অনু গল্প

দেখতে দেখতে ফেব্রুয়ারি মাসও শেষ হয়ে গেল। প্রতিবছরই এমনি করে ফেব্রুয়ারি আসে। আমরা নানা উৎসবে রঙিন হয়ে উঠি। শুরু হয় অমর একুশে গ্রন্থমলা। চারদিকে বসন্তের ফাগুন হাওয়ার সঙ্গে যোগ হয় আনকোরা নতুন বই আর সুবাসিত তাজা ফুলের গন্ধ। এমন আনন্দময় সময়ে আমরা একরকম ভুলে থাকি শহীদদের রক্তের স্বেদ গন্ধ। ভুলে থাকি হুমায়ূন আজাদ, অভিজিৎ রায় আর দীপনদের কথা। যারা একসময় অমর একুশে বইমেলায় প্রাণসঞ্চার করতেন।

কিন্তু আজ তাঁরা কোথায়! আলোর মশাল ধরা মানুষগুলো চলে যাচ্ছেন অন্য ভুবনে। মহামারি এসে হানা দিয়েছে বিশ্বজুড়ে। চারদিকে মৃত্যুশোক! এত আঁধার আগে কখনো দেখিনি। একে একে সব আলো যেন নিভে যাচ্ছে। আমরা যেন কেবলই অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছি ঘোর অন্ধকারে…!

তবে এর মধ্যেও দেখা যায় জীবনের আশ্বাস। এসে গেছে ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন। শুরু হল উত্তাল, রক্তে ভেসে যাওয়া, আগুন ঝরা মার্চ! ১৯৭১ সালের এই মার্চে বাংলার জনপদে জ্বলে উঠেছিল স্বাধীনতার অনির্বাণ শিখা। সেই অনির্বাণ শিখাতে কেবল আত্মাহুতি দিয়ে নয়, পুড়ে নিঃশেষ হয়ে নয়, আমরা যেন আরও শুদ্ধ হয়ে, আরও ধীমান হয়ে, আরও আলোকিত হয়ে উঠতে পারি। এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার, আমাদের প্রত্যাশা—শেলী জামান খান

ফেয়ারিটেল

রুবানা ফারাহ আদিবা

পুলকের বয়স চব্বিশ। সুদর্শন এক তরুণ। পড়ালেখার প্রথম ধাপ শেষ করে সবে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেছে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে বলে মায়েরও শান্তি।

পুলকের অন্যতম শখ অ্যান্টিক ক্লক সংগ্রহ। বিভিন্ন শহরের আনাচে-কানাচে অ্যান্টিক শপ ঘুরে ঘুরে পুরোনো ঘড়ি দেখে সে। কল্পনায় টাইম ট্রাভেলের স্বাদ নিতে মন্দ লাগে না ওর।

গতকাল বিকেলে পুরোনো ঢাকার সরু গলি ধরে একটি ভুতুড়ে পোড়া বাড়ি গিয়েছিল। চড়া দামে কিনে নিয়ে এসেছে ছোট্ট একটা টেবিল ক্লক, নাম ফেয়ারিটেল! অফিস থেকে ফিরে যত্ন নিয়ে ঘড়িটা পরিষ্কার করে দম দিয়ে রাখল পুলক। অফিসে ব্যস্ততা এবং বাড়ি ফিরে ঘড়ি নিয়ে সূক্ষ্ম কাজ কারবারে ক্লান্ত পুলক চোখ বুজেই নক আউট।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল মিউজিক্যাল অ্যালার্মে! বেজে চলেছে ‘ফিওর এলিস’! হুড়মুড় করে চোখ কচলে ঘড়ির দিকে তাকাতেই পুলক বিস্মিত। সে তো ঘড়িতে কোনো অ্যালার্ম সেট করেনি। মেঝে ভেসে যাচ্ছে দুধসাদা জোছনায়! আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক পরি!

সম্মোহিত পুলক হাত রাখল পরির ডানার শ্বেতপালকে। মেঘের মতো নরম জমিনে ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে পুলকের। ডিমের কুসুমের মতো উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে পুলকের শিরা উপশিরায়। পরির চিবুকের চৌকাঠ স্পর্শ করতেই খিলখিল হাসির শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে মুহূর্তেই চৌচির। ঘর বদলে গেল জমকালো বলরুমে। স্পটলাইট মাঝে মাঝে এসে আছড়ে পড়ছে জুটিদের ওপর। ঘুরে ঘুরে নাচছে ‘বিউটি অ্যান্ড দা বিস্ট’, ‘সিনড্রেলা’, ‘প্রিন্স চার্মিং’, ‘স্নো হোয়াইট’!

পুলক ভেসে চলেছে ফিওর এলিসের সুরমূর্ছনায়। ডুবে যাচ্ছে পরির সুগন্ধী ঠোঁটে। অনাবিল প্রশান্তিতে, ভালো লাগায়, রুমঝুম, গুনগুন গুঞ্জনে।

পরদিন সকালে পুলকের ঘুম ভাঙল মায়ের ডাকাডাকিতে। অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে মায়ের উত্তেজনা চরমে। গত রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়ায় একটু হাসিই পেল!

অফিসে যাওয়ার সময় গেটের কাছে জটলা। দারোয়ান ভাই প্রলাপ বকছে। কাল রাতে নাকি পরি নেমেছিল। তার হাতে ধরা একটা ভাঙা পালক। সবাই বলছে, ওটা উড়ন্ত রাজহাঁসের ডানা থেকে খসে পড়েছে।

পরে পুলক ইনসমনিয়াক হয়ে গিয়েছিল। অন্ধকার ঘরে চুপচাপ বসে সে মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে আর হাওয়ায় মিশে যায় ফিওর এলিস।

মায়া জাদুঘর

কেয়া ওয়াহিদ

চৌচালা টিনের ঘর, রাতভর চালের ওপর কুয়াশার টাপুরটুপুর খেলা। বাতাসের ঝাপটায় আতাফল গাছের পাতাদের শিশির কুড়ানির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমের কোলে হারায় লেখিকা সায়মা নূর। শালু কাপড় আর শিমুল তুলার আদুরে ওম ওম ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই সকালের রোদ এসে জাগিয়ে তোলে শৈশব। উঠোনে তোলা ছাউনিবিহীন ক্ষণস্থায়ী রান্নাঘর, খোলামেলা জায়গা বলে চুলার চারপাশ ঘিরে সবাই বসতে পারে। কেউ জলচৌকি পেতে, কেউবা মোড়া পেতে বসে আম্মার হাতের সকালের নাশতা খাওয়ার আয়োজনে। এক চুলায় রসের নাশতা আরেক চুলায় খোলা পিঠা, খাওয়া আর মধুর খুনসুটি চলতে চলতে কৈশোর এসে পৌঁছে প্রৌড়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে।

আসন্ন বইমেলায় সায়মা নূরের ১৮তম বই বের হচ্ছে। বই প্রকাশের আনন্দে যোগ দিতে তিনি ঢাকায় যাচ্ছেন টরন্টো থেকে। তিথির সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। তিনি খুব ভালো একজন প্রতিবেশীই নন, অনেকটা বড় বোনের মত। তাঁকে এয়ারপোর্টে রাইড দেওয়ার দায়িত্ব নিল তিথি সানন্দে।

বইয়ের নাম কেন ‘জাদুঘর’ দিলেন?—এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে গিয়ে লেখিকা সায়মা নূর তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করেন। মায়ের প্রতি, মাটির প্রতি, শৈশবের প্রতি যে দুরন্ত টান, এটা তাঁর কাছে একটা জাদুঘরের মতো। কী যেন একটা মায়ার ঘোরে বারবার হারিয়ে যাচ্ছে, দেখেও শেষ হচ্ছে না, লিখেও যেন শেষ হচ্ছে না। বেরিয়ে আসলেও আবার ফিরে যাওয়ার অমোঘ টান।

স্মৃতিজড়ানো এই জাদুঘরের প্রতিটি দেয়াল জুড়ে থাকা সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা।

জাদুঘরের গল্প শেষ হতে না হতে তিথির গাড়ি বহির্গমন লেনে ঢোকে। গাড়ি থেকে নেমে দুজনে সুটকেসগুলো ট্রলিতে ওঠায়। সায়মা নূর তিথিকে জড়িয়ে ধন্যবাদ জানায় রাইড দেওয়ার জন্য। তিথি মিষ্টি হেসে বলল, কবে ফিরবে জানিও, আমি নিতে আসব। ট্রলি টানতে টানতে লেখিকা এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকে গেলেন। বিদায়ী বিষণ্নতা পুরো গ্রাস করার আগে তিথি গাড়িতে ফিরে এল। পাশের সিটে কেউ নেই, তবুও যেন কেউ আছে। তিথির মৌন কথন-আমারওতো একটা জাদুঘর আছে, কত দিন দেখা হয় না। ব্যস্ত হাইওয়েতে তিথির গাড়ি চলছে। ছলছল চোখ সামলে ড্রাইভ করছে, গান চলছে অন্যমনস্ক—

‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই’

তুষার ফুল

পলি শাহীনা

মাঝরাতে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে প্রবল তুষার ঝড় বইছে। ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকি। ঘুম আর আসে না। মোল্লার দৌড় যেমন মসজিদ পর্যন্ত, তেমনি আমার মত খোপবন্দী মানুষের দৌড় হাতের মোবাইল ফোন পর্যন্ত। আদতে এ বন্দী জীবনে অন্য কোনো উপায়ও নেই। রাত প্রায় শেষের দিকে। মোবাইল ফোনটি হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকে দেখি, নিউজফিড ডুবে আছে হলুদ-বাসন্তী রঙে। দিনপঞ্জিকা না দেখেও বুঝলাম, আজ পয়লা ফাল্গুন। ঋতুরাজ বসন্ত এসে গেছে। নিউজফিড স্ক্রল করে বন্ধুদের একের পর এক ছবি দেখছি, গল্প পড়ছি আর বুকের গহিনে একটা অদ্ভুত শূন্যতা বোধ করছি। এমন দিনে কার তরে যে প্রাণ পুড়ছে, কী জানি!

বরফের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়লেও বাইরের পৃথিবী ততক্ষণে ফরসা হয়ে গেছে। ‘বসন্ত এসে গেছে’-লগ্নজিতার কণ্ঠে প্রিয় গানটি শুনছি আর ভাবছি, এই ইট কাঠের শহরে বসন্ত কি এল? এ গানটি যখন শুনি, তখন আমার কোনো কাজ কিংবা অকাজ কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। ধোঁয়া উড়া কফি হাতে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। বাতাসের শরীরজুড়ে কোনো এক চেনা ঘ্রাণ, চেনা দৃশ্য আমায় তাড়িত করছে। অবিরত তুষার ফুল ঝরছে। জানালার বাইরে দু-হাত বাড়িয়ে তুষার ফুলদের আদরে আদরে ছুঁয়ে দিই। তুষার ফুলও আমাকে ছুঁয়ে যায় সোহাগে। তুষার ফুল আর আমি, আমরা একে অন্যের দিকে অপলক চেয়ে থাকি। আমার চোখে তখন কাঞ্চনজঙ্ঘার আলো। তুষারের রসালো স্পর্শে চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠে। অন্যরকম একটা ভালো লাগায় বুঁদ হয়ে থাকি।

বরফাচ্ছাদিত এই শহরে কোকিল ডাকেনি, ফুল ফোটেনি, আমের মুকুল আসেনি। তুষার ফুলে প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে আমি বসন্ত উদ্‌যাপন করি। জীবন যখন যেমন, সমস্ত হাহাকার ভুলে আনন্দের উৎস খুঁজি। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে চোখ বুঁজে দক্ষিণা উদাস হাওয়ায় ভেসে ভেসে সর্ষে খেতের আইল ধরে আমি চলে যাই, ছোটবেলার খেলার সাথি সুবর্ণাদের আম বাগানে। উবু হয়ে আমের মুকুলের ম ম সৌরভ নিই দুই সখী প্রাণভরে। গলা ছেড়ে একসঙ্গে গাইতে থাকি—

‘ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে’

শিক্ষা

সালমা মঞ্জুলিকা

ঊর্মির সঙ্গে কথা শেষ করে আমি ইলাকে ফোন করলাম।

হ্যালো, ‘ইলা? জানিস কি সাংঘাতিক একটা কাণ্ড ঘটেছে? রুপুর মেয়েটা তো মা-বাপের মুখে চুনকালি মেখে ড্রাইভারের সঙ্গে ভেগে গেছে!’

ঘটনা শুনে ইলা ছি ছি করতে থাকে।

‘জানিস, রূপুর মেয়ের এমন কুরুচির কথা ভেবে ঘেন্নায় আমার বমি পাচ্ছিল।’

বিচক্ষণের মত বলি, ‘বুঝলি, সব হলো মায়ের দোষ। সুশিক্ষা দিয়ে বড় করেনি মেয়েকে। সোমত্ত মেয়ে ঘরে রেখে রাস্তায় ঘুরে সমাজ সেবা করে বেড়ায়! দেখ, এখন সমাজ তোর সেবার কি প্রতিদান দেয়।...ছি ছি ছি, আমার মেয়ে এমন কাজ করলে আমি আগে মেয়েকে বিষ খাইয়ে মারতাম, তারপর নিজে গলায় দড়ি দিতাম।’

প্রায় আধঘণ্টা ধরে ইলার সঙ্গে মিলে রূপু আর ওর মেয়ের ভুলের পোস্টমর্টেম করলাম। কথা বলা শেষ করতেই সাজ্জাদ আমার দিকে তীব্র ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘কী এত আনন্দ পাও তুমি এভাবে জনে জনে ধরে ধরে মানুষের সমালোচনা করে? এই ভুলতো আমাদের মেয়েও করতে পারে।’

সাজ্জাদের দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, ‘আমার মেয়েকে আমি এই শিক্ষায় বড় করিনি, বুঝেছ? যা সত্যি তাই বলি। সত্যি বলতে আমি কখনো ভয় পাই না।’

বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে মেয়ের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। অসময়ে মেয়েটা বিছানায় শুয়ে আছে। দুদিন ধরে কলেজেও যাচ্ছে না। মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘কিরে এখনো ভাত খাসনি? কি শুরু করেছিস আজকাল? ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করিস না।’

রুহি নীরবে আমার দিকে তাকাল। চোখের কোণে কালি! মুখ চোখ কেমন বসে গেছে! কী যে হলো মেয়েটার!

আচমকা রুহি আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না জড়ানো গলায় বলল, ‘আমি একটা বড় রকমের ভুল করে ফেলেছি আম্মু। আমাকে বাঁচাও প্লিজ।’

আতঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি করেছিস রুহি? কি হয়েছে তোর?’

রুহি উত্তর না দিয়ে হেঁচকি তুলে কাঁদতে থাকল। আমার বুকের ভেতরটা শুকিয়ে আসছিল। ওর বাহু ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, ‘রুহি কি হয়েছে? বল আমাকে!’

‘মাফ করে দাও আম্মু। আমি, আম্মু আমি...আমি কনসিভ করেছি!’

পাথরের মূর্তির মতোই ঠাঁই বসে রইলাম। কানে যেন গরম সিসা গড়িয়ে পড়ল!

সাদা জামা

দীপক মান্না

অর্ণব অফিস ফেরার পথে এসপ্ল্যানেডের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে চোখ চলে যায় একটা রেডিমেড গার্মেন্টসের দোকানে। ভেতরে হ্যাঙারে ঝুলছে একটা সাদা জামা। অর্ণবের জামাটা পছন্দ হয়। মাঝে মাঝে ভীষণ ইচ্ছে হয় সাদা জামা পরতে। কিন্তু কলকাতার ট্রামে বাসে নিত্যদিন চলাফেরা করলে সাদা জামা একদিনের বেশি পরা যায় না। কিন্তু এই জামাটা তার ভীষণ কিনতে ইচ্ছে হচ্ছে। সাদা জামার ঐতিহ্যই আলাদা। অর্ণব মনস্থির করে জামাটা কিনেই ফেলল। মনে মনে ভাবল, কাল অফিস যাওয়ার পথে নিশ্চয়ই সবাই তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে।

অর্ণব আজ পার্কস্ট্রিটে নেমে ধর্মতলা পর্যন্ত হেঁটেই যাবে মনস্থির করে। তাহলে সবাইকে তার জামাটা দেখানো যাবে। খুব সুন্দর করে চুলটা আঁচড়ালো। জুতোটা ভালো করে পালিশ করল। বেরোনোর আগে ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিজেকে ভালো করে দেখে নিল। বেশ স্মার্ট লাগছে আজ।

সে বাড়ির সবার সামনে দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেল। মেট্রোর অন্য যাত্রীদের দিকে একবার আড়চোখে তাকায়। দেখে, কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে কিনা। তেমন কাউকে চোখে পড়ল না। মনটা ভারাক্রান্ত হল। তবু পার্কস্ট্রিটে নামল। তারপর ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে অফিসের দিকে। মনের মধ্যে কেমন যেন ক্ষোভ জন্মাতে লাগল। এখনকার মানুষেরা ভালো জিনিসের কদরই বোঝে না।

এসব ভাবতে ভাবতে অর্ণব ধর্মতলা ক্রসিং পার হতে যাবে এমন সময় একটা স্কুলের ছেলে রাস্তা পার হতে গিয়ে ছুটে আসা মিনিবাসের সামনে পড়ে যায়। অর্ণব ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তার পাশে জমে থাকা জলকাদার ওপর গিয়ে পড়ে। নোংরা জলের ছিটে লাগে সাদা জামায়। শরীরের কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে কেটে গিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। চারদিক থেকে লোকজন ছুটে আসে। ছেলেটা বেঁচে যায়। অর্ণবকে সবাই বাহবা জানায়। কয়েকজন সাদা জামাটার উজ্জ্বলতার কথাও বলাবলি করে। মোবাইলে ছবি তোলে অর্ণব আর ছেলেটির। তারপর সেগুলো ফেসবুক, টুইটার হয়ে খবরের কাগজ, টিভির পর্দায় ছড়িয়ে পড়ে। জামাটার কয়েক জায়গায় একটু জলকাদা লেগে গেলেও মনে মনে বেশ খুশি। কারণ, একসঙ্গে এত মানুষ তার জামাটার দিকে তাকাবে সে ভাবতেই পারেনি।

কুইচ্চা

আফরোজা মামুদ

তিথির অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো, সে আশা করছে আমি তাকে ‘সরি’ বলি। তার আশায় আমি গুঁড়েবালি। এক বালতি নোংরা পানি ঢেলে দিয়ে আবারও তাকে ‘কুইচ্চা সাপ’ বললাম! আমি নিশ্চিত, সাপ চিনলেও ‘কুইচ্চা’ কি জিনিস তিথি জানে না। এটি মাছ না সাপ, তাও সে জানে না! সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত সে গুগল আর ইউটিউব ঘাঁটাঘাঁটি করে কুইচ্চার অর্থ বের না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত পাল্টা জবাব সে দিতে পারবে না। আমি সে সুযোগ নিলাম। সুইজারল্যান্ড থেকে আনানো ৩০০ ডলারের সিগারেটের প্যাকেটগুলো বাথরুমের বালতিতে সে চুবিয়ে নষ্ট করেছে। তাকে এত সহজে ছেড়ে দেওয়া যায় না।

‘কুইচ্চাকে তো কুইচ্চাই বলব! গোলাপ ফুল তো আর বলব না! তুমি কুইচ্চার মতো কালো ঘিনঘিনে একটা সাপ! তোমার গায়ের কালো রঙের সঙ্গে কুইচ্চা নামটা ভালো মানায়। তোমার উচিত এখন তোমার নাম পাল্টিয়ে কুইচ্চা রাখা। সরি, কুইচ্চাকে শুদ্ধ উচ্চারণে কি বলে আমি জানি না! আর জানলেও তোমাকে বলতাম না! তোমাকে এখন আমার ভয়ংকর রকম অসহ্য লাগছে! তুমি এক্ষুনি আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাবে! রাইট নাও! আই উইল নট লিভ উইথ অ্যা কুইচ্চা সাপ লাইক ইউ!’

সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে টেবিল ভর্তি খাবার দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। কিন্তু খেতে গিয়ে দেখি, সব বাইন মাছের তরকারি! তাও আবার লতি, কচু, উচ্ছের মতো বেমানান সবজি দিয়ে রান্না করা! তিথির এ ধরনের রান্নার প্রতিভায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও খেয়ে নিলাম।

শোয়ার ঘরে বালিশে হেলান দিয়ে আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরালাম! তিথি পাশের ঘরে। বিছানায় কেমন যেন একটা আঁশটে দুর্গন্ধ। উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখি, তিথির শোয়ার জায়গাটায় কুচকুচে কালো কিছু একটা লম্বা হয়ে শুয়ে আছে।

চোখ কচলে ভালো করে খেয়াল করলাম। মরা কুইচ্চা! সড়াৎ করে এক লাফে বিছানা ছাড়লাম। বাইন মাছ তরকারি আর কুইচ্চা রহস্য সম্ভবত ধরতে পেরেছি।

তিথি! তিথি!

বলো শুনছি!

কি শুরু করেছ এসব?

আমি কই! শুরু তো করলে তুমি! সত্যিকার কুইচ্চার সঙ্গে সংসার!

মানে?

মিসেস কুইচ্চার সঙ্গে বাসর রাত মোবারক হোক মি. কুইচ্চা। গুড নাইট অ্যান্ড হ্যাভ এ নাইস স্লিপ!

নির্ঝরের ক্যানভাস

অর্ঘ্য রায় চৌধুরী

নির্ঝর ইসলাম একা লোক, ছবি আঁকা ওর শখ, আর ফ্রিল্যান্সে প্রচ্ছদশিল্পীর কাজ করে। দক্ষিণ কলকাতায় একটা এক কামরার ফ্ল্যাট, বড়সড় একটা ঘরের এক কোণে ওর আঁকার সরঞ্জাম রাখা, ওই ঘরেই একদিকে খাট। ওর এই সব কাজ করে মোটামুটি চলে যায়। মাঝে মাঝে ছবি বিক্রি হলে একসঙ্গে অনেকটা টাকা হাতে আসে।

গ্রামের বাড়ির পাট চুকে গেছে বহুদিন হলো। বাবা-মাও চলে গেছে, এক বোন দেশের বাইরে থাকে। ও ছোট থেকেই মিশুক না বলে বন্ধুও সেরকম নেই। শুধু অভি মাঝে মাঝে খোঁজ নিতে আসে।

এখন যে কাজটা নিয়ে মেতে আছে, সেটার আইডিয়া পেয়েছিল অজন্তার গুহাচিত্র থেকে। সেখানেই এক দেবকন্যার ছবি দেখে ওর ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। রোজ রাতে ও সেই ছবির মধ্যে নিমগ্ন থাকে।

ছবিটা যেন কথা বলতে থাকে, বিভঙ্গের ইশারায় কাছে টেনে নেয়।

এ কথা শুধু ও অভিকেই বলেছে। অভি বলেছে ‘একা থাকতে থাকতে তোমার মাথাটা গেছে।’

এক মধ্যরাতে ও ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ায়, সেই দেবকন্যার মুখে আশ্চর্য এক হাসি। চোখের পাতায় আবহমানের ডাক। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে বিলোল আহ্বান।

ও শুয়ে পড়ে, কিছুক্ষণ পর একটা অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে যায়। ওর ওপর ঝুঁকে আছে এক অনিন্দ্যসুন্দর মুখ, অস্ফুটে বলে ওঠে, ‘চলো আমার সঙ্গে, ছবির দেশে ছবির মতো করে, একসঙ্গে থাকব দুজন।’

দিন সাতেক পর অভি ও পাড়াপ্রতিবেশীরা যখন পুলিশ নিয়ে দরজা ভেঙে ঢোকে, দেখে ক্যানভাসে এক অপূর্ব নর্তকী, তার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে নির্ঝর।

দুজনেরই চোখ আর ঠোঁটের হাসিটা আশ্চর্যভাবে জীবন্ত।

নেভিগেশন

খায়রুল আনাম

মহিমরা বেরিয়েছে ডাক্তারের অফিসের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টে হাজির হতে। তিশা, মানে মহিমের বউ, তাকে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে দিয়ে একবার দেখানো দরকার। ইদানীং নাকি কী সব নতুন জটিলতার সৃষ্টি হয়ে তার দেহমনে অনেক কষ্ট দিচ্ছে। কথাটা শোনার পর থেকে তিশার মতো মহিমও ভেতরে-ভেতরে বেশ উদ্বিগ্ন। কিন্তু ওরা কেউ কাউকে সেটা বুঝতে দিতে চায় না। চোখে চোখ পড়ে গেলে দুজনেই আলতো করে মৃদু হেসে একপাশে চোখ ফিরিয়ে নেয়। ডাক্তারটার হাতযশ বেশ ভালো, তাই অফিসে খুব ভিড়। অনেক চেষ্টা করে একজন কমন ফ্রেন্ডের মারফত আজকের এই অ্যাপয়েন্টমেন্টটা ম্যানেজ করা গেছে।

গাড়িতে ঢোকার আগে তিশা বলে উঠল, ‘আজকে আমি গাড়ি চালাব। সময়মতো পৌঁছানো খুব জরুরি। অনেক কষ্টে অ্যাপয়েন্টমেন্টটা জোগাড় হয়েছে। কোনোমতেই মিস করা যাবে না।’ কিন্তু ডাক্তারের অফিসে গিয়ে বাধল একটা উটকো ঝামেলা। ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘দেখুন, ফিজিক্যালি চেক করে কেমন একটা ল্যাম্প ল্যাম্প ফিলিং হচ্ছে। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য বরং আপনি একটা ম্যামোগ্রাম করিয়ে নিন। দুর্ভাগ্য, আমাদের অফিসের মেশিনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছে। আড়াই মাইল দূরে শহরের উল্টো দিকে আর একটা ক্লিনিক আছে। ওদের লেটেস্ট মডেলের মেশিন এসেছে মাত্র মাস ছয়েক আগে। আমি টেলিফোন করে দিচ্ছি। আপনারা এখনই বেরিয়ে পড়ুন।’

এ রাস্তা, ও রাস্তা, সে রাস্তা করে যখন তারা সেই নতুন ক্লিনিকে পৌঁছাল, তখন অফিস প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ডাক্তার সাহেব ও টেকনিশিয়ান, দুজনেই মহাবিরক্ত। নতুন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আবার একদিন আসার কথা বললেন। বহু অনুনয়, বিনয়, উৎকণ্ঠা প্রকাশ ও কাকুতি–মিনতি করার পর অফিসের ওরা উপরোধে ঢেঁকি গিললেন। কাজ সারার পর বাড়ি ফেরার পথে তিশা ভীষণ রেগে মহিমকে জিজ্ঞেস করে, ‘হাতে সময় অত কম ছিল, অথচ আমি বারবার রাস্তা ভুল করে একটা রাস্তা থেকে আর একটাতে চলে যাচ্ছিলাম, সেসব দেখেশুনে তুমি কিচ্ছুটি বললে না কেন?’

–কি বলব?

–যে তোমার রাস্তা ভুল হচ্ছে। ওভাবে একের পর এক একবার বামদিকে, একবার ডানদিকে মোড় না নিয়ে সোজা চল।

–কিন্তু, গাড়িতে উঠেই তো তোমার প্রথম কথা হয়, ‘কোনো কথা না, সোজা চালিয়ে যাবে। যেভাবে বলব ঠিক সেভাবে। কারণ এ শহরের সব রাস্তাই আমার খুব ভালোভাবে চেনা। আমি তোমার মতো সদাই গুলিয়ে ফেলা একটা আনস্মার্ট ভুলো ড্রাইভার না। এতবার শুনতে শুনতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেছে, রাস্তা তো ছার, এমনকি হঠাৎ সামনে একটা গাড়ি এসে পড়ে অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার উপক্রম হলেও আমার মুখ খোলা উচিত হবে না।