অটুট থাকুক পরিবারের বন্ধন

এক সময়ের টিভি অভিনেতা মিল্টন আহমেদ যেকোনো অনুষ্ঠানে সপরিবারে উপস্থিত থাকেন

পরিবার এমন একটা প্রতিষ্ঠান, বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে যেখানে সবাই একসঙ্গে থাকে, আনন্দে হাসে আর দুঃখে একে অপরের চোখের জল মুছে দেয়। ভালোবাসা আর পরিবার এই দুটোই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়। যেকোনো পরিবারে বাবা চিন্তিত থাকেন পার্কিং স্পেস নিয়ে, ছোটরা চিন্তায় থাকে খেলাধুলোর জায়গা নিয়ে। মা চিন্তায় থাকেন সকাল-দুপুর আর রাতের খাবার নিয়ে। আমরা সবাই ঘরে ফিরতে চাই, পরিবারকে ভালোবাসতে চাই। কারণ এতেই সত্যিকারের সুখ নিহিত।

দেশে এক সময় একান্নবর্তী পরিবার ছিল। বর্তমানে পরিবারে সদস্য সংখ্যা কম। বেশির ভাগ পরিবারে এক বা দুই, খুব বেশি হলে তিনটি সন্তান। আমরা যারা দেশ ছেড়ে চলে এসেছি তাদের সন্তানেরা পড়াশোনা শেষে চাকরিতে যোগ দিয়ে কীভাবে যেন ছিটকে পড়ে পরিবারের গণ্ডি থেকে। শুধু বড়দিনের ছুটি বা অন্য কোনো ছুটিতে কয়েক দিন পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটিয়ে যায়।

পরিবারের বন্ধন মুঠো করে ধরতে চাইলেও মুঠোয় আর ধরা যাচ্ছে না। মুঠো খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে। পরিবার সংখ্যায় বাড়ছে। চারজনের পরিবারে বড় সন্তানটিকে বিয়ে দিলে সে আরেক সংসার শুরু করে। এক পরিবার ভেঙে দুটি পরিবার হচ্ছে। এরপর টুকটাক আসা যাওয়া। শেষে দেখা যায়, বছরে এক-দুইবার দেখা হয়। কাজ-ব্যস্ততা-ছুটির অভাব।

যে পরিবারে বাবা-মা সন্তানের জন্য বেশ সাপোর্টিভ এবং বন্ধুসুলভ প্রভাবশালী চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সাইকোলজিতে একে নির্ভরযোগ্য প্যারেন্টিং হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাঁরা সন্তানের চাহিদা, দক্ষতা ও আগ্রহকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন এবং সে অনুযায়ী দিকনির্দেশনা দেন। এর পাশাপাশি তাঁদের মাঝে দায়িত্ববোধ এবং মূল্যবোধ গড়ে তোলার ব্যাপারেও সচেতন থাকেন। শাসননির্ভর না হয়ে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করায় এসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা সহজেই বাবা-মার অনুগত ও কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডেও তারা এগিয়ে থাকে এবং এ ধরনের প্যারেন্টিং সন্তানের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া এ ধরনের সন্তানেরা মানসিক চাপ থেকে ঝুঁকিমুক্ত থাকে। বাবা-মার সঙ্গে সবকিছু শেয়ারিং কালচার থাকায় তারা বিশ্বস্তভাবে বাবা-মার সঙ্গে বিভিন্ন সমস্যা শেয়ার করতে পারে। বাবা-মা বিষয়গুলো ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করায় সন্তানেরা অনুপ্রাণিত হয়।

এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক কম্প্রোমাইজিং তুলনামূলক ভাবে বেশি থাকায় বন্ধন আরও বেশি দৃঢ় হয়।

অন্যদিকে জেদি কর্তৃত্ববাদী বাবা-মার ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাঁদের সন্তানদের সব সময় কঠোর শাসনের মাঝে রাখেন। তাঁরা চান বিভিন্ন বিধিনিষেধের মাধ্যমে সন্তানের পুরো জগৎকে ফিল্টারিং করতে। সন্তান তার বন্ধুমহল এবং সামাজিক পরিবেশের প্রভাবে যখন বহুমুখী উপকরণ দেখছে এবং তার মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে, তখন পরিবারের কড়া শাসন এবং কট্টর দৃষ্টিভঙ্গি ও বিধিনিষেধ তার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। এ ধরনের পরিবারে বেশির ভাগ সময় সন্তানদের পড়াশোনা এবং অন্যান্য দায়িত্বের প্রতি অতিরিক্ত চাপ দেওয়া হয়। তার বিনোদনের স্বল্প সুযোগ এবং সামাজিকীকরণে বিভিন্নভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়। ফলে সন্তানের মনে পরিবার কেবল শাসনতন্ত্রের প্রতীক হয়ে ওঠে। এতে তার কাছে নিজের সমস্যা, ভালো লাগা-না লাগা ইত্যাদি বিষয় পরিবারের কাছে মূল্যহীন বলে মনে হয়। পরিতাপের বিষয়, অসংখ্য প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তাঁর পরিবর্তিত মানসিকতা নিয়ে যতটা সচেতন এবং অন্যের কাছ থেকে সে সময় যে ধরনের প্রতিক্রিয়া আশা করেন, ঠিক ততটা অসচেতন এবং অবহেলা করেন শিশু-কিশোরের ক্ষেত্রে।

বাবা-মার নিজেদের প্রজন্মের জীবনবোধ, রুচি এবং চাহিদা দিয়ে সন্তানদের বিচার করার প্রবণতা বা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে দেখতে চাওয়ার প্রয়াস থেকে বড় রকম অসহিষ্ণুতা এবং ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এতে পারিবারিক সম্পর্কগুলো ধীরে ধীরে বিবর্ণ হতে থাকে।

আবার এর ঠিক উল্টো ছবিও দেখতে পাওয়া যায় কিছু পরিবারে। অতিরিক্ত সন্তান বাৎসল্য, ভালোবাসার কারণে অনেক বাবা-মা সন্তানের কেবল চাহিদাকেই দেখেন বড় করে কিন্তু তার প্রতি সচেতনতা এবং দায়িত্ববোধের ব্যাপারে অনেক বেশি উদার থাকেন। তাঁরা বেশির ভাগ সময়েই প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন না।

ডেভেলপমেন্টাল সাইকোলজিতে এই প্যারেন্টিংকে বলে অনুমোদনদায়ক। এসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা অনেকটাই শাসনের আওতামুক্ত থাকায় তাদের মাঝে খামখেয়ালিপনা ও অবাধ কার্যকলাপের মানসিকতা গড়ে ওঠে।

সব বাবা-মার কাছেই সন্তান ভালোবাসার। সন্তান নিয়ে সবারই থাকে স্বপ্ন। ‘মা’ যদি দুর্বল হয় সংসার হয় অরণ্য। মায়ের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মা যদি নিজের স্বপ্ন ভেঙে যেতে দেখেন তবুও মুষড়ে পড়া যাবে না। সন্তানের পাশে অটল পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে সন্তানকে আগলে রাখতে হবে। তা না হলে দেখবেন সন্তান আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। সাফল্য সবাই একভাবে অর্জন করতে পারে না। অসফল ব্যর্থ সন্তানের পাশে চুম্বকের মতো লেগে থাকতে হবে মমতা নিয়ে। একদিন সে-ও দাঁড়িয়ে যাবে।

‘তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়।

জীবনের নিজের প্রতি নিজের যে তৃষ্ণা,

তারা হলো তারই পুত্রকন্যা।

তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে,

তোমাদের থেকে নয়।’

কাহলিল জিবরানের কবিতার লাইনগুলো সব বাবা-মার পড়ে অন্তরে ধারণ করা উচিত।