অনু গল্প

জীবন বড় বেশি চড়াই-উৎরাইময়। কখনো খুব মসৃণ, আনন্দময়; আবার কখনো ভীষণ ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ। কিন্তু যা-ই আসুক সামনে টিকে থাকতে হলে, আমাদের তা মেরুদণ্ড শক্ত করে মোকাবিলা করতে হবে। জিততে হবে যুদ্ধ করে। হার-জিত যাই আসুক, মেনে নিতে হবে। এটাই জীবন।

বৈশ্বিক মহামারি এখনো চলমান। শীতের আগেই দ্বিতীয় দফায় আবার সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করেছে কোভিড-১৯। এখনো বিপন্ন মানুষের জীবন। এবারও যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে বেকায়দা অবস্থানে। এর অন্যতম কারণ যুক্তরাষ্ট্রের হীরক রাজা। হার-জিতের নিয়মটি মেনে নিতে ব্যর্থ হলেন বলেই দড়ি ধরে টেনে নামাতে হচ্ছে এই পরাজিত মানুষটিকে।

নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য প্রাণপণে উত্তরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবুও নানা কারণে ভাইরাস জিতে যাচ্ছে, পরাজিত হচ্ছে মানুষ। প্রথম দফা আক্রমণে যারা আক্রান্ত হননি, দ্বিতীয় দফায় তাদের অনেকেই সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন।

এই অশুভ সময় কাটিয়ে উঠতেই হবে। বাঁচাতে হবে মানব সভ্যতাকে।—শেলী জামান খান

নদী ও গুঁড়ি

রাজিয়া নাজমী

রুমি; মায়ের শখ করে রাখা নাম। সেই নামের জোরেই হয়তো রুমি কবিতা পাগল, বিশেষ করে প্রেমের কবিতা। যদিও সে কবিতা লেখেও না, পড়েও না তেমন। তবে সে কবিদের আসরে নিয়মিত যায় কবিতা পাঠ শুনতে।

রুমির কবিতার বই নিয়ে ঘুরতে ভালো লাগে। পাতা উল্টে দেখতে ভালো লাগে। বুকে নিয়ে ঘুমাতে ভালো লাগে। খুঁজে খুঁজে সে কবি বন্ধু জুটিয়ে নেয়। তাঁদের কবিতা সে মন দিয়ে শোনে। মনে মনে ভালো লাগার লাইন আওড়ায়।

ইদানীং তার এক তরুণ কবি বন্ধু হয়েছে। রুমি তার একটি কবিতা বারবার শোনে। ‘তুমি যেন এক ছিপছিপে নদী/ আমায় ভাসাও-আমায় ডোবাও তোমার প্রেমের ঢেউয়ের মাঝে।’ আহা; কী শিহরণ জাগে তার মনে।

দিন যায়, মাস যায়। তার আর অন্য কোনো কবিতা ভালো লাগে না। বিবাহিত রুমির কাছে জগৎ-সংসার তুচ্ছ লাগে। সে বেছে নেয় ছিপছিপে এক নদীর পাড়। পাগলপ্রায় রুমি দু হাত দিয়ে নদীকে জড়িয়ে ধরতেই নদী তাকে টেনে নিয়ে গেল। ছিপছিপে নদীর বুকে তলিয়ে যেতে যেতে তার মনে পড়ল সে সাঁতার জানে না। নদীর ঢেউ তাকে নিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে সে চিৎকার করে বলল, ‘আমি মরে যাব নদী। মেরো না, আমি যে তোমায় ভালোবাসি।’

রুমির শ্বাসরোধের মুহূর্তে কোথা থেকে মোটা একটা গাছের গুঁড়ি তার সামনে এলে। রুমি সেটা জড়িয়ে ধরতেই সেই গুঁড়ি তাকে টেনে তীরে নিয়ে এলে। রুমি দেখলে গাছের গুঁড়ি তাকে রেখে খুব পরিচিত ভঙ্গিতে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে লম্বা মোটা একটি দড়ি ঝুলিয়ে। রুমি তার সর্বশক্তি দিয়ে গাছের মোটা সেই গুঁড়ির কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে বলল, ‘আমায় ক্ষমা কর!’

জাগো মা

কেয়া চ্যাটার্জি

‘শোন, এসব ছাড়। তুই যা, তাই থাক।’

‘পাগলামির একটা লিমিট থাকা দরকার। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে এসব হয় না।’

কথাগুলো শুনে শুনে প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল শ্যামলের। প্রথম প্রথম এসব কানে এলে লজ্জায় কুঁকড়ে যেত শ্যামলের ভেতরটা। তার মনে হতো কোনো এক বিশেষ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। কখনো মনে হতো এই সমাজের মধ্যে থাকার যোগ্যতা তার নেই। কৈশোরকালেই সে বুঝতে পারে তার শরীরটা পুরুষের হলেও মনটা নারীর। মেয়েদের সঙ্গে সখ্যয় সে স্বাভাবিক। মায়ের শাড়ি লুকিয়ে পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে অপরূপা মনে হতো। বোনের লিপস্টিক, আন্ডারগার্মেন্টস লুকিয়ে রাখত আলমারিতে।

ধীরে ধীরে নিজের সঙ্গে লড়াই শুরু হয়। সবাই যেন তাকে ব্রাত্য করে দিচ্ছে। এই পৃথিবী তার বাসযোগ্য নয়। মনে হতো, হয়তো লেখাপড়া ছেড়ে তাকেও গিয়ে দাঁড়াতে হবে সিগন্যালে, অন্য বৃহন্নলাদের সঙ্গে। হতাশাময় জীবন শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যায় শ্যামল। শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদীর তীরে। সন্ধ্যা ঘনাতে বেশি দেরি নেই। আকাশের ক্যানভাসে ঈশ্বর তাঁর রং-তুলি নিয়ে এক বিচিত্র ছবি আঁকতে ব্যস্ত। নীলচে আকাশ তখন গোলাপি আভায় উদ্ভাসিত। গাছ-গাছালি ভরা নদীর পার। পাখিরা সারা দিন শেষে ফিরে আসছে তাদের নীড়ে। তাদের কলকাকলিতে মুখরিত চারদিক। শ্যামলের চোখ জলে ভরে উঠল। এই বিরাট পৃথিবীতে তার জন্য এতটুকু জায়গা রাখেননি ঈশ্বর?

একটি গাছের তলায় বসে গান গাইছেন এক ভিক্ষুক। পাশে সারিবদ্ধভাবে সাজানো মাটির মূর্তি। শ্যামল সেগুলোর দিকে তাকিয়ে হাসে। একটি মূর্তির দিকে তাক করে ভিক্ষুককে প্রশ্ন করে, ‘কী ঠাকুর ওটি?’ ভিক্ষুক হাত উল্টে বলেন, ‘কী জানি বাবা! নারায়ণও হতে পারেন, কালিও হতে পারেন। সবাই এক। অর্ধনারীশ্বর।’ কী ঢেউ উঠল তার বুকে। ঢাক বাজছে দূরে।

মণ্ডপে সবাই শ্যামলের দিকে চেয়ে। কারুর চোখে বিস্ময়, কারুর চোখে ব্যঙ্গ। সবার দৃষ্টি তুচ্ছ করে শ্যামল অঞ্জলির ফুল তুলে নেয় হাতে। শ্যামল নাকি শ্যামলী? নাকি শ্যামা? দেবীর পায়ে পুষ্প অর্পণ করে সে মনে মনে বলে ওঠে—

‘সকল অজ্ঞানের কুয়াশা ছিন্ন করে জাগো মা।’

বিসর্জন

স্বপন বিশ্বাস

দুর্গা সেদিন শাড়ি পরেছিল। দশমীর দিন। মা-কাকিমারা সবাই নতুন শাড়িতে সেজেছে। মেয়ের তাই শাড়ির শখ। বারো-তেরো বছরের ধিঙ্গি মেয়ে। সকাল থেকে মায়ের আঁচল ধরা। মেয়ের কান্না দেখে ছোট কাকিমা একটা লালের ওপর জরির কাজ করা শাড়ি পরিয়ে দেন। শাড়ি পরে সারা দিন নেচে বেড়াচ্ছে। সূর্য পাটে বসলে ঠাকুমা ডেকে বলল, ‘ও দুগ্গা, হাঁসগুলান নিয়ে আয় দিদি।’ দুর্গা মুখ ভেংচি দিয়ে বলে, ‘তুমি যাও! আমি মণ্ডপে গেলাম।’ শয্যাশায়ী ঠাকুমা অনুযোগের সুরে বলেন, ‘আমার মাজায় কি আর সেই জোর আছে রে ভাই।’ দুর্গা ততক্ষণে পূজা মন্দিরে। ছোট ভাই অপু ঢাকের তালে তালে কাঁসর বাজাচ্ছে। দুর্গা অপুর কানের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘চ হাঁস আনতে যাই।’ অপু বলে, ‘তুই যা।’ অগত্যা দুর্গাকে একাই যেতে হয়।

মজুমদারদের বাগান পেরিয়েই নদী। চর যখন ফাঁকা ছিল, তখন হাঁসগুলো নিজেরাই ঘরে ফিরত। এখন চরে কাশের বন ঘন হওয়ায় হাঁসগুলো ফিরতে ভয় পায়। অপু-দুর্গার ‘তই তই’ ডাক শুনে কুলে উঠে আসে। তারপর ভরা পেটে হেলেদুলে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। সেদিনও দুর্গার ডাক শুনে হাঁসগুলো উঠে আসে। কাশফুলের বনের মাঝে কী যেন একটা সড়সড় শব্দ শুনে হাঁসগুলো দল ভেঙে এলোমেলো হয়ে যায়। দুর্গা কাশবনের ভেতর থেকে হাঁসগুলোকে লাইনে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে। তখন মন্দিরে বিসর্জনের বাজনা বাজছে। বেদি থেকে মূর্তি নামানো হচ্ছে। দুর্গার চোখের সামনে অসুরের মূর্তিটা ভেসে ওঠে। হাঁসগুলো ঘরে ফিরে আসে। বিসর্জন শেষে রাতে বাড়ি ফিরে বাবা ডাকে, ‘দু-গ্গা।’ মা বলে, ‘আছে হয়তো ঠাকুমার ঘরে। রাত দুপুরে মেয়েকে নিয়ে আদিখ্যেতা করতে হবে না।’

সকালে দুর্গার বাবা তখন টেলিভিশনে খবর শুনছিল। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের খবর। মা বলল, ‘শুনছ! দুর্গা তো ঠাকুমার ঘরে নেই। মেয়েটার একটু খোঁজ নিয়ে দেখ তো, কোথায় গেল?’ বাবা বলল, ‘হয়তো মামা বাড়ি গিয়ে উঠেছে। ঘরের কাছে মামা বাড়ি থাকলে যা হয়।’ এমন সময় সমু মুনশি নদীর ঘাট থেকে খবরটা নিয়ে এল। গ্রামশুদ্ধ লোক নদীর তীরে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। দুর্গার কচি মুখটা তখন নদীর স্বচ্ছ জলে ভেসে আছে।

বেসিক ট্রেনিং

প্রণব কুমার বসু

‘এই একদম না! কানে ঢুকল না আমার কথা? একটার বেশি ভেজ পাকোড়া খাওয়ার কোন‌ো মানেই হয় না। যা আগে এগিয়ে গিয়ে দু জায়গায় দশটা করে চিকেন পাকোড়া নিয়ে আয়। কী বললি? অতগুলো খেতে পারবি না? আরে যেগুলো খেতে পারবি না, সব আমি ব্যাগে ভরে নেব। কাল মাইক্রো-ওভেনে গরম করে বাড়িতে বসে আরাম করে খাব।’

এক ভদ্রমহিলা বিয়ে বাড়ির ‘অনুষ্ঠানে কীভাবে খেতে হয়’ সে ব্যাপারে ছেলেকে বেসিক ট্রেনিং দিচ্ছিলেন। আগ্রহী হয়ে তাদের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম।

এর পরের পর্ব ডিশ কাঁটাচামচ ও স্যালাড সংগ্রহ করা। আমিও তাদের পাশেই র‌ইলাম নতুন কিছু জানা ও শেখার নেশায়।

‘রাধাবল্লভী আলুরদম, ডাল, ওগুলো অল্প করে নিস। বাড়িতে প্রায়ই খাওয়া হয়। পনির দোপিঁয়াজা নামমাত্র, ফ্রায়েড রাইস পরিমাণমতো নিবি, আর ফিশ ফ্রাই গরম হলে সাত-আটটা, না খেতে পারলে সব আমায় দিয়ে দিস। মাটন কষা কম করে সাত-আট পিস নিবি হাড় ছাড়া। সব আস্তে আস্তে বসে খাবি! আবার কোনো নেমন্তন্ন বাড়িতে ভালো মাংস খাওয়াবে, তার কোনো ঠিক আছে! এখন তো সব পোলট্রি চিকেন দিয়েই কাজ সারে। আইসক্রিম তিন-চারবার নিবি। কেন তোর দাঁত শিরশির করে নাকি? ঠিক আছে খেতে না পারলে আমায় হ্যান্ড‌ওভার করবি। আর হ্যাঁ শোন, বেরোবার সময় যেন বলে দিতে না হয়। একমুঠো মিষ্টি পান পকেটে পুরে নেওয়া চাই; আর সঙ্গে দাঁত খোঁচানোর কাঠি।’

মৃত্যু-যুদ্ধ

শাদাত আমীন

রৌদ্রমুখর ভাদ্রের দিনে রিকশাওয়ালার রাগমাখা কটমট চোখে আগুনঝরা অস্থিরতা; গলার স্বরে ক্ষোভের মিছিল—‘ও..তলে তলে সোগ চলে, খালি হামার বেলায় শালা লকডাউন!’

মাস্কমুখো পুলিশ বেচারা থতমত খেয়েছে রিকশাওয়ালার এমন কথায়। আজ সে নতুন ডিউটি করছে না এই এরিয়ায়। ‘তলে তলে সোগ চলে’ কথাটা দিয়ে রিকশাওয়ালা কী বোঝাতে চেয়েছে, সেটা আর বুঝতে বাকি নেই পুলিশের। কারণ, রিকশাওয়ালার ক্ষোভমাখা কথাটা মাথায় আওড়াতে আওড়াতেই দুটি ইজিবাইক নির্ভয়ে তাদের ডান দিয়ে চলে গেল। পুলিশ বোকার মতো সেদিকে চোখ রাখতে রাখতেই রিকশাওয়ালা রিকশার হাতলে হাত রাখে, প্যাডেলে পা দিয়ে লালবাগের পথে চোখ দেয়। মুখে কোনো মাস্ক নেই তার।

২.

রোববার, হাটবার। পেটের জ্বালা মেটাতে টানা সাত দিনের জ্বর, সর্দি গায়ে নিয়েই রিকশা নিয়ে বেরিয়েছে ওবায়েদ। সীমিত আকারে লালবাগ হাটের দোকানগুলো খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছে সিটি করপোরেশন। তবে সে ‘সীমিত আকার’ মুখেই। হাটে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। অনেকের মুখে মাস্কটাও নেই!

সামনে তাকাতেই দেখা গেল, ওবায়েদের রিকশা থেকে নামছেন প্রবাসী হেলাল ভাইয়ের বউ। মুখে অবশ্য মাস্ক আছে তার। কেনাকাটা করতে এসেছেন। ভাড়াটা দিতে দিতে মাস্কবিহীন ওবায়েদকে হেলাল ভাইয়ের বউয়ের প্রশ্ন, ‘ওই মিয়া, মাস্ক পরেন নাই কেন? মরণের সাধ নাকি?’

-ছয়টা মানুষ না খাবার পারি এমনিই মরি যাইতোছি! আর মরণের ভয়!

জ্বরের ক্লান্ত শরীরে নতমুখে বিড়বিড় করে ওবায়েদ।

অবসর

শুক্লা গাঙ্গুলি

আজ চাকরি জীবনের শেষ দিন বিনয়ের। কলেজ স্ট্রিট থেকে তারাতলা—রোজকার যাতায়াতের আজই শেষ দিন। গত ৩০ বছর ঝড়-জল-বৃষ্টি, সবই অগ্রাহ্য ছিল। সকাল ৭টায় বেরিয়ে রাত ৯টায় ঘরে ফেরা। ওয়াইএমসিএর মেম্বার সে কলেজজীবন থেকেই। বিকেলে ফেরার পথে বেশির ভাগ দিনই ক্লাব ও বন্ধুর দোকান ইন্দ্রানী স্টোরে আড্ডা মেরে বাড়ি ফেরা। ব্যতিক্রম কেবল ছুটির দিন। সকালে দেরিতে ঘুম থেকে উঠে জলখাবার সেরে ধুতি পাঞ্জাবিতে শৌখিন বাঙালি বাবুটি সেজে কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে হিন্দুস্তানি মুটের মাথায় বাজার চাপিয়ে বাড়ি ফেরা।

এর পর আনন্দবাজার, সাপ্তাহিক দেশ, স্টেটসম্যানে সময় কাটানো। বাড়িতে বৃদ্ধা মা আর নিঃসন্তান শুচিবাইগ্রস্ত স্ত্রী মঞ্জু। এক গভীর হাহাকার ছেয়ে থাকে বাড়িময়; সর্বক্ষণ। আজ ফেরার পথে বহু বছর পর নিউমার্কেটে নেমে একগুচ্ছ হলদে গোলাপ আর দুটি সুন্দর গরম পশমিনা চাদর কেনে বিনয়। কোথায় যেন এক মুক্তির স্বাদ লাগে মনে। আগামীকালের ভোর তার নিজস্ব। কোথাও বাঁধা গৎ আর নেই। মুক্ত বিহঙ্গ যেন।

চোর

শারমিন আকতার

নিজের চিংড়ির ঘেরে আপন মনে ভেলায় চড়ে মাছের খাদ্য ছিটাচ্ছেন কুদ্দুস আলী। মনের সুখে হেঁড়ে গলায় গান গাইছে—‘ওরে নীল দরিয়া, আমায় দেরে দে ছাড়িয়া...!’

চার-পাঁচজন পুলিশ আচমকা সেখানে উপস্থিত হলো। কুদ্দুস আলীসহ আরও সাত-আট জন চিংড়ি চাষিকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে গেল। সবার চোখেমুখে প্রশ্ন—কেন তাদের পুলিশ ধরে নিয়ে গেল? পুলিশ ধরে নিয়ে যেতে পারে—এমন অপরাধ করার মতো লোক তো তারা নয়। তবে কেন?

কুদ্দুস আলীর পরিবারের লোকেরা খবর পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে। কী করবে তারা এখন? অবশেষে একজন প্রতিবেশীর সঙ্গে থানায় গেল। অনেক কষ্টে দেখা করার সুযোগ পেল তারা। স্বামীর সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্রই কুদ্দুস আলীর স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘কী কইরছো তুমি? পুলিশ ক্যান তোমারে ধইরা আইনলো?’

কুদ্দুস আলীর মা বলে উঠল, ‘বাজান তোমারে ক্যান পুলিশ ধইরা লইল? কত্ত কষ্ট কইরা আমি তোমারে বড় কইরছি। আমার কষ্ট সব তুই নষ্ট কইরা দিলি বাজান? কি কইরছ তুমি?’

কুদ্দুস আলী কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আই চুরি কইরছি মা। আই চোর। আই চোর।’

-তুমি চুরি কইরছ? কী চুরি কইরছ?

-পানি মা। আই পানি চুরি কইরছি।

-পা..নি!

ছেলের উত্তর শুনে বিস্মিত কুদ্দুস আলীর মা। ভাবতে লাগলেন, ‘পানি, হে আবার কেউ চুরি করেনি? আর করলেও কি পুলিশ ধইরা লয়? কী কয় কুদ্দুস।’

-বাজান তোর কি মাতা খারাপ হইছে? পানি আবার চুরি করন লাগেনি?

-লাগে মা লাগে। প্যাটের লাইগা এখন পানিও চুরি করন লাগে। কী করুম মা? বৃষ্টি হয় না। সগরের পানির ঢল বাঁধ দিয়া আইটকা দিছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। চিংড়ি বেইচ্চা প্যাডের ভাত জোগাই। হেই চিংড়িরে বাঁচানোর লাইগা তো পানি দরকার মা। বাঁধ ফুটা কইরা পানি নিছিলাম কয়েক দিন আগে সাগর থেইক্কা। হের লাইগাই!

কুদ্দুস আলীর মা ছেলের চোখের জল মুছতে মুছতে আনমনে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলেন—কী আজিব যুগ আইছেরে। বাঁচার লাইগা ক্যান পানিও লওন যাইব না?