
কখনো চিন্তা করে দেখছেন, সেলফি কেন/কীভাবে এত জনপ্রিয় হলো? কারণ মানুষ তার নিজের কাছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সেই ব্যক্তির ছবি যখন মানুষ নিজে নিজেই তুলতে পারছে এবং ছবিসহ নিজেকে বহিঃপ্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে, মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার সেলফি নাম এই পদ্ধতি জনপ্রিয় হবে না কেন?
ধরুন, ১০-১২ জন বন্ধু মিলে কোনো জায়গায় বেড়াতে গিয়ে অনেক ছবি তুললেন বা কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে ফটোগ্রাফার অনেক ছবি তুলল। পরে আপনি কোন ছবিগুলো বেছে নেবেন? নিশ্চয়ই আপনার ছবি বা যে ছবিতে আপনি আছেন সেসব ছবি। তাই নয় কি? কারণ আপনিই আপনার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তাই, মানুষের ভালোবাসা পেতে বা জনপ্রিয় হতে মানুষকে সময় দেওয়া বা গুরুত্ব দেওয়া এতই বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে, এটি যেকোনো বয়সী মানুষের সঙ্গে কাজ করে মন্ত্রের মতো। লক্ষ্য করে দেখবেন, একটি ছোট্ট বাচ্চার সঙ্গে কথা বললে বা কিছু দেখালে বা সময় দিলে বাচ্চা কান্নাকাটি বন্ধ করে দেয়। সেই বাচ্চা আবার তার কাছ থেকে মনোযোগ সরালে কান্না শুরু করে দেয়। তাহলে চিন্তা করুন, একটি ছোট্ট বাচ্চা যদি গুরুত্ব পাওয়ার জন্য এতই কাঙালি হয়, তাহলে আপনি আমি সেই গুরুত্বের কতটুকু পূজারি!
কাজেই, আপনার কোনো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যদি আপনার কথা না শুনে বা বিধি-নিষেধ না মানে, মনে রাখবেন আপনি তাদের যথাযথভাবে গুরুত্ব দিতে পারছেন না। সে ক্ষেত্রে আপনি চাইলে শাসন করতে পারেন। শাসনে ভয় পেয়ে কিছুদিন ভালো চললেও পরে আর সেই ভীতি থাকবে না। বরং সেটা না করে আপনার বাচ্চা কী খেলে, কীভাবে খেলে সেটা জানতে চান। এমনকি তার সঙ্গে খেলতে যান। কারণ সেটা তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর, আপনি যখন তাকে গুরুত্ব দেবেন, সেও আপনার কথায় গুরুত্ব দিয়ে আপনার কথা শুনবে, মনোযোগী হয়ে পড়াশোনা করবে এবং বাধা-নিষেধ মানবে।
আমার অনেক সহকর্মী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বলতে দেখেছি, তাঁরা ক্লাসে গেলে ছাত্র-ছাত্রীরা এত কথা বলে যে, তাঁরা কীভাবে পড়াবেন সেটাই বুঝতে পারেন না। আমি তাঁদের বলেছি, আপনি কি একটিবারও ভেবে দেখছেন, ছাত্র-ছাত্রীরা যে কথাগুলো বলছে সেগুলো তাদের কাছে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ? আপনি শিক্ষক হয়ে যদি সেটা না বোঝেন, তবে ছাত্র-ছাত্রীরা আপনাকে বুঝবে কীভাবে? অনেকেই জানতে চেয়েছেন আমি ক্লাসে গেলে কী করি? আমি বলেছি, আমি ক্লাসে গেলে তাদের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করি, তাদের গল্পতে আমাকেও রাখতে বলি। মাঝে মধ্যে ১ মিনিটের জন্য তাদের গল্প করার সুযোগও দিই। কারণ আমি বুঝি, ক্লাসের ফাঁকে একটা ছাত্র তার পাশের ছাত্রের সঙ্গে একটা কথা বলা কতটুকু জরুরি। ফল? ক্লাস খুবই নীরব থাকে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোবাসা পাওয়া যায় খুবই সহজে। এই পদ্ধতিটি কেন এত ভালো কাজ করে? কারণ এতে তারা গুরুত্ব পায় বলে!
অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে দেখেছি এলাকার সবাই তাঁদের শ্রদ্ধা করেন এবং তাঁদের কথা মেনে চলেন। কিন্তু, তাঁদের স্ত্রী তাঁদের কথা শোনেন না। কেন? উত্তর খুবই সহজ। কারণ তাঁরা স্ত্রীকে ঠিকমতো গুরুত্ব দিতে পারছেন না। আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, তাঁদের স্ত্রী পায়ে আলতা দিলে কেমন লাগে তা শোনা, তাঁদের স্ত্রীর কাছে সেসব গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ২-৩টা স্কুলের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপনের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই, আপনি যদি এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হোন, তবে চিন্তা করুন আপনার স্ত্রীকে ঠিকমতো গুরুত্ব দিচ্ছেন কিনা। যদি না দেন? ভাগ্য ভালো হলে বিবাহ-বিচ্ছেদ হবে না; তবে বাজি রেখে বলতে পারি, আপনার জীবনে অশান্তি থাকবে চিরকাল!
বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি, অভাব-অনটন আর মতামতের হাজারো অমিল থাকা সত্ত্বেও দেখেছি, অনেক পরিবারে ভাইয়েরা একসঙ্গে মিল-মহব্বতে বসবাস করেন। কিন্তু, সমস্যাটা বাঁধে তখনই, যখন তারা বিয়ে করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তারা আলাদা হয়ে যান। এসব সমস্যার পেছনে যখন ঘরের নতুন বউদের সম্পূর্ণই দোষারোপ করা হয়, তখন আমি হাসি। প্রশ্ন করতে চাই, আপনারা পরিবারের নতুন অতিথিকে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন? কতজন শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের ঘরের নতুন বউকে নিজ মেয়ের মতো দেখেন? কতটা পারিবারিক সিদ্ধান্তে নতুন অতিথিকে মূল্যায়ন করেন? যদি তাই করেন, তবে কোনো মেয়েরই সাধ্য নেই, তার স্বামীকে নিয়ে একা ঘর করার চিন্তা করার। কারণ? মানুষ মায়ার কাঙালি আর গুরুত্বের পূজারি।
অনেক মানুষের মুখে শুনেছি, ঘরের কেউ বৃদ্ধ হলে তাঁর নাকি জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পায় এবং বেশি কথা বলেন যা কারওই সহ্য হয় না। কিন্তু কতজন মানুষ সারা দিনের ব্যস্ততার পর ঘরে এসে একজন বৃদ্ধ মানুষের খোঁজ-খবর নেন? বিভিন্ন পারিবারিক সিদ্ধান্ত ও আচার-অনুষ্ঠানে সেসব বৃদ্ধ মানুষের মতামতের গুরুত্ব দিয়েই দেখুন, চিত্র বদলে যাবে।
এই গুরুত্ব দেওয়া কীভাবে এত ভালো কাজ করে? ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। আপনি যদি ফেসবুকে কোনো ছবি বা স্ট্যাটাস দেন আর কেউ যদি তাতে লাইক দেয়, আপনার খুবই খুশি লাগে। তাই নয় কি? কারণ? মানুষ আপনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে। লক্ষ্য করে দেখছেন কি, ফেসবুক কোথাও কোনো ডিসলাইক বাটন রাখেনি। কেন? আপনাকে গুরুত্ব দেওয়া না হতে পারে সেই ভয়ে। আর আপনাকে সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষের মর্যাদা দিতে পারছে বলেই ফেসবুক পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হতে চান? মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দিন। মানুষই আপনাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষে পরিণত করবে।