কেন এত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি

নিজে বাঁচলে বাপের নাম—কথাটার সঙ্গে আমরা কম–বেশি সবাই পরিচিত। নিজে বাঁচলেই যেন সব। নিজের ভাগে কম পড়লে প্রতিবাদ করি, অথচ অন্যের ভাগে কম পড়ল কি না, তা দেখি না। মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে নিজে জিততে গিয়ে কতজনকে অন্যায়ভাবে হারিয়ে দিয়েছি, তার কী হিসাব রাখি! সবখানে আমরা যেন একে অন্যের প্রতিযোগী, সহযোগী হতে চাই না কেউ-ই। বরং অন্যে ভালো খাচ্ছে কেন, ভালো পড়ছে কেন—তা নিয়ে চিন্তা করে অস্থির! বর্তমান সময়ে আমরা যেন আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার যুগে স্মার্টফোন কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো যেন আমাদের অনেক বেশি একা করে দিচ্ছে। মুঠোফোনের স্ক্রিনে অতিরিক্ত সময় দেওয়ার কারণে কাছের মানুষের সঙ্গেও সময় কাটাতে হিমশিম খায় অনেকে। তাই আমাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে একাকিত্ব, আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব, বিষণ্নতা ইত্যাদি বিষয়।

মানুষ মরণশীল। যতই আমি আমি করি না কেন, এই পৃথিবীতে কেউ-ই চিরকাল বেঁচে থাকে না। সবাইকে একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। মানুষ মরে যায়, কিন্তু বেঁচে থাকে তার সুন্দর কাজগুলো। আজ আমরা যদি আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে সমাজের সবার কথা ভাবি, একে অপরের সুখ-দুঃখে পাশে থাকি, তাহলে সমাজটা অনেক সুন্দর হয়ে যাবে। আমরা চাইলেই কিন্তু সমাজ পরিবর্তনে অবদান রাখতে পারি। ধরুন, আপনার গ্রামের কিশোর-তরুণদের জন্য একটি লাইব্রেরি করে দিলেন বা গ্রামের সবাইকে নিয়ে এ মহৎ কাজটি সম্পন্ন করলেন, তাহলে দেখা যাবে, যে তরুণ সমাজ স্মার্টফোন কিংবা মাদকের ছোবলে পড়ে বিপথগামী হচ্ছিল, তারা পাঠাগারের সংস্পর্শে এসে আলোকিত হয়ে উঠবে। সমাজের নানা অসংগতি নিয়ে কথা বলবে। সমাজ তথা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। উন্নত জীবনের পথ অনুসন্ধান করবে তারা। এতে সমাজ থেকে ধর্ষণ, মাদক, ছিনতাই, কিশোর গ্যাং কালচার বিদায় নেবে। উপকৃত হবে সমাজের প্রত্যেক মানুষ।

নিজে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার মানে সব নয়। সমাজে অনেক মানুষ আছে যারা, দুই বেলা পেট ভরে খেতে পায় না। রাস্তায় খেয়ে আবার রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়তে হয় অনেক শিশুকে। শিক্ষা তো দূরের কথা, অনেক মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে পারে না তারা। অপুষ্টিতে ভুগতে হয় দিনের পর দিন। আমরা কী কর্মময় জীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে এসব শিশুর অভাব-আবদারের কথা শুনতে পারি না তাদের কাছে গিয়ে! তাদের দুই–একটা অভাব পূরণ করে দিতে পারি না? তাদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারি না?
আমরা কেউ–ই স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। জীবন চলার পথে আমরা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। সমাজ থেকে আলাদা হয়ে কেউ বাঁচতে পারি না। তাই তো মানুষ সামাজিক জীব। ছোটবেলায় দেখতাম, ঘরের রান্নার কোনো উপকরণ বা অন্য কিছুতে কমতি পড়লে আম্মু আমাদের পাশের বাড়িতে পাঠাতেন। কখনো গিয়ে একটু পেঁয়াজ কখনোবা একটু মরিচ বা হলুদের গুঁড়া নিয়ে আসতাম। তারাও কোনো কিছুতে ঘাটতি পড়লে বাড়ি এসে নিয়ে যেত। এভাবে শেয়ার করার কারণে পাড়া–প্রতিবেশীদের মধ্যে একটি সুদৃঢ় বন্ধন অটুট ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে এর উল্টো দেখা যায়। একে অন্যকে কিছু দিতে চাইছি না আমরা। ঘরে থাকলেও বলে দিচ্ছি আমার কাছে নেই, দিতে পারব না ইত্যাদি। পাশের বাসার কেউ আমার বাসায় এলে বিরক্ত হচ্ছি। পাড়া–প্রতিবেশীর সমালোচনায় সরব হচ্ছি। ভালোবাসার সুদৃঢ় বন্ধনে দেয়াল তুলে দিচ্ছি। সন্দেহের দেয়ালে নিজেদের আবদ্ধ করে ফেলছি।

শহর অঞ্চলে তো আরও ভয়ংকর অবস্থা। এক ফ্ল্যাটের মানুষ অন্য ফ্ল্যাটের মানুষের খোঁজখবর রাখে না। রাস্তায় একটি মানুষ বিপদে পড়লে পাশের মানুষগুলো নীরব দর্শকের ভূমিকা নেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভালো পোস্টগুলো কেউ লাইক শেয়ার করতে চায় না। অপ্রয়োজনীয় বা অশ্লীল বিষয়গুলো শেয়ার করে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করি। ভাইরাল হওয়ার নেশায় বিভোর থাকি। অথচ জরুরি রক্ত প্রয়োজন বা কারও সাহায্যের প্রয়োজন লিখা পোস্টগুলোতে শেয়ার তো দূরের কথা একটি লাইক দিতেও নারাজ কেউ কেউ। ফেসবুকে নিজেকে জাহির করাই যেন আমাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।

আজ আপনি একা থাকতে পছন্দ করছেন। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন। অন্যের বিপদে নীরব থাকছেন। দেখবেন, আপনার বিপদেও কেউ এগিয়ে আসবে না। আপনাকে সবাই এড়িয়ে চলবে। আজকাল দেখা যায়, অধিকাংশ তরুণ-তরুণী, যুবা বিষণ্নতায় ভোগে। অন্যদের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার কারণে একাকিত্ব জেঁকে বসে তাদের জীবনে। একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা, হতাশা তাদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কাজেই আমাদের উচিত পরিবার, সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব, পাড়া–প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধন গড়ে তোলা। তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। অন্যকে ভালোবাসা।

অন্যদিকে ছোট থেকেই একটি শিশুকে বলে দেওয়া হয় তোমাকে ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে। সবার চেয়েও ভালো নম্বর পেতে হবে। এই যে তাদের প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এটাই তাদের পরবর্তী জীবনে প্রভাব ফেলছে। তারা ভেবে নেয়, যেকোনো মূল্যে আমাকে সেরা হতে হবে, হোক সেটা বৈধ কিংবা অবৈধ পথে। সেরা হওয়াটাই যেন তার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। তখন আর তাদের মধ্যে সহযোগিতা করার মনোভাব থাকে না। অন্যকে নিয়ে ভাবার মানসিকতা তৈরি হয় না। ত্যাগের পরিবর্তে ভোগেই মুখ্য হয়ে ওঠে।

বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা যায়, অনেকে হাই ভলিউমে মাইক বা সাউন্ড বক্স বাজায়। এমনকি রাতে সবাই যখন ঘুমাচ্ছে, তখনো এগুলো চালু রাখে কেউ কেউ। ফলে অনেকে ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না। অসুস্থ রোগীরা হয়ে পড়ে আরও অসুস্থ। কিন্তু আমরা যদি সবার কথা ভাবতাম, তাহলে এসব অন্যায় কাজ সংঘটিত হতো না। কয়দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি প্রতিবেদন দেখি। যেখানে দেখা যায়, এক প্রভাবশালী প্রতিবেশী অন্য প্রতিবেশীর বাড়ির চারপাশে দেয়াল তুলে রেখেছে। যে কারণে ওই প্রতিবেশীকে দেয়াল টপকে চলাচল করতে হচ্ছে, যা আমাদের সমাজের কিছু মানুষের আত্মকেন্দ্রিক চরিত্রকেই সামনে নিয়ে আসে।

একসময় দেখা যেত, সময় পেলেই বাড়ির সব সদস্য মিলে ছাদে কিংবা বাড়ির উঠানে গল্পগুজব করত। কেউ গান গাইত, অন্যরা মনোযোগ দিয়ে তা শুনত। বড়রা ছোটদের খোঁজখবর নিত। এভাবে সবার মধ্যে একটি মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠত। এখন কিন্তু তা দেখা যায় না। এখনকার ছেলেমেয়ে একটু অবসর পেলেই মুঠোফোন হাতে নেয়। তার পোস্ট করা ফটোতে কয়টা লাইক পড়ল, কে কমেন্ট করল, কী নোটিফিকেশন এল, তা চেক করতে করতেই আর তাদের সবার সঙ্গে মিলে হইহুল্লোড় কিংবা আড্ডা দেওয়ার সময় থাকে না। অনেকেই তো বলেই ফেলে, পড়ার টেবিলে বসলে যেন সময় যেতে চায় না। অথচ ফেসবুকে ঢুকলে কখন দিন হলো আর কখন রাত হলো টেরই পাওয়া যায় না। কী ভয়ংকর কথা!

আজ আমাদের তরুণ সমাজ কোনদিকে ধাবিত হচ্ছে! পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়ায় তরুণেরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। নৈতিকতার অবক্ষয়ও এর জন্য কম দায়ী নয়। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে তাদের কাছ থেকে নির্বাসিত হচ্ছে সহযোগিতার মনোভাব। ফলে সামান্য স্বার্থের জন্য আমরা বিসর্জন দিচ্ছি নীতি-নৈতিকতা, মায়া, মমতা-ভালোবাসা। তাই আসুন, শুধু আমি আমি না বলে ‘আমরা’ বলতে শিখি।

*লেখক: মারুফ হোসেন, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া