আমার দেখা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক
একেবারে ছোটবেলা লেখাপড়ায় হাতেখড়ি মায়ের কাছে। রান্নাঘরে মা একদিকে ভাত-তরকারি রাঁধতেন এবং আরেক দিকে আমি ও ছোট ভাই মেঝেতে মাদুর পেতে বর্ণমালার বই খুলে বসতাম। তারপর ঘরোয়া পরিবেশের বাইরে প্রথম ওস্তাদের সংস্পর্শে আসি যখন মক্তবে যাই আরবি শিখতে। আরেকটু বড় হলে পাঠশালা। তারপর হাইস্কুল। অবশেষে কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে সাঁতরাতে শুরু করি জ্ঞানের সাগরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত পরিবেশে। এখনো সেই সমুদ্র উপকূলের নিকটেই হাবুডুবু খাচ্ছি। সাগর পাড়ি দেওয়া তো দূরের কথা, মাঝদরিয়াতেও যেতে পারিনি। তত দূর যাওয়ার আগেই কোনো একদিন জীবন-তরি যে চিরতরে ডুবে যাবে তাতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
যে পারিবারিক পরিবেশ ও সংস্কৃতিতে বড় হয়েছি, সেখানে প্রথম শিখেছি মা-বাবা কিংবা শিক্ষকদের সঙ্গে কখনো অশোভন আচরণ করতে নেই। তর্ক-বিতর্কের তো প্রশ্নই ওঠে না। ফলে অল্প বয়সে শিক্ষকেরা ভুল-শুদ্ধ যাই পড়িয়েছেন, তাই সঠিক মনে করে সুবোধ বালকের মতো শিখে নিয়েছি। লেখাপড়া কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে শিক্ষক বা যে কারও সঙ্গে বিতর্কে জড়ানো যে শিষ্টাচার নয়, সেটা তখন জানতাম না। জানলে হয়তো গোড়া থেকে নিজেকে আরও অনেক মজবুত করে গড়ে তোলার সুযোগ পেতাম।
তবুও আপন বুদ্ধিবৃত্তিকে যথোপযুক্ত পথে পরিচালনা করতে আমি যতটা সুযোগ পেয়েছি, অনেকের ভাগ্যে হয়তো–বা তা–ও জোটে না। দেশে থাকতে ছাত্রাবস্থায় শিক্ষকদের যেমন সমীহ ও শ্রদ্ধা করেছি, তেমনি নিজে শিক্ষক হয়ে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে সেই সম্মানের পুরোটাই কড়ায়গণ্ডায় আদায় করে নিয়েছি। অবশ্য এতে আমার যেমন কোনো কৃতিত্ব নেই, তেমনি শিক্ষার্থীদেরও নেই কোনো আনুকূল্যের অবকাশ। এটা নিতান্তই আমাদের সমাজিক মূল্যবোধ ও সমাজের নিয়মকানুন। উচ্চতর লেখাপড়ার জন্য যখন বিদেশে এলাম তখন এ মূল্যবোধে বড় ধরনের এক ধাক্কা খেলাম। চর্মচক্ষে নতুন কিছু দেখতে দেখতে মনের চোখও খুলে গেল। আস্তে আস্তে বুঝতে লাগলাম, আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির যেমন একটা ভালো দিক আছে, তেমনি আছে তার এক মারাত্মক দুর্বল দিকও। আগে যা–ই ভাবি না কেন, আমার এখনকার বিবেচনায়, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে আছে দুটো মাত্রা। প্রথমটা হলো শিক্ষকদের সমীহ করা, সম্মান করা। তাঁদের সাথে অসদাচারণ না করা। সব সময় তাঁদের কথা শোনা, ইত্যাদি।
এ সম্পর্ক সম্বন্ধে আজকের নিবন্ধে কিছু অনুভূতির কথা বলব। তার মধ্যে কতেক ছাত্র হিসেবে। কতেক শিক্ষক হিসেবে আমার নিজের অনুভূতি ও উপলব্ধি। তার সাথে যোগ করব আমার এক অধ্যাপক বন্ধুর মজার গল্পকথাও। দেশ থেকে এমএ পাস করে উচ্চশিক্ষার জন্য আমি প্রথম কানাডা আসি ১৯৭৯ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে কিছুদিন ঘোরাফেরা করেই বুঝতে পারি আমাদের দেশীয় স্পর্শকাতর ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মানসম্মানের বিষয়টি সে দেশে প্রায় ষোল আনাই অনুপস্থিত। আমার কাছে এই নতুন অভিজ্ঞতা প্রথম প্রথম খুবই দৃষ্টিকটু লাগত। পরে অবশ্য গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। পাঠকদের জন্য ঘটনাটা আরেকটু খুলে বলা দরকার। কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বছর গ্র্যাজুয়েট মাইক্রো ইকোনমিকসের ক্লাসে একদিন গিয়ে দেখি এক শ্বেতাঙ্গ কানাডিয়ান সহপাঠী বই–খাতা টেবিলের ওপর রেখে জুতাসহ পা দুখানি টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে চিত হয়ে আধা শোয়া, আধা বসা অবস্থায় বিশ্রাম নিচ্ছে। ক্লাসে শিক্ষার্থী ছিলাম আমরা দশ-বারো জনের মতো। একটা বড় কনফারেন্স টেবিলের তিন দিকে আমরা চেয়ার টেনে বসতাম। অধ্যাপক দেয়ালে লটকানো ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতেন। যেদিনের কথা বলছি, সেদিন স্যার সময়মতো ক্লাসে এসে ঢুকলেন। ছাত্রছাত্রীদের উঠে দাঁড়ানোর কোনো রেওয়াজ নেই। তার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা সবাই যার যার চেয়ারে বসা। ওই ছেলেটিও সবার মতো যেভাবে ছিল সেভাবে ঠায় টেবিলের ওপর পা তুলে বসেই রইল। কিছুই বলতে পারছিলাম না। কিন্তু আমার খুব অস্বস্তি লাগছিল। প্রফেসর গুড ইভিনিং এভরি ওয়ান বলে পড়াতে শুরু করে দিলেন। তিন ঘণ্টার ক্লাস, হাফ টাইমের পর ছেলেটি ১৫ মিনিটের ব্রেকের সময় সবার সাথে কফি খেতে বেরিয়ে গেল। তখনই ওই দিনকার মতো আমারও বিব্রতবোধের অবসান হলো। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আরও দেখলাম ছাত্রছাত্রীরা প্রফেসরদের স্যার বলে সম্বোধন করে না। কখনো প্রফেসর অমুক। কখনো–বা ড. অমুক, কখনো শুধু নাম ধরেই ডাকে। আমাদের দেশীয় রীতিনীতিতে ক্লাসে বিনয় ও অদ্রতা বলতে যা বোঝায়, উত্তর আমেরিকায় তার তেমন কোনো বালাই নেই। এগুলোর কেউ ধার ধারে না। এ নিয়ে কেউ মাথাও ঘামায় না। এসব এ সমাজে নিতান্তই গৌণ ব্যাপার। অথচ আমাদের সমাজে এটাই আসল। এটাই মুখ্য। এটাই যেন সব।
এখানে নাম ধরে ডাকার ব্যাপারে আমার আরেকটা ছোট্ট মজার অভিজ্ঞতার কথাও বলা দরকার। ম্যানিটোবাতে একই বছর আমাদের ম্যাক্রোইকোনমিকস পড়াতেন এক গ্রিক অধ্যাপক। পরে তিনি আমার পিএইচডি থিসিস সুপারভাইজার হয়েছিলেন। তাঁর নাম ছিল ‘কনটেন্টাইন আলেকজান্ডার নিকোলাও’। ডিপার্টমেন্টের অন্য অধ্যাপকরা অর্থাৎ তাঁর সহকর্মীরা তাঁর কঠিন প্রথম নামকে (First name) সহজ ও সংক্ষেপ করে ডাকতেন ‘কটার্স’। আমি জানতাম এ দেশে তো অধ্যাপকদের নাম ধরে ডাকা কোনো অভদ্রতা নয়, তাই একদিন পরীক্ষার মোড জানতে অধ্যাপকের বাড়িতে ফোন করে বলেছিলাম, May I speak to Prof. Contas? অধ্যাপক নিকোলাও নিজেই ফোন ধরেছিলেন, তিনি আমার ধৃষ্টতায় মোটেও রাগ হননি। ধীরস্থির-ভরাট কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘The name is Nicolao প্রফেসর নিকোলাও সেদিন নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন, ওটা আমার অজ্ঞতাবশত ভুল। ইচ্ছাকৃত অশালীন আচরণ নয়। তখন আমি জানতাম না, ঘনিষ্ঠ জানাশোনা না থাকলে কারও অনুমতি ছাড়া তাঁকে প্রথম নাম ধরে ডাকা পশ্চিমা সংস্কৃতিতে মারাত্মকভাবে অগ্রহণযোগ্য। সেদিন আমি খুব বিব্রত বোধ করেছিলাম। এর পর থেকে অনুমতি ছাড়া কাউকে তার প্রথম নামে ডাকার সাহস দেখাই না।
এবার বলছি, শিক্ষক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতার কথাটা। বিদেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়ে সম্মানের সম্পর্কটাকে অনেকভাবে অনুভব করেছি। অনেক সময় অকারণে ব্যথাও পেয়েছি। ক্লাসে কোনো একাডেমিক ব্যাপারে কিংবা যেখানে ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থ সরাসরি জড়িত, সেসব ব্যাপারে আমি শিক্ষার্থীদের প্রতি খুবই উদার ও তাদের প্রতি ভীষণভাবে সংবেদনশীল। প্রথম দিনই আমি আমার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের এ বিষয়ে পূর্ণ অধিকার দিয়ে রাখি। তারা কোনো সময় সেই অধিকারের চর্চা করে। অনেক সময় করেও না। প্রথম দিকে শিক্ষার্থীর ক্লাসের ভেতরে বা বাইরে যখন নাম ধরে ডাকত অথবা ক্লাসে মামুলি বিষয়ে সীমা অতিক্রম করত, (অবশ্য আমার দেশীয় মূল্যবোধের বিবেচনায়) তখন খুব খারাপ লাগত। এখন আর তেমন অসুবিধা হয় না। বিষয়টাকে সাধারণভাবে নিতে শিখে গিয়েছি। প্রতিবছর শত শত ছেলেমেয়েরা আমার কোর্সে ভর্তি হয়। নিতান্তই হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া কারও নাম মনে রাখা সম্ভব হয় না। যাও-বা থাকে, দু-এক সেমিস্টারের ব্যবধানে তা–ও ভুলে যাই। বেশির ভাগ ছাত্রকে শুধু মুখেই চিনি। নামটা রপ্ত করার আগেই সেমিস্টার শেষ হয়ে যায়।
বেশ কয়েক বছর আগে একবার এক মেয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে আমাকে দেখে ‘হায়’ বলেছিল। আমি তাকে চিনতে পারিনি। কেন তাকে চিনতে পারলাম না, সে জন্য ছাত্রীটি আমার ওপর ভীষণ রাগ করেছিল। সে আমাকে রীতিমতো অভিযুক্ত করে বসল। তাকে অপমান করার দায়ে। অথচ ছাত্ররা যখন আমাদের চিনতে পারে না, তখন আমাদের পক্ষে রাগ করার কোনো অবকাশই থাকে না। এ দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে- ‘Students matter most’ অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের স্বার্থই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। কথাটা অন্যভাবে বলা যায়, ছাত্রছাত্রীদের জন্য সাত খুন মাফ। আমার জীবনে এ পর্যন্ত এমন ঘটনা এখনো হয়নি। তবে আমার এক বন্ধুর কাছে একটা গল্প শুনেছি আরেকজন বাঙালি অধ্যাপক সম্পর্কে। ঘটনাটার মূল বক্তব্য অটুট রেখে আমার আজকের উপসংহারের সাথে প্রাসঙ্গিক করে আমি গল্পটি পাঠকদের সামনে এভাবে তুলে ধরতে চাই।
জনৈক অধ্যাপক একদিন শহরের উপকণ্ঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। শীতের দিন হঠাৎ দেখতে পেলেন, তাঁরই এক প্রাক্তন ছাত্র রাস্তায় বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। ঠান্ডায় অনুখনু হয়ে কাঁপছে। তিনি কাছে এসে গাড়ি থামিয়ে বললেন, ‘গাড়িতে ওঠো। কোথায় যাবে? তোমাকে কি আমি তোমার গন্তব্যে নামিয়ে দিতে পারি?’ ছেলেটা গাড়িতে উঠল এবং বলল, সে কোথায় কোন দিকে যাবে। দৈবপাকে গাড়িচালক সেদিকেই যাচ্ছিলেন। গাড়ি চালাতে চালাতে তিনি আরও ভাবছিলেন, ছেলেটা নিশ্চয়ই তাকে ধন্যবাদান্তে এক্ষুনি কিছু একটা বলবে। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে তার মুখে অন্য কথা শুনলেন। পথচারী বলল, ‘তুমি কি প্রায়ই অপরিচিত লোকদের এভাবে তোমার গাড়িতে তুলে নাও!’ না, কক্ষনো না, ‘উত্তর দিলেন, সহদয় অধ্যাপক। তারপর সেদিনের ‘হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন আবার প্রশ্ন করল, ‘এইমাত্র তুমি আমাকে যে তুললে?’ অধ্যাপক বললেন, ‘তুমি তো আমার কাছে অপরিচিত নও। তুমি তো মাত্র এক সেমিস্টার আগেই আমার ছাত্র ছিলে। অমুক বারে, অমুক টাইমে, আমার অমুক ক্লাসে তুমি ছিলে না? আমাকে মনে পড়ে তোমার? আমার তো তোমার কথা পরিষ্কার মনে আছে। তখন ছেলেটার মনে পড়ল। সে চিনতে পারল, গাড়ির ড্রাইভার আর কেউ নন, তারই একজন শিক্ষক। যাঁর কাছ থেকে সে মাত্র চার মাস আগেই একটা কোর্স নিয়েছিল। আরও মজার ব্যাপার, নিজের শিক্ষককে চিনতে না পেরে ছেলেটি কিন্তু একটুও লজ্জা পায়নি। কিংবা একবারও শিক্ষক ড্রাইভারের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করেনি। পাঠকেরা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন ঘটনার কথা কি কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেন?
আরেকটি ভীষণ বিব্রতকর অভিজ্ঞতার কথা বলি, প্রায় বছর দশেক আগে আমার পরিসংখ্যান ক্লাসে একটি ইথিওপিয়ান ছাত্রী পেয়েছিলাম। সুদীর্ঘ ৪৬ বছরের শিক্ষকতা জীবনে তার চেয়ে তুখোড় ও তেজী ছাত্র কিংবা ছাত্রীর সাক্ষাৎ আমি কোনো দেশে, কোথাও পাইনি। আজ মেয়েটির নামের আদি অংশটাই কেবল মনে আছে, ‘হেলেন’। প্রথম দিনই টের পেয়েছিলাম, হেলেনের জন্য প্রতিটি ক্লাসে যথাযথভাবে নিখুঁত প্রস্তুতি নিয়েই আমাকে আসতে হবে। সেভাবেই আমি পুরো সেমিস্টার পারও করেছিলাম। এতে করে আমার যে অসুবিধা হয়েছিল তার চেয়ে বড় সমস্যা হয়েছিল ক্লাসের অন্য শিক্ষার্থীদের। হেলেন আমাকে প্রায় প্রতিদিন এমন সব প্রশ্নবাণে ব্যস্ত রাখত এবং এমন সব আলোচনার সূত্রপাত ঘটাত, যা কিনা শ্রেণিকক্ষে সে এবং আমি ছাড়া আর কেউই বুঝত না। আরও কিছুদিন পরে টের পেলাম, তার তেজ ও ক্ষীপ্রতার কাছে আমিও কিছু না। সেদিন সে আমাকে দারুণ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। পরীক্ষার ঠিক আগে প্রিভিউ ক্লাসে হাতের নোট দেখে দেখে আমি সাদা বোর্ডে একটি সূত্র লিখে সবাইকে বলেছিলাম, এই ফর্মুলাটা তোমরা মুখস্থ করে নিয়ো। কাজে লাগবে। মুখের কথা শেষ হতে না হতেই, হেলেন বলে বসল, ‘তুমি নিজেই যেটা মুখস্থ করতে পারোনি, সেটা আমরা কীভাবে করব?’ সাহসী হেলেনের প্রত্যুৎপন্ন প্রশ্নের মুখে মুহূর্তের মধ্যে আমি হতভম্ব! হতবুদ্ধি! ভ্যাবাচেকা খেয়ে কোনো উত্তর দিতে পারিনি। কীভাবে সেদিন নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম, এখন মনেও নেই। তবে এ কথা মনে আছে, চোর পালালে যেমন বুদ্ধি বাড়ে তেমনি সেদিন অফিসে এসে অনেকক্ষণ ভেবে হেলেনের প্রশ্নের একটি জবাব বের করেছিলাম। কিন্তু কোনো দিন মেয়েটিকে বলা হয়নি। হেলেনের মতো উপস্থিত বুদ্ধি থাকলে তার প্রশ্নের বিপরীতে আমি সঙ্গে সঙ্গে বলতে পারতাম, আমি যখন তোমার বয়সে তোমার মতো ছিলাম, তখন এই সূত্রটি আমার মুখস্থই ছিল। আরও বলতে পারতাম, আর কেউ না পারলেও তুমি সহজেই সূত্রটি মুখস্থ করতে পারবে।
সে যা-ই হোক, ছাত্র-শিক্ষকের পবিত্র সম্পর্কের মধ্যে আছে আরেকটি মাত্রা। এটাকে ‘জ্ঞানভিত্তিক গভীর বন্ধনও বলা যায়। এই বন্ধন বলতে আমি জ্ঞানের তত্ত্বকথা ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে-বিপক্ষে থাকা না থাকা বা তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে যে সম্পর্ক ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, সেটাকেই বোঝাচ্ছি। প্রকৃতপক্ষে এটাই মুখ্য। এটাই আসল। এটাই দীর্ঘস্থায়ী। অথচ সাধারণ দৃষ্টিতে সচরাচর আমরা এ বন্ধনটিকে দেখতে পাই না। তার গভীর ও অন্তর্নিহিত টানও অনুভব করি না। এটা আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির একটা ভীষণ দুর্বল দিক। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর অবসান হওয়া উচিত।
পাশ্চাত্য জগতে ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকেই ছাপার অক্ষরের লেখা দেখলেই বেহুঁশ হয়ে মুখস্থ করে না। বোঝার চেষ্টা করে। এটা কী? এটা কী? এটা এ রকম কেন? ওটা এ রকম না হয়ে ও রকম হয় না কেন? ইত্যাদি হাজারো প্রশ্নবাণে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সব সময় ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। শিক্ষকেরাও এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না। বিরক্তও হন না। তাদের দায়িত্ব ছাত্রছাত্রীদের মনে একটা প্রশ্নের জবাবের সঙ্গে আরও তিনটা প্রশ্ন করার তাগিদ সৃষ্টি করা। একাডেমিক ব্যাপারে, জ্ঞানের ব্যাপারে ক্লাসের ভেতরে এবং বাইরে শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীর তর্ক-বিতর্কের কোনো শেষ নেই। অনবরত এবং চলমান এ বিতর্কের মধ্যেই ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে প্রকৃত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এ সম্পর্ক হয় অনেক গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের এটাই আসল। এটাই আসি। এটাই গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্য জগতে শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কের এই মাত্রারই অনুশীলন হয়ে থাকে অধিক। নম্রতা ও ভদ্রতা প্রথম হলে এটাকে আমি বলছি দ্বিতীয় মাত্রা।
ইউরোপ আমেরিকায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে সুব্যবহারের খুব একটা গুরুত্ব নেই। বাংলাদেশে আছে এবং আমি মনে করি থাকাই উচিত। এটা বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ। আমাদের চরিত্রের বিশেষত্ব, সৌন্দর্য। বয়োজ্যেষ্ঠ বা শিক্ষকদের সাথে ঔদ্ধত্য আচরণে কোনো কৃতিত্ব নেই। বাংলাদেশে যেভাবে শিক্ষকদের শ্রদ্ধা ও সমীহ করা হয়, সেটা সেভাবেই ধারণ এবং লালন করা উচিত। তবে তাঁর সাথে সাথে যাকে আমি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের দ্বিতীয় মাত্রা বলছি, তার ওপর বেশি না হলেও অন্তত সমান গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক।
লেখক: আবু এন এম ওয়াহিদ, অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর-জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ। Email: [email protected]