরেকটা বিয়ে করে ছেলেটাকে পিতৃত্বের আদর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। সৎমার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে না পেরে ঠাঁই নেয় সে নানির কাছে ৷ কিন্তু সেখানেও মামা-মামির লাঞ্ছনাগঞ্জনার মধ্যেই তার দিন কেটে যাচ্ছিল কোনোভাবে। বিশেষ করে ওর মামি, কৈশলার মার ব্যবহার ছিল অসহনীয় কিন্তু উপায় না থাকলে যা হয়। কোনো রকম মুখ গুজে সব অত্যাচার নীরবে সয়ে একমাত্র নানির কাছ হতে পাওয়া মাতৃসুলভ ভালোবাসা বুকে ধরে দিনাতিপাত করছিল। কৈশলা ও থানুসান মামাতো-ফুফাতো ভাইবোন এবং একই বয়সী হওয়ায় থানুসানকে ওর মা বকাবকি করলে কৈশলার মনটা খারাপ হতো। বকলে মাঝে মাঝে মার মুখের ওপর কথা বলত এবং প্রতিবাদও করত খারাপ ব্যবহারের জন্য।
কৈশলা এক সাধারণ সিংহলিজ পরিবারের মা-বাবার একমাত্র মেয়ে। একান্ন পরিবারভুক্ত হওয়ার সুবাদে কৈশলার মা-বাবার সঙ্গে চাচা, ফুফু ও অশীতিপর দাদিও থাকেন তাদের সঙ্গে। কৈশলারা শ্রীলঙ্কার ইস্ট কোস্টের বাত্তিকালয়া জেলার লেগুনবেষ্টিত এক সুন্দর, ছায়াঘেরা, শোভাময় ও চমৎকার ছোট গ্রাম অ্যারায়ামপাথীর বাসিন্দা। বাবা এক রিসোর্টের মোটেলের সামান্য বেতনভুক কর্মচারী আর মা গৃহিণী। ২০০৭ সালে কৈশলাদের গ্রামটা লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম (এলটিটিই) বাহিনী নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এলটিটিইরা গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায় ৷ পরে সরকারি বাহিনীর মধ্যস্থতায় অ্যারায়ামপাথীর এক উদ্বাস্তু শিবিরে কৈশলাদের আশ্রয় মেলে। এই জাতিগত দাঙ্গায় কৈশলার ষষ্ঠ শ্রেণির স্কুল করা ও লেখাপড়া শিকেয় ওঠে, সেই সঙ্গে থানুসানেরও। উদ্বাস্তু শিবিরের কর্ম ও লেখাপড়াহীন জীবনে অলসভাবে কৈশলা আর থানুসানের দিনগুলি কাটতে থাকে। বাত্তিকালয়ার বিশাল সমতল লেগুনপাড়ে ঘুরে বেড়িয়ে, শঙ্খ ঝিনুক ও রং-বেরঙের শামুক কুড়িয়ে মালা গেঁথে আর খেলাধুলা করেই সময়গুলি চলে যায়। একসঙ্গে এভাবে অবাধে মেলামেশা ও ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে দুজনে দুজনার কেমন যেন কাছাকাছি এসে পড়ে মনের অজান্তেই। অবুঝ দুটি মন অব্যক্ত ভালোবাসার জালে আটকা পড়ে। খুব সকালে মার রান্নাবান্নার কাজে কোনো রকম একটু সাহায্য করেই কৈশলা বের হয়ে পড়ে বাইরে খেলতে। আর ওদিকে উপহ্রদের পাড়ে অপেক্ষা করে থানুসান ৷ তারপর দুজনা হারিয়ে যায় দিগন্ত বিস্তৃত লেগুনপাড়ের অগভীর বনাঞ্চলে। থানুসান খেলার এই সাথিকে নিজের বাহাদুরি দেখায়। লম্বা কোনো এক নারকেল গাছে তরতরিয়ে উঠে পড়ে। পেরে আনে বড় পরিপুষ্ট সড়ওয়ালা ডাব ৷ দাঁত ও নখ দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে ডাবের ছোবড়া, লতাগুল্মের সরু একটা ডাল দিয়ে মালয়ের মুখ ফুটা করে এগিয়ে দেয় কৈশলাকে। কৈশলা নিমিষেই শেষ করে ফেলে সুমিষ্ট ডাবের পানি। তারপর মালিটা ফাটিয়ে কচি নারিকেল খেতে বলে কৈশলাকে। এভাবেই দুপুরের খাবার সারে দুজনা।
বাত্তিকালয়া গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এক অত্যুষ্ণ এলাকা বলে সেখানকার জলবায়ু ও স্থানীয় আবহাওয়া সারা বছরই শুষ্ক ও নাতিশীতোষ্ণ থাকে। মে মাসের এক প্রচণ্ড গরমের রাতে উদ্বাস্তু শিবিরের সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও কৈশলার ঘুম কিছুতেই আসে না। মধ্যরাতে গরমে শুধু হাসতাম করতে থাকে। ক্ষণিক দূরে তাকিয়ে দেখে থানুসান অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কৈশলা অতি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে থানুসানের কাছে গিয়ে পাশে শোয়। থানুসান কিছু বুঝে উঠার আগেই জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মাথা গুজে দেয়। থানুসানের ঘুম ভেঙে যায়, দেখে কৈশলা ছোট শিশুর মতো ওকে জড়িয়ে ধরেছে। খুব ভয় লাগে ওর, একে তো প্রচণ্ড গরম, ভয়ে গা দিয়ে ঘাম ঝরতে থাকে।
ফিসফিস করে বলে, ‘কৈশলা, কী করছিস? আম্মা, আক্কা, আন্না, নানি কেউ যদি দেখে ফেলে। ’
কৈশলা বলে ওঠে, ‘চুপ-কেউ দেখবে না। ’
বলে আরও সজোরে চেপে ধরে থানুসানকে। থানুসান কৈশলার কপালে আলত করে চুমু দেয়। কৈশলারও চুমু খেতে ইচ্ছা করে থানুসানের ঠোঁটে কিন্তু খেতে পারে না, মুখে চুমু খেলে পেটে যদি বাচ্চা এসে যায়। সেই ভয়ে।
পরদিন দুপুরে লেগুন পাড়ে বসে রাতের ওই কাহিনি নিয়ে দুজনে খুব হাসাহাসি করে।

২.
মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বাত্তিকালয়া অঞ্চলে নভেম্বর থেকে মনসুন রেইন শুরু হয়। একদিন ভরদুপুরে আড্ডা মারতে গিয়ে দুজনে লেগুন থেকে কিছু দূরের সমুদ্রসৈকতের কিনারায় হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে। সারি সারি রিসোর্টের মোটেল দেখে খুব ভালো লাগে কৈশলার। লক্ষ করে, পর্যটনে আসা বিদেশি মানুষগুলো বোর্ড দিয়ে কী সুন্দর সার্ফিং করছে আছড়ে পড়া সমুদ্রের ঢেউয়ের তালে তালে। ওর বুকেও এক অজানা ঢেউয়ের তোলপাড় শুরু হয় আর ফেনিল নীল জলরাশির উত্তাল ঢেউ বুকে এসে আঘাত করে। মনে মনে ভাবে, একদিন থানুসানের হাত ধরে এই সাগর পারি দিয়ে চলে যাবে ভিন্ন কোনো দেশে, সুখের সংসার পাতবে তার প্রিয় মানুষটির সঙ্গে।
হঠাৎ পশ্চিম আকাশে কালো মেঘ দেখে বাড়ি ফিরতে চায় ওরা। বর্ষার পূর্বাভাস, তাই দুজনে হাত ধরাধরি করে দেয় দৌড় ঘরে ফেরার জন্য। কিন্তু পথিমধ্যে ভীষণ ভারী বর্ষণ শুরু হয়। দুজনেই কাক ভিজা হয়ে যায়। দৌড়ে এসে দাঁড়ায় পত্রপল্লবিত এক মহুয়া গাছের নিচে। ভেজা ফ্রকে ১৩ বছরের ছোট এক কৈশলার দেহের ভাজগুলো ফুটে ওঠে। বুকের ওপরের ভেজা কাপড় ভেদ করে যেন দুটি শিমুলের কাঁটা খাঁড়া হয়ে বের হয়ে আসতে চায়। থানুসান অবাক ও বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কৈশলার দিকে। যেন কোনো দিনও তাকে দেখেনি এর আগে। চোখে চোখ পড়লে লজ্জায় থানুসানের হাত এক ঝামটা মেরে ছুটিয়ে নিয়ে কৈশলা পাশের লেকে লাফ মারে। উঠতি যৌবনের রহস্যময় গড়ন ও গঠন আড়াল করার চেষ্টায় ব্রতী হয় ৷ পানিতে ডুব দিয়ে সাঁতার কেটে অনেক দূরে ভেসে যায়। থানুসানও সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপ দেয়। রিমঝিম বৃষ্টির ফোঁটা পানিতে পড়তে থাকে। লেকের পানিতে বেশিক্ষণ ধরে দুজনে ল্যাপ্টালেপ্টি ও ঝাঁপটাঝাঁপাটিতে জলকেলি করে। বৃষ্টি একটু কমলে ফিরে আসে বাড়িতে।
ভেজা কাপড়ে বাড়িতে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের অগ্নিমূর্তি রূপ দেখতে পায় কৈশলা। ধ্যাং ধ্যাং করে ঘুরে বেড়ান একদমই পছন্দ নয় বলে মা জানিয়ে দেয় এবং এ-ও জানিয়ে দেয় যে, উদ্বাস্তু শিবির থেকে আগামীকাল গ্রামে নিজেদের বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।
ওদিকে কৈশলার দাদি বুঝতে পারেন যে, তাঁর মরা মেয়ের ছেলেটা পুতনি কৈশলার প্রেমে জড়িয়ে পড়েছে। মনে মনে দাদিমা এ-ও ধরে নেন যে, ওদের দুজনের বিয়ে হলে মন্দ হয় না। গ্রামের বাড়িতে ফিরে এলে কৈশলা থানুসানের দেখাসাক্ষাৎ ও কথাবার্তা কমে যায় মায়ের ভয়ে। মাঝে মাঝে দেখা হলেও মনের বা ভালোবাসার কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠে না মার জন্য। মাঝেমধ্যে মা এদিক-ওদিক গেলে লুকিয়ে দুজনে গোপনে দেখা করে এবং কথা বলে। দাদি তখন পাহারাদারের কাজ করে। কেউ চলে এলে দাদি গলার খাকর দিয়ে কাশি দেয় ওদেরকে সাবধান করার জন্য।
একবার শীতের প্রারম্ভে কৈশলার মা তাঁর বাপের বাড়ি কাত্তাংকুদি দুই তিন দিনের জন্যে বেড়াতে গেলে ব্যস আর পায় কে। কৈশলা আর থানুসান পেয়ে যায় অবারিত স্বাধীনতা। এমনই সুযোগে এক পূর্ণিমার রাতে দুজনে বের হয়ে পড়ে। ঘুরে বেড়ায় জ্যোৎস্নার ফুটফুটে আলোয়। তারপর যায় দূরের এক টেম্পলে। সেখানে গিয়ে দুজনে নাগেশ্বরী দেবতার নাম নিয়ে শপথ নেয় কখনো কোনো অবস্থায়ও বিচ্ছিন্ন হবে না দুজনে। পূর্ণিমার চাঁদকে সাক্ষী রেখে পণ করে, মরণ এলে একসঙ্গেই বরণ করে নেবে মৃত্যুকে।
এরপর কৈশলার ঘাড়ে হঠাৎ ভূত চাপে। বলে, ‘চল আমরা কাল্লাদি সেতুর ওখানটায় যাই। ’
থানুসান বলে, ‘সে তো বহু দূরে। ’
কৈশলা জেদ করে, ‘না, যেতেই হবে। গিয়ে কাল্লাদি লেগুনের সিঙ্গিং ফিশের গান শুনব। ’

কী জ্বালা। না পেরে থানুসান হাঁটতে শুরু করল। ঘণ্টা খানেক সময় লাগল। গোল পূর্ণ চাঁদটা ইতিমধ্যে মধ্য গগনে পৌঁছে যায়। ব্রিজটার পিলারের শান বাঁধানো স্থানে দুজনে বসে পা ঝুলিয়ে সিঙ্গিং ফিশের আওয়াজ শুনতে লাগে। অদ্ভুত এক মর্মর শব্দ লেগুনের গভীরতম পানি থেকে উঠে আসছে। ঠিক যেন বেহালার নিচু স্কেলের সুরে প্রাচীন কোনো লোকসংগীত।
কৈশলা জিজ্ঞাসা করে, ‘কীভাবে কোত্থেকে এমন ধীর লয়ে সংগীতের সুর বাজছে? ’
থানুসান বলে, ‘সামুদ্রিক জীব-বৈচিত্র্যের বহিঃপ্রকাশ এটি, হতে পারে মাগুর বা শিঙি মাছের আনন্দ উৎসব কিংবা হাজার হাজার ঝিনুকদের মুক্ত ছড়ানোর রিনিঝিনি সুর। ’
কৈশলা বলে, ‘না তুই ঠিক বলিসনি। লেগুনের তলদেশে পড়ে থাকা পাথর ও শিলাখণ্ডের সঙ্গে প্রতিনিয়ত জলস্রোতের আঘাতে আঘাতে এই নৈসর্গিক গুনগুন আওয়াজ সৃষ্টি হচ্ছে। ’
থানুসান কথা না বাড়িয়ে কৈশলার ব্যাখ্যাকেই মেনে নেয়।
এভাবে চুরি চুরি প্রেম করে দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর গড়িয়ে যেতে লাগে। দুজনাই স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিল বলে হাইস্কুলের গ্র্যাজুয়েট হতে পেরেছিল। এখন একটু বোধশক্তি এসেছে দুজনার মধ্যে। একদিন থানুসান প্রস্তাব দেয় দুজনা মিলে পালিয়ে যাওয়ার কিন্তু কৈশলা রাজি হয় না। বলে, ‘পালিয়ে গিয়ে কোথায় উঠব, কী খাব? তুমি তো পয়সা কড়ি রোজগার করো না। ’ এই কথা শুনে থানুসান ভেঙে পড়ে। ভাবে, সত্যি তো। আমি ওকে নিয়ে গিয়ে কোথায় রাখব, কী খেতে বা পরতে দেব? মনে মনে থানুসান অভিমানী হয়ে ওঠে, তাই কাজের চেষ্টা করতে থাকে। বিদেশে যাওয়ার কথা ভাবে। ঠিক করে মধ্যপ্রাচ্যে যাবে এবং অনেক কামাই রোজগার করে এনে কৈশলাকে বিয়ে করবে। নানিও বলে, ‘যা বিদেশে যেয়ে কাজকর্ম করে রুপি গোছা, তাহলে তোদের বিয়ে দিয়ে দেব। ’ কিন্তু কৈশলার মা কোনো অবস্থাতেই থানুসানের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা সহ্য করতে পারে না। রাগে একদিন কৈশলা ঘুমের বড়ি খেয়ে মরতে বসেছিল। তাতেও মার মন গলাতে পারেনি।
থানুসান এরই মধ্যে কাতার যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। দোহায় এক প্লাস্টিক মোল্ডিং ফ্যাক্টরিতে সাধারণ লেবারের দুই বছরভিত্তিক এক চাকরি পেয়ে সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়।
ফ্লাইটের আগের দিন কৈশলার এক কাজিন, ভাসুকি থারমারত্নামের যৌবনারম্ভ-পিউবারটি অনুষ্ঠানের রাতে দূর হতে থানুসান চোখের ইশারায় কৈশলার কাছ হতে বিদায় নেয়। সাথি হারানোর বিরহে থানুসান বাকহীন হয়ে পড়ে। অনেক কিছু বলার থাকলেও বিদায়ের আগে কৈশলার সঙ্গে কোনো কথাই বলা হয় না।
৩.
দোহায় মোল্ডিং ফ্যাক্টরিতে দিন-রাত পরিশ্রম করতে লাগে থানুসান। সুযোগ পেলে উইক এন্ডেও ওভারটাইম করে। ক্লান্ত শ্রান্ত বেচারা থানুসান কৈশলার সঙ্গে যোগাযোগ করারও সময় মেলাতে পারে না।
শুধু কাজ আর কাজ, ফ্যাক্টরির বয়লারের গনগনে আগুনের ফুলকির তাপ চোখেমুখে লাগে, মনে মনে ভাবে, মাত্র দুটি বছর দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। তারপর দেশে ফিরে মামির মুখোমুখি হয়ে প্রিয়দর্শিনী প্রাণপ্রিয় কৈশলার হাত চেয়ে নেবে।
কৈশলার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে বলে ওর মার চোখের ঘুম নেই। সারাক্ষণ কৈশলার বাবাকে অস্থির করে তোলে একটা ভালো ছেলের সন্ধান করতে। কৈশলার নিরীহ বাবা কোথাও তেমন খোঁজখবর করতে পারেন না। কৈশলার দাদিমা একদিন বলেই ফেলেন, ‘থানুসানের তো প্রায় আসার সময় হয়ে এল, আর কয়টা দিন অপেক্ষা করো না বাপু। ’ থানুসানের কথা শুনে খিঁচখিঁচিয়ে ওঠে কৈশলার মা। বলে, ‘কই, এত দিন হলো কোনো যোগাযোগ নেই, তার আশায় কী করে বসে থাকা যায়? ’
কৈশলাও বিষয়টি নিয়ে ভাবে। থানুসানের না একটা চিঠি বা না কোনো ফোন কল। কাতারে গিয়ে সে তো আমাকে ভুলেই গেছে।
একদিন সন্ধ্যাবেলা কৈশলার নানা-নানি এসে হাজির। রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর কৈশলা শুনতে পায় এক পাত্রর খবর এনেছেন নানা-নানি। নানা-নানিদের পাশের গ্রামের খানদানি বংশের ছেলে, তার ওপর ছেলে থাকে কানাডায়। কৈশলার মা তো এক লাফে রাজি। কৈশলাও কেমন যেন নির্বিকার হয়ে থাকল এ খবরে। শুধু সবার অজান্তে দাদিমার বুকটা হাহাকারে ফেটে গিয়ে চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠল। কৈশলাকে বিয়েতে রাজি আছে কি না, জিজ্ঞাসা করলে তিনি নির্লিপ্ত ও চুপ হয়ে থাকলেন। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে মুরুব্বিরা খুশিই হলেন।
ছেলে কানাডার টরন্টো থেকে সামার ভ্যাকেশন ও বিয়ে করার জন্য কাত্তাংকুদি এল। এরপর অ্যারায়ামপাথি গ্রামের কৈশলাকে পছন্দ করল। কৈশলা লাল রঙের কাতান শাড়ি পরে কপালে পবিত্র চন্দন কাঠের ছাইভস্ম লাগিয়ে চুলে গজরা ফুল দিয়ে সুন্দর করে সেজে বিয়ের পিঁড়িতে বসল। ছয় মাসের মধ্যে স্পনসরশিপের কাগজপাতি হয়ে গেলে কৈশলা শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজে চড়ে প্রথমে আবুধাবি এবং সেখান থেকে এমিরেটসের সরাসরি ফ্লাইটে টরন্টো পিয়ারসন এয়ারপোর্টে নামল।
বছর ঘুরতে না ঘুরতে এক সন্তানের মা-ও হয়ে গেল।
বেচারা থানুসান দু বছর পর ফিরে এল অ্যারায়ামপাথী। এসে দেখল তার সবকিছুই শেষ। সঙ্গে আনা ক্যারি-অন, সুটকেস আর সব বিদেশি গিফট দেখে মামি খুব খুশি হলেন। কৈশলার বিয়ের অনেক গল্প আরম্ভ করে দিলেন। জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে লাগলেন। থানুসানের কানে কোনো কথাই ঢুকল না। নানিমার গলা জড়িয়ে সে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল।
দোহার চাকরি পরের দুবছরের জন্যে রিনিউ হলেও থানুসান আর সেখানে গেল না। নানিমা মামা-মামি ওকে বিয়ে করার জন্য অনেক অনুরোধ করেও বিয়েতে রাজি করাতে পারল না। কানাডা থেকে কৈশলাও বারবার বিয়ে করার পরামর্শ দিলেও থানুসান শুনল না। নানিমা অসুস্থ হয়ে এক বছরের মতো বিছানাগত থেকে ওর মার কাছে স্বর্গে চলে গেলেন। মামা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বাড়িতেই থাকেন। মামা-মামি দুজনেরই বয়স হয়ে গেছে। দেখাশোনা করার লোকজন নেই, তাই সেই ভারটা থানুসান নিজেই নিজের ওপর নিয়ে নিল।
একলা থাকার কষ্টকে থানুসান কিছুতেই নিজেকে উপলব্ধি করতে দেয় না। পুরোনো ছেলেবেলার স্মৃতি মনে হয়ে কান্না আসতে চাইলেও তাকে রুদ্ধ করে দেয় এই বলে যে, বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও সরিয়ে দেয়। প্রতি চান্দ্রমাসের পূর্ণিমার রাতে থানুসান ছুটে যায় কাল্লাদি ব্রিজের লেগুনে সিঙ্গিং ফিশের গান শুনতে। সারা রাত সেখানেই বসে থেকে একা একা। লেগুনের গভীরে দলবাঁধা মাগুর ও শিঙি মাছদের গাওয়া বেহালার করুণ রাগের মতো কৈশলা ও থানুসানের অন্য রকম এক ভালবাসার প্রাচীন লোকসংগীত শুনতে থাকে থানুসান।
(লেখক কানাডার টরন্টোপ্রবাসী ৷ ফেডারেল গভর্নমেন্টের পাবলিক সার্ভিসেসে নিয়োজিত)