জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: এখন সৌন্দর্য কম, ময়লা বেশি
সড়কের পাশে যেখানে-সেখানে ময়লার স্তূপ—এমনই চিত্র নিত্যদিনের। এ জন্য প্রতিনিয়ত দুর্গন্ধের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সবাইকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রতিদিনকার চিত্র এমনই। বিভিন্ন আবাসিক হল, চত্বর, অনুষদ, দোকানপাট ও রাস্তার পাশে জমে উঠেছে আবর্জনার স্তূপ।
একদিকে যেমন দুর্গন্ধ, অন্যদিকে তেমনই এসব স্তূপ থেকে নানা জীবাণু ছড়াচ্ছে। আবার এসব আবর্জনা ড্রেনে মিশে গিয়ে বন্ধ হচ্ছে পয়োনিষ্কাশনের পথ। এ কারণে মশার বংশবিস্তার ঘটছে। শিক্ষার্থীরা আক্রান্ত হচ্ছেন নানান রোগে।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অনেকাংশে নির্ভর করে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, সেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পরিচ্ছন্নতা অনেকাংশে নির্ভর করে বিদ্যমান বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দক্ষতার ওপর।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ময়লা-আবর্জনা অপসারণে গতানুগতিক পদ্ধতি ও গতিতে এখনো দৃশ্যমান পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয় না। লক্ষ করা যায়, আবর্জনা রাখার বড় বড় কনটেইনার রাস্তায় ঢাকনাবিহীন পড়ে আছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নৈসর্গিক সৌন্দর্য নিয়ে সবাই মুগ্ধ। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে সেই সৌন্দর্যে যেন কালো দাগ পড়েছে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা আর খাবারের উচ্ছিষ্ট।
ক্যাম্পাসের যেখানে-সেখানে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এ কারণে পথচারীসহ শিক্ষার্থীদের চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। সেই সঙ্গে পচা আবর্জনার দুর্গন্ধ ছড়িয়ে আছে। বিভিন্ন অনুষদ, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র ও আবাসিক হলের আশপাশের জায়গাগুলোর সৌন্দর্যবর্ধনে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ তো নে-ই, উপরন্তু সেখানেও আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। ক্যাম্পাসের জনসমাগমস্থল, লেক, বিভিন্ন স্থাপনার আড়ালে-আবডালে ময়লা ফেলার উৎকৃষ্ট জায়গা হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে।
দোকানিরা রাতে দোকান বন্ধ করার সময় যেখানে-সেখানে বর্জ্য ফেলে যাচ্ছেন। যেখানে-সেখানে পড়ে থাকা কফ-থুতু, পান-বিড়ির উচ্ছিষ্টাংশ, ফলমূলের খোসা, কাগজ, পানির বোতল, নির্মাণসামগ্রীর ময়লা-আবর্জনায় শিক্ষার্থীরা যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
হরেক রকম গাছ-গাছালি, নানা রকম প্রাণী, লাল মাটি, উঁচু-নিচু রাস্তা, ছোট-বড় লেকের কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রাজধানী বলা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে। আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা দিতেই লাল ইট দিয়ে ক্যাম্পাসের সঙ্গে মানানসই ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় সাত শ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে বছর কয়েক আগেও রাস্তায় চলাচলের সময় দেখা যেত গুইসাপ, বেজি, গিরগিটি, কাঠবিড়ালিসহ নানা ক্ষুদ্র প্রাণীর আনাগোনা।
রাতে শিয়াল, বাগডাশ, হুতুম ও লক্ষ্মীপ্যাঁচাসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণীর হাঁকডাক আর চলাচলের শব্দে মুখর থাকত প্রাঙ্গণ। গ্রামীণ রাতের আবহ বাঙময় হয়ে উঠত। কিন্তু ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ঝোপঝাড় পরিষ্কার করার নামে আগুন দিয়ে পরিবেশ ধ্বংসের কারণে পরিচিত এসব বন্য প্রাণী আজ বিলুপ্তপ্রায়। অধিক গাছপালা ও তৎসংলগ্ন ঝোপঝাড় এসব বন্য প্রাণীর জন্য প্রাকৃতিক অভয়াশ্রমের কাজ করে। যাওবা আছে, তা আজ হুমকির মুখে।
উঁচু বটতলায় যেতেই চোখে পড়ল এক অভিনব দৃশ্য। যে দৃশ্যে অনেকগুলো চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে। যেখানে একদল শিক্ষার্থী দড়ি দিয়ে মাকড়সার জাল বানিয়েছেন, তার ভেতর সেঁটে দিয়েছেন চিপসের প্যাকেট। ছবি ঝোলানো হচ্ছে ফেলে দেওয়া ভাঙা জানালা আর পলিথিনের ওপর। গুইসাপ আর পাখির ভাস্কর্য বানানো হয়েছে। ক্যাম্পাসের প্রাণপ্রকৃতি রক্ষা, পরিবেশ দূষণসহ নানা সমস্যার চিত্র তুলে ধরেছেন শিক্ষার্থীরা।
নৃবিজ্ঞান বিভাগের ফারিয়া জামান নিকি, ইমরান হাসান শুভ, ইসফার সাদি, আনিকা রাহী, মাইশা মনি, চারুকলা বিভাগের সাবেরীন নওশাদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মাহিব মঈনুদ্দিন জামান, ড্রামাটিকসের জুয়াইরিয়া মেহজাবিন, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের যারিন তাসনিমের এমন উদ্যোগের প্রশংসা করা যায় বলে মনে হয়।
‘অপরিচ্ছন্ন ও অসুন্দর শহর’ অপবাদের এ তিলক আমাদের ললাট থেকে সরাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]